প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ আবদুল হক ॥ ক্যান্সারের নাম শুনলেই আমরা ভয়ে আঁতকে উঠি। এটি কিন্তু একটি মাত্র রোগ নয় বরং বলা যায় এক প্রকার ভয়ানক জটিল ব্যাধিগোষ্ঠী। আমাদের শরীরের প্রায় যে কোনো জায়গাতেই ক্যান্সার হতে পারে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রকৃতিতে সৃষ্ট হওয়া নানা রকম উপসর্গ সৃষ্টি করে এরা। তবে একই রকম রোগধারা এবং জীবনের মারাত্মক পরিণতির জন্য সমষ্টিগতভাবে এদের ক্যান্সার বলা হয়। ক্যান্সারের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, কর্কট রোগ : কর্কট রোগ এ জন্য বলা হয় যে, কাঁকড়া যেমন কোনো বস্তুকে তার করাতের দাঁতের মতো চিমটাযুক্ত ঠ্যাৎ দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে, শত চেষ্টায়ও (ঠ্যাং ভেঙে গেলেও) তা ছাড়ানো যায় না, ক্যান্সারের প্রকৃতিও ঠিক তেমনি। আশপাশের কোষকলাকে মরণকামড় মারে, এমনকি দূরবর্তী নতুন বসতি স্থাপনাতেও হানা দেয় তার আগ্রাসী স্বভাবের কারণে।
উপযুক্ত পরিবেশে, উপযুক্ত সময়ে মাতার ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে পিতার শুক্রকীট। লক্ষণীয় যে, সাধারণভাবে একটি শুক্রকীটে এগারো জোড়া অটোজোম এবং একটি সেক্স ক্রোমোজোম, এক্স অথবা ওয়াই থাকে। মাতার একটি ডিম্বাণুতেও একইভাবে এগারো জোড়া অটোজোম এবং একটি সেক্স ক্রোমোজোম সর্বদাই ‘এক্স’ থাকে। মাতার ডিম্বাণুটি যদি পিতার ‘এক্স’ ক্রোমোজেম যুক্ত শুক্রকীট দ্বারা নিষিক্ত হয় তাহলে কন্যাসন্তান আর যদি ‘ওয়াই’ ক্রোমোজোম দ্বারা নিষিক্ত হয় তাহলে পুত্রসন্তান লাভ হবে। এটি সম্পূর্ণ (আল্লাহর এখতিয়ার) (দেখুন, সূরা শুয়ারা, আয়াত-৪৯-৫০)।
এখন সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয়টি হলো মাতৃগর্ভে জরায়ুর মধ্যে নিষিক্ত ডিম্বটি এমন দ্রুতগতিতে কোষ বিভাজন শুরু করে দেয় যে, আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। মাতার অর্ধেক পিতার অর্ধেক মিলে একটি পূর্ণ কোষ তৈরি হয় (এক্স+এক্স হলে কন্যা এবং এক্স+ওয়াই হলে পুত্র) এরপর এই কোষ থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি, চারটি থেকে আটটি এবং আটটি থেকে ষোলটি, ষোলটি থেকে বত্রিশটি, জ্যামিতিক হারে এভাবে কোষ বিভাজন দ্রুত অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। কোষ বিভাজনগুলো এমন সুশৃঙ্খল ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে এগিয়ে যায়, যাতে সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সর্বাঙ্গ সুন্দর মানবশিশুটি পরিপূর্ণতা লাভ করে পৃথিবী নামক স্থানে আগমন করতে পারে। (দেখুন সূরা আল মোমেনুন, আয়াত-১২, ১৩, ১৪)।
