রাখাইনদের তাঁতশিল্প

খিন মে : ‘রাখাইন’ একটি জাতির নাম, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একটি সম্প্রদায়ের নাম। আলাদা ভাষা (বর্ণমালাসহ), ভিন্ন সংস্কৃতি, পৃথক ঐতিহ্য ও ভিন্ন জাতিসত্তা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় রাখাইনদের বসবাস। বর্তমানে নানা বঞ্চনা আর নিদারুণ কষ্টের মধ্যে জীবন কাটে রাখাইনদের। সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় একে-একে বন্ধ হয়ে গেছে রাখাইন নারীদের প্রধান অর্থনৈতিক অবলম্বন রাখাইনদের তাঁতশিল্পহস্তচালিত তাঁতগুলো। ‘রাখাইন’ শব্দটি এসেছে পালি ভাষার ‘রক্ষা’ থেকে। ‘রাখাইন’, যার অর্থ রক্ষণশীল। সেই রক্ষণশীল জাতি আজ নিজেদের রক্ষা করতে পারছে না। সীমিত হয়ে আসছে রাখাইন লোকালয়গুলো। কমছে আয়। বাড়ছে দুর্ভোগ। জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে মানবেতরভাবে। কালের বিবর্তনে তারা আজ প্রায় নিঃস্ব। শোষণ আর বঞ্চনার শিকার হয়ে আজ তারা অসহায়।

রাখাইন পরিবারের নারীরা বেকার হয়ে পড়ছে। দিন-দিন রাখাইন পরিবারগুলো বেকারত্বের বেড়াজালে বন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। রাখাইন নারীদের অন্যতম জীবিকা তাঁতশিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের এ দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাঁতশিল্প রাখাইনদের অর্থনীতিতে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছিল। অতীতে রাখাইনদের তৈরি রেশমি লুঙ্গি ছিল যথেষ্ট প্রশংসিত পণ্য। ‘রাখাইন-প্রে’ তথা আরাকানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাওয়া যায়, সে সময় তাঁতশিল্পে রাখাইন রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে, রাখাইন রাজকুমারী ‘পো ওয়া মে’ (রেশমি অর্থে) নিজের পোশাক নিজেই বানাতেন এবং তাতে হাতি, ঘোড়া, ময়ূর, প্রজাপতি, ফুল ইত্যাদির নকশা করতেন। কিন্তু বর্তমানে সুতার অভাবে রেশমি লুঙ্গি বয়ন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সুতার মূল্যবৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, অর্থনৈতিক সহায়তা ও বাজারজাতকরণের সুবিধা না থাকায় বিলুপ্ত হতে চলেছে রাখাইনদের তাঁতশিল্প। রাখাইন পল্লির পাশ দিয়ে যেতে-যেতে এখন আর শোনা যায় না ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁতের ঠুকঠাক মাকুর শব্দ।

আগের দিনে মেয়েদের তাঁতের কাজ জানাকে জাতিগত গুণ বলে গণ্য করা হত রাখাইন সমাজে। রাখাইন পরিবারে তাঁতে কাপড় বুনতে জানত না এমন মেয়ে বিরল ছিল এক সময়। মা অথবা পরিবারের বয়স্ক নারীরা পরিবারের কিশোরীকে সংসারের দেখাশেনার কাজের সঙ্গে-সঙ্গে তাঁতে কাপড় বোনার কাজ শিক্ষা দিয়ে তাদের পারদর্শী করে তুলতেন। বিয়ের প্রস্তাবের সময় এই গুণকে বড় করে দেখা হত এবং বিবেচনায় আনা হত। যে মেয়েটি কাপড় বোনার কাজে যত বেশি দক্ষ ও পারদর্শী, বরপক্ষ তার সঙ্গে তাদের ছেলে বিয়ে দিতে ততই আগ্রহী থাকত। কেননা, সে পরিবারের ভরণ-পোষণের আর্থিক সমস্যা দূরীকরণে সাহায্য করতে পারবে।

রাখাইন নারীরা পরিবারের সদস্যদের নিম্নাঙ্গের পরিধেয় বস্ত্র তৈরির জন্য মূলত শুরু করে ঐতিহ্যবাহী তাঁত বুনন। অপরূপ কারুকাজ ও নান্দনিক ডিজাইনের জন্য রাখাইনদের তৈরি তাঁতের কাপড়, লুঙ্গি, থামি, চাদর, সাইড-ব্যাগ বা ঝোলাথলে, টুপি ও রুমালের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। রাখাইন তাঁতে উৎপন্ন পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায় বাংলাভাষিদের মাঝেও। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মধ্যেও রাখাইন তাঁতে তৈরি পণ্যের কদর ছিল অত্যধিক। তাই দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এসব পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন দেশের বাইরে। তখন প্রতিটি পাড়ার অসংখ্য তাঁত রাখাইনদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান বাজারে একটি লুঙ্গি তৈরি করতে একশো থেকে চারশো টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে এবং একটি সাইড-ব্যাগ তৈরি করতে একশো থেকে দুশো টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা, পর্যাপ্ত কাঁচামাল সরবরাহ, উন্নত প্রশিক্ষণ, ব্যাংক ঋণ ও বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করা গেলে আবারও পুনরুজ্জীবিত হতে পারে ঐতিহ্যবাহী রাখাইন তাঁতশিল্প। যেমন: তাঁত স্থাপন করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তাঁতিদের তাঁত ও সুতা কেনার সহজ শর্তে পর্যাপ্ত ও সহজলভ্য ঋণ প্রদান করা, সুতা ও রং ন্যায্যমূল্যে পাওয়ার ব্যবস্থা করা, রাখাইন তাঁতিদের তৈরি বস্ত্র যথাযথ বাজারমূল্যে বিক্রয়ের জন্য নিশ্চিয়তা প্রদান করা, কাছাকাছি টেক্সটাইল মিলস থেকে রাখাইন তাঁতিদের জন্য সুতা বরাদ্দের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। সরকারিভাবে এসব নিশ্চিত করা গেলে রাখাইন পরিবারগুলোতে ফিরে আসতে পারে সচ্ছলতা। তাতে সমৃদ্ধ হবে দেশীয় সংস্কৃতি।

Source : FB.com/maung.pintu