মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন : বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের নির্বাচনী ইসতেহারে (২৪ জুলাই ২০০৯ –এ সংশোধিত) বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি অংশের ১১.১ নং অনুচ্ছেদের একাংশে বলা হয়েছে “সরকারের প্রশাসনিক কার্যক্রমের বর্তমান ফাইল ব্যবস্থাপনাকে ই-গর্ভমেন্ট বা ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থায় রুপান্তর করা হবে ও জনগণকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেবাদান নিশ্চিত করা হবে”। প্রথম দিকে ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তব রূপটি কেমন হবে তা নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মনে সংশয় ছিল। কিন্তু বিগত চার বছরে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা ও অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটি স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
২০১০ সালে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ গঠন করা হয়। বর্তমানে এই বিভাগ দুটিকে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়ে উন্নীত করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে একজন পূর্ণ মন্ত্রীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যার মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গিকারের প্রতিফলন স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।
সরকারের সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অধিদপ্তর/পরিদপ্তরের প্রতিশ্রুত নাগরিক সেবাসমূহকে তথ্য-প্রযুক্তি ভিত্তিক আধুনিকায়নের জন্য প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিং ও আইনগত সংস্কার প্রয়োজন। প্রচলিত আইনে সরকারের অনেক সেবার অনলাইন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আবার ম্যানুয়েল পদ্ধতির ওয়ার্ক-ফ্লো অপরিবর্তিত রেখে কেবলমাত্র ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রতিস্থাপন করলে অনেক ক্ষেত্রে সেবার কাঙ্খিত মান, দ্রুততা, সহজলভ্যতা, কৃচ্ছতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ জন্য আইসিটি মন্ত্রনালয়ের এলোকশন অব বিজনেসে প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিং এবং চেঞ্জ ম্যানেজমেন্টের (পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা) আইনগত এখতিয়ার প্রদান করা যেতে পারে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল চালিকা শক্তি তরুন প্রজন্মকে আইসিটি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আইসিটিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ব্যপারে ব্যপক কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এটি একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা যা ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারনাটির টেকসই বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু এই দক্ষ জনশক্তিকে বেসরকারি সেক্টরের পাশাপাশি সরকারি সেক্টরে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করে না দিলে সরকার প্রতিশ্রুত নাগরিক সেবার তথ্য প্রযুক্তি ভিত্তিক আধুনিকায়ন সম্ভব নয়।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অধিদপ্তর/পরিদপ্তরে রাজস্ব খাতে দুই শতাধিক প্রথম শ্রেণীর আইসিটি কর্মকর্তা কর্মরত আছেন। এখনো পর্যন্ত এসকল জনবলের জন্য সরকার কর্তৃক কেন্দ্রীয়ভাবে কোন কর্মপরিধি নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতাহীন এই দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোন ক্ষমতা নেই। স্ব-স্ব মন্ত্রনালয়/দপ্তরের প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিং, আইনগত সংস্কার, ওয়ার্ক-ফ্লো পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে এসকল জনবলের ভূমিকা রাখার তেমন কোন সুযোগ এখনো প্রতিয়মান নয়। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে এসকল জনবলের বেতন ভাতা বাবদ সরকারের রাজস্ব খাতের বিপুল ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য আউটপুট সরকার পাচ্ছে না। তাছাড়া স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীন কর্মরত থাকায় এবং প্রায় সকল ক্ষেত্রে সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে শূন্য পদগুলো পূরণ করায় বছরের পর বছর ধরে তাঁরা পদোন্নতির সুযোগ বঞ্চিত। ফলে এই খাতে বর্তমানে কর্মরত জনবল কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলছে। ফলে সরকারের আইসিটি খাতকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করার বিষয়ে ভবিষ্যৎ তরুন প্রজন্মও সন্দিহান। সরকারের সকল আইসিটি জনবলকে আইসিটি মন্ত্রনালয়ের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে এনে একটি আইসিটি সার্ভিস গঠনের মাধ্যমে সরকারের আইসিটি খাতকে একটি সম্মানজনক পেশায় পরিণত করে দক্ষ আইসিটি জনবলকে এই খাতে আকৃষ্ট করা প্রয়োজন।
এখানে একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার ইলেক্ট্রনিক আন্ত-যোগাযোগ ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যদি তাদের অভ্যন্তরীন প্রয়োজনে আইসিটি সংশ্লিষ্ট কোন উন্নয়ন (সফটওয়ার/হার্ডওয়ার সংশ্লিষ্ট) করে তবে সে প্রতিষ্ঠান হয়তো তাদের নিজস্ব গন্ডির মধ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে, কিন্তু সে প্রতিষ্ঠানের সাথে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আন্ত-যোগাযোগ দূরহ হবে বইকি। এমনকি প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যদি পৃথক-পৃথক ভাবে নিজস্ব ধ্যান-ধারনায় আইসিটি সংশ্লিষ্ট কোন উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে তবে সরকারী অর্থের অপচয় হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে একেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ একেকভাবে কাজ করছে। সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে এ জন্য একযোগে কাজ করা প্রয়োজন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর, বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাননীয় প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান সমন্বয়ের বিষয়টি বিবেচনায় এনে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অধিদপ্তর/পরিদপ্তরে রাজস্ব খাতে কর্মরত সকল আইসিটি জনবলকে একটি একক প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রথম থেকেই কাজ করে গেছেন। তারই ধারাবাহিকতায়, গত মার্চ ২০১২ এ আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর ও তার সাংগঠনিক কাঠামোর বিষয়ে কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক সম্মতি জ্ঞাপন করা হয়েছে। যার আওতায় দেশের সকল জেলা ও উপজেলায় আইসিটি জনবল নিয়োগ করা যাবে। এই কাঠামোটির দ্রুত অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবী।
প্রয়োজনে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানী লিমিটেড, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানী লিমিটেড, টেলিফোন শিল্প সংস্থা ও টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড কে আইসিটি মন্ত্রণালয়ভুক্ত করার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাগরিক সনদ অনুযায়ী ভোক্তাদের দোরগোড়ায় সরকারের সেবা পৌছে দেয়া তথা তথ্য-প্রযুক্তি সমুদ্ধ আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে আইসিটি মন্ত্রণালয়কেই মুখ্যভূমিকা পালন করতে হবে।
[লেখকঃ মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রোগ্রামার, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ঢাকা। ই-মেইলঃ mithu_cse24@yahoo.com]