সদ্যোজাত শিশুর নাকটি দুই ইঞ্চি কিংবা একটি কান তিন ইঞ্চি লম্বা হয়ে আসে না। কে, কোন মহাশক্তি মাতৃগর্ভে ভ্রূণের কোষ বিভাজনকে এমনভাবে সুষম সুনিয়ন্ত্রণ করে এবং একটি বিশেষ পর্যায়ে এসে কোষ বিভাজন থমকে দাঁড়ায়? শরীরের যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নির্দিষ্ট স্থানে সন্নিবেশিত হয়। একটি চোখ কপালে আর একটি মাথার পেছনে স্থাপিত হয় না। হাত-পায়ের আঙুল কোনো একটি দুই বা তিন ইঞ্চি লম্বা হয়ে যায় না। আল্লাহ হতে অবিশ্বাসী বিজ্ঞানীরা বলবেন এটি নেচার বা প্রকৃতিগতভাবেই ঘটে। কিন্তু ঈমানদার বিজ্ঞানী জানেন আল্লাহই আহসানুল খালেক্বীন-আল্লাহই সর্বোত্তম সৃষ্টিকারী স্রষ্টা। জন্মের ২৫ বছর পর্যন্ত নারী-পুরুষের দৈহিক আকৃতি সর্বাঙ্গ-সুন্দররূপে গড়ে তোলেন। মহাবিস্ময়ের বিষয় একটি মাত্র নিষিক্ত কোষ থেকে মানব দেহের মস্তিষ্ক, হাড্ডি, গোশত, চামড়া, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ, পরিপাক, কিডনি, অন্ত্রাদি তৈরি হয়ে যায় নিখুঁতভাবে। ব্যত্যয় যে ঘটে না তা নয়।
যে অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে আমাদের দেহযন্ত্র নিরলসভাবে কাজ করে যায়, ব্যত্যয় ঘটলে স্থানবিশেষে স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না। সৃষ্টি হয় রোগের। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাহ্যিক নির্ণয়যোগ্য অসুস্থতার বহু পূর্বেই সাইটোকেমিক্যাল, বায়োকেমিক্যাল অথবা কোষের মলেকিউলার লেভেলে গড়বড় শুরু হয়, যার সবটাই বিনির্ণয় করার, মাপজোক করার যন্ত্রপাতি বা জ্ঞান আজ বিজ্ঞানীদের আয়ত্তে আসেনি। ক্যান্সারের উৎপত্তির ব্যাপারেও আমরা অনেক কিছুই জানলেও আসল কথাটি জানি না। কেন ক্যান্সার হয়? কার কার হয়, কোন কোন পরিবারে হয়, কোন কোন বিশেষ এলাকাতে ক্যান্সার বেশি দেখা যায়। আবার মানবদেহের কোন বিশেষ অঙ্গে তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। উল্লিখিত হয়েছে যে, আমাদের দেহ লক্ষ কোটি বিভিন্ন রকমের কোষ দিয়ে তৈরি। সুস্থ দেহে এই কোষগুলো (মস্তিষ্ক কোষ বাদে) নিয়মিত ও সুনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনের মাধ্যমে শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ ও যন্ত্রের বৃদ্ধি সাধন ও ক্ষয়রোধ করে।
ক্যান্সারের উৎপত্তি
সম্ভবত একটি অঙ্গের একটি মাত্র কোষ থেকেই ক্যান্সারের উৎপত্তি হয়ে থাকে। পরে আলোচিত অথবা আমাদের অজ্ঞাত কোনো কারণে হঠাৎ করেই একটি কোষে অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন শুরু হয়ে যায় এবং বিরামহীনভাবে তা চলতে থাকে। ফলে অচিরেই সেখানে আর একটি পিণ্ড বা টিউমারের সৃষ্টি হয়। এই টিউমারটি একটি অসংহারী (ইন্নোসেন্ট বা বিনাইন) টিউমার হতে পারে শুরুতে, যা পরে সংহারী (ম্যালিগন্যান্ট) টিউমারে রূপান্তরিত হতে পারে অথবা শুরু থেকেই টিউমারটি বছরের পর বছর ধীরগতিতে বাড়ছে। স্থানীয় কোষকলার মধ্যে অনুপ্রবেশ করছে না, শরীরেও দৃষ্টিগোচর কোনো ক্ষতিসাধন করছে না, এগুলোই বিনাইন বা অক্ষতিকর। কিন্তু বিশালাকারে হলে আশপাশের অরগ্যানের ওপর চাপ দিলে কিছুটা অস্বস্তিকর বোধ হতে