প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন বীজ বর্ধন খামার – দক্ষিণাঞ্চলের মাঠ আবার হাঁসবে বালাম ধানে

নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ ধান নদী খাল এই তিনে বরিশাল। এক সময় এ কথাটি দেশের সবাই এক বাক্যে স্বীকার করলেও বর্তমানে এ কথাটি অনেকটাই বাসী হয়ে গেছে। বরিশালে নদী-খাল আছে বটে, তবে বাংলার শষ্য ভান্ডার বলেখ্যাত বরিশাল ধান উৎপাদনের রেকর্ড হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই। গত দু’যুগ ধরে বরিশাল খাদ্য ঘাটতির অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বরিশালের বালাম ধান ও প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন বীজ বর্ধন খামার - দক্ষিণাঞ্চলের মাঠ আবার হাঁসবে বালাম ধানেচালের সুনাম ছিল দেশ-বিদেশে। তবে দীর্ঘদিন পরে হলেও বিলুপ্ত প্রায় এই বালামধানসহ দেশী প্রজাতির বহু ধান রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) প্রায় আড়াই’শ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, “দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে বীজ বর্ধন খামার স্থাপন” শীর্ষক এ প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের পতিত জমিতে বালাম ধান চাষ করে বছরে বাড়তি ৩০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ খামারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন। সূত্রে আরো জানা গেছে, উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড ধানের দাপটে ঐতিহ্যবাহী বালামসহ হারিয়ে যেতে বসেছে দেশীয় প্রজাতির ধান। গবেষণা ও জাত সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেয়ায় ইতোমধ্যে প্রায় ১৫ হাজার দেশীয় জাতের ধান হারিয়ে গেছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, একসময় বালাম চালের জন্য বিখ্যাত ছিলো বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলা। উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড ধানের দাপটে বানারীপাড়ার দেড়’শ বছরের ঐতিহ্যবাহী বালামের ব্যবসা জৌলুস হারিয়েছে। অথচ এক সময় বানারীপাড়ার বালাম চালের সুখ্যাতি ছিলো দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও। বানারীপাড়ার মলঙ্গা, নলেশ্রী ও ব্রাহ্মণকাঠী গ্রাম বালাম চালের জন্য বিখ্যাত ছিলো। দেশের বিভিন্নস্থান থেকে চাল ব্যবসায়ীরা বানারীপাড়ায় এসে চাল ক্রয় করে তাদের এলাকায় নিয়ে যেতো। সূত্রে আরো জানা গেছে, ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও বানারীপাড়ার স্থানীয় নদীর প্রায় দু’কিলোমিটার জুড়ে বালাম চালের ভাসমান হাট বসতো। সারা বছরই ব্যস্ত থাকতো ওইসব এলাকার হাজার-হাজার চাতাল শ্রমিকেরা। তখন বানারীপাড়ার অধিকাংশ জমিতেই বালাম ধান চাষ করা হতো। কিন্তু এখন আগের মতো জোয়ারের পানি ওঠে না। বীজধানও পাওয়া যায় না বলে বালাম আবাদ কমে গেছে। এছাড়া বরিশাল বিভাগের অন্যান্য জেলায়ও বালাম ধানের চাষ হতো। এখনও চাষ হচ্ছে, তবে তা খুবই কম। এখন কৃষকেরা বালামের পরিবর্তে চাষ করছেন উচ্চফলনশীল বিআর-২৮, ২৯ ও ৩৬ জাতের ধান। কারণ একই পরিমাণ জমিতে একই খরচে ফলন পাচ্ছেন বেশি। বালামের স্থানীয় অনেক নাম রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সীতাভোগ, জয়না, নলডোক, রূপের শাইল, লোতরমোটা, কুরিয়ারগালী, কুরিশাইল, কাজল শাইল, রাজশাইল, কুটিআগনি, বেতিচিকন, কেয়া মৌ, কেরাঙ্গাল, বাঁশফুল, ডিঙ্গামনি ও লক্ষ্মীবিলাস। স্বচ্ছল ও শৌখিন কৃষকেরা নিজেদের খাওয়া বা অতিথি আপ্যায়নে জন্য এখনো অল্প পরিমাণে বালাম ধান চাষ করেন। সূত্রে আরো জানা গেছে, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি এবং পিরোজপুর জেলায় এক সময় বালাম ধানের চাষ হতো। পটুয়াখালীর উপকূলের বাঁধের বাইরে যেসব জমিতে এখনো জোয়ার-ভাটা হয়, সেখানে এখনো বালাম ধানের আবাদ হয়।

বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহী বালামসহ স্থানীয় প্রজাতির ধান রক্ষায় দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে বীজ বর্ধন খামার স্থাপন প্রকল্পটি গত বছরের ২৪ জানুয়ারি একনেক সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২’শ ৪৪ কোটি ৯৬ লক্ষ টাকা। প্রকল্পের মাধ্যমে বরিশাল অঞ্চলের প্রায় ১০ লাখ হেক্টর জমি চাষের আত্ততায় আসবে। এতে বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন হবে। ইতোমধ্যে প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ৮৮ একর জমি অধিগ্রহণ করার প্রক্রিয়া চলছে। পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনকে ৩৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে জমি অধিগ্রহনের জন্য। বিএডিসির সদস্য পরিচালক (বীজ উৎপাদন ও খামার) মোঃ নুরুজ্জামান বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় বীজ উৎপাদন খামারে ইতোমধ্যে রবি শস্যের চাষ শুরু হয়েছে। এ খামারে উন্নতমানের বীজ উৎপাদনের মাধ্যমে শস্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত বরিশালের হারানো গৌরব আবারো ফিরে আসবে। দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে বীজ বর্ধন খামার স্থাপন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, প্রকল্পের আত্ততায় বীজ উৎপাদনের জন্য ইতোমধ্যে পটুয়াখালীর দশমিনার চর বাঁশবাড়িয়ায় জমি নেয়া হয়েছে। গত আমন মৌসুমে বালাম ধানের বীজ সংগ্রহ করে আগামী বছরে কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হবে। তিনি আরো জানান, দু’এক বছর আগেও বরিশালে ৫০ হাজার একর জমিতে বালাম চাষ হলেও গত বছর হয়েছে মাত্র ২’শ একর জমিতে। অন্যান্য ধান যেখানে একরে ৫ থেকে ৬ টন হয়, সেখানে বালামের গড় ফলন হচ্ছে একরে দেড় টনের কাছাকাছি। স্থানীয় একাধিক বালাম চাষীদের সাথে কথা হয়েছে, তারা বিএডিসিকে বালাম ধানের বীজ সরবরাহ করবেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।