পারে। তবে মস্তিষ্কের ভেতর গঠিত যে কোনো টিউমারই সংহারী পদবাচ্য হবে তাদের ‘জায়গা দখলকারী’ চরিত্রের কারণে। মাথার খুলির মধ্যে মস্তিষ্ক বা তার আবরণীর যে কোনো টিউমারই সীমিত স্থানে বৃদ্ধিপ্রাপ্তিতে বাধাগ্রস্ত হয়ে চতুষ্পার্শ্বের মস্তিষ্কের কোষ নিউরনের ওপর চাপ দিয়ে তাদের কাজের ভীষণ সমস্যার সৃষ্টি করে এবং ‘হেড অফিস’ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে অকেজো করে ফেলে। সংহারী, ক্ষতিকারক বা ম্যালিগন্যান্ট টিউমারগুলোর চরিত্র একেবারেই ভিন্নতর। এরা শুরু থেকেই সংহারী, বিনাইন, অসংহারী থেকে সংহারীতে রূপান্তরিত, যাই হোক না কেন, দ্রুতগতিতে বাড়ে, আশপাশের কোষকলায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে অনুপ্রবেশ করে। স্থানীয় শিরা-উপশিরা, লসিকাবাহী শিরার মধ্যে ক্যান্সার কোষ জোর করে ঢুকে পড়ে এবং শরীরের দূরবর্তী স্থানে গিয়েও নতুন বসতি স্থাপন করে, যাকে ‘মেটাসটেটিক টিউমার’ বলা হয়। যথাসময়ে বিস্তৃতিতে বাধা না পড়লে স্বল্পকালের মধ্যেই ক্যান্সার অবধারিতভাবেই মৃত্যু ঘটায়। তার প্রধানত কারণ এই যে, ক্যান্সার কোষ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে জীবনরক্ষক অঙ্গ যেমন-অস্থিমজ্জা (বোন ম্যারো), ফুসফুস, যকৃৎ, বৃক্ক (কিডনি), মস্তিষ্ক ইত্যাদিতে নতুন বসতি স্থাপন করে। ফলে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় চলে আসে, দেহাভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ হয় এবং শরীরে নানা প্রকার রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঘটায় এবং মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। ‘মেটাসটেটিক’ আয়ু কমিয়ে দেয়। তাই যথাশিগগিরই ক্যান্সার নির্ণীত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
ক্যান্সারের কারণ
ক্যান্সার কোনো সংক্রামক ব্যাধি নয়। কোনো রোগজীবাণু দ্বারা উৎপন্ন হয় না। ক্যান্সারের উৎপত্তির অনেক কারণই জানা গেছে তবে এর আসল কারণটি জানা যায়নি। ক্যান্সার উৎপাদনে কতগুলো কারণ সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত হয়েছে, এদের মধ্যে ধূমপান-শ্বাসনালি ও ফুসফুসের ক্যান্সার সৃষ্টি করে, তামাক পাতা যে কোনোভাবে ব্যবহৃত হোক না কেন জর্দা, কিমাম, খৈনী, তামাকের গুল ইত্যাদি এগুলো মুখগহ্বরে, শ্বাসনালি, স্বর উৎপাদন যন্ত্রের (ভোকাল কর্ড) ক্যান্সার সৃষ্টি করে। স্মর্তব্য যে, হুজুর আকরাম (সা.) সতর্ক করে দিয়েছেন, নেশা উৎপাদনকারী প্রতিটি বস্তুই হারাম। মদ্যপানে-যকৃতের ক্যান্সার হয়। মদ এবং জুয়া সম্বন্ধে আল্লাহ জালা শানুহু ইরশাদ করেছেন, ‘এই দুই বস্তুতে তোমাদের জন্য অপকার (ইসমুন) এবং উপকার দুই-ই রয়েছে। তবে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি।’
যে কোনো ধরনের মদ (অ্যালকোহল) যকৃৎ কোষের সংহার করে এবং পরিণামে লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সার হয়। বহু রাসায়নিক পদার্থ (যেমন মিথাইল কোলানথ্রিন) অন্ত্রের ক্যান্সার করে এবং এমন খাদ্য যাতে প্রচুর চর্বি রয়েছে তাও ক্ষতিকর। বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, আণবিক বিস্ফোরণ, তেজস্ক্রিয়তা, রক্তের ও চামড়ার ক্যান্সার করে। সদা ঘর্ষণ, আঘাত, প্রজনন ও বিকৃত যৌন আচরণে জরায়ুর মুখের ক্যান্সার করে। বর্ণগত, জাতিগত, জীবন-যাপন পদ্ধতিগত, ভৌগোলিক ও পরিবেশগত প্রভাব, প্যারাসাইট (পরজীবী) ও ‘ভাইরাস’ এসবই ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।
আমেরিকানদের চেয়ে জাপানিদের পাকস্থলীর ক্যান্সার প্রায় ৭-৮ গুণ বেশি, আবার জাপানিদের চেয়ে আমেরিকানদের ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রকোপ দ্বিগুণের চেয়ে বেশি, আর বেলজিয়ানদের মধ্যে আমেরিকানদের চেয়েও বেশি হয় ফুসফুসের ক্যান্সার। আইসল্যান্ডের অধিবাসীদের চেয়ে নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীদের ত্বকের ক্যান্সার প্রায় ৬ গুণ বেশি।
এখানে সূর্যের অতিবেগুনি (আলট্রাভায়োলেট) রশ্মিকে ক্যান্সার উৎপাদনের জন্য দায়ী করা হয়। সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে, গায়ের রঙ যত বেশি ফর্সা হবে ত্বকের ক্যান্সারের সম্ভাবনাও তত বেশি বৃদ্ধি পাবে। চামড়ার মধ্যেকার ‘মেলানিন’ (সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি, যা কিনা ক্যান্সারের সহায়ক, তা থেকে) ত্বককে রক্ষাকারী।
পেশার সাথে ক্যান্সার জড়িত থাকতে পারে। যেমন অ্যাসবেস্টোস ফ্যাক্টরি শ্রমিকদের ফুসফুসের ঝিল্লির ক্যান্সার পুরাল মেসোথেলিওমা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সুপারিশ অনুযায়ী এই ক্যান্সারে আক্রান্ত শ্রমিকরা মালিকের নিকট থেকে ক্ষতিপূরণের অধিকারী হবেন। তেমনি পি.ভি.সি পাইপ ইন্ডাস্ট্রিতে (পলিভাইনিল ক্লোরাইড ইন্ডাস্ট্রি) কর্মরত শ্রমিক, যারা ভাইনিল ক্লোইড পলিমেরাইজেশন চেম্বারে কাজ করেন তাদের যকৃতে অ্যানজিওসারকোমা নামক ক্যান্সার হয়। কৃষক, নাবিক, যাদের রোদে পুড়ে কাজ করতে হয় তাদের মধ্যে ত্বকের ক্যান্সার বেশি দেখা দেয়। বিশেষ করে মুখমণ্ডলে। মহিলা যারা কাজ করে গৃহাভ্যন্তরে তারা ত্বক ক্যান্সারে কচিৎ আক্রান্ত হন, তবে কর্মজীবী মহিলা যাদের রোদে পুড়ে কাজ করতে হয় এবং সূর্যের একটিনিক রশ্মি থেকে কান এবং মুখমণ্ডলকে ঢেকে রাখেন না তাদেরও উপরোক্ত ক্যান্সারের ঝুঁকি এসে যায়।
ইসলামের পর্দার বিধান মেনে চললে মহিলারা মুখমণ্ডলের ক্যান্সার থেকে বাঁচতে পারেন। হাড় কাঁপুনে শীতে যারা নিজের শরীরকে গরম রাখার জন্য কিংবা (এক প্রকার হাঁড়ি যাতে কয়লাযুক্ত আগুন থাকে, কাশ্মীরীরা ব্যবহার করেন) পেটের ওপর বেঁধে রাখেন তাদের কাংরী ক্যান্সার হয় পেটের উপরের চামড়ায়। এসবের ৯০ শতাংশই এড়িয়ে চলা সম্ভব।
বয়স
প্রায় সব বয়সেই ক্যান্সার দেখা যায়। তবে শিশু-কিশোরদের পাঁচটি ক্যান্সারের প্রকোপ খুব বেশি। (১) নিউরোব্লাস্টোমা (২) উইলমস টিউমার (৩) রেটিনো ব্লাস্টোমো (৪) একিউট লিউকিমিয়া ও (৫) র্যাবডোমায়ো সারমোমা। প্রথমটি অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ড ব্লেইন ও নাসারন্ধ্রে, দ্বিতীয়টি কিডনিতে, তৃতীয়টি চোখে (বিড়ালাক্ষী, বিড়ালের চোখের মতো রাতে জ্বলজ্বল করে), চতুর্থটি রক্তের ক্যান্সার এবং শেষটি মাংসপিণ্ডের ক্যান্সার।
বড়দের সাধারণত পঞ্চান্ন বছর বয়সের পর (এপিথেলিয়াম কলার) ক্যান্সার পরিদৃষ্ট হয়। আমেরিকায় সমস্ত মৃত্যুর শতকরা দশ ভাগ ক্যান্সারজনিত, যার স্থান রোড ট্রাফিক অ্যাক্সিডেন্টের মৃত্যুর পরেই।
ক্যান্সার কি বংশজাত?
অনেকেই প্রশ্ন তোলেন আমার পিতা-মাতা উভয়েই ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাহলে আমিও কি ক্যান্সারে মারা যাব? আজ পর্যন্ত যে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তা থেকে বোঝা যায় যে, ক্যান্সারের একটি সুনির্দিষ্ট পরিবেশগত এবং বংশগত প্রভাব রয়েছে। তবে অধিকাংশই আপনাআপনিতেই হয়। স্তন ক্যান্সার, বৃহদন্ত্র, ডিম্বকোষ, প্রস্টেট গ্রন্থি, জরায়ু এবং চামড়ার রঙ উৎপাদনকারী কোষ থেকে উৎপন্ন ক্যান্সার ‘মেলানোমা’। এরা সম্ভবত মেনডেলীয় উত্তরাধিকারের ধারা অনুসরণ করে। মোদ্দা কথা ক্যান্সার উৎপাদনে পরিবেশ এবং বংশধারা এ দুটিই আক্রমণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে দেয়।
বাংলাদেশে ক্যান্সারের প্রকোপ
আমাদের দেশে প্রতি বছর আনুমানিক প্রায় দুই লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় দেড় লাখ লোক এ রোগে মৃত্যুবরণ করে বলে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির তথ্য বিবরণীতে প্রকাশ। অপরদিকে আমেরিকায় এক মিলিয়নেরও (১ মিলিয়ন=১০ লক্ষ) অধিক লোক প্রতি বছর প্রথমবারের মতো শোনেন যে তাদের কোনো না কোনো রকমের ক্যান্সার রয়েছে। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯৪ সালে একমাত্র ক্যান্সারেই পাঁচ লাখ ত্রিশ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করেছে, যা কিনা সমস্ত মৃত্যুর শতকরা ২৩ ভাগ এবং একমাত্র হৃৎপিণ্ড ও শিরা-উপশিরার রোগেই এই ক্যান্সারের চেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটায় সে দেশে। বাংলাদেশে এবং আমেরিকায় ক্যান্সারের প্রকোপসংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান নিচে তুলে ধরা হলো-
বাংলাদেশে ক্যান্সারের প্রকোপ (সময় জানা নেই) সূত্র : বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি কর্তৃক প্রদত্ত প্রকোপের চিত্রটি বাস্তবিকই অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে এদেশে মেডিকেল কলেজগুলোর ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র, রেডিওথেরাপি বিভাগে চিকিৎসার জন্য সত্যিকার আক্রান্ত রোগীদের শতকরা কতভাগ আসে তা জানা নেই। ক্যান্সার সারে না, তেমন কোনো চিকিৎসা নেই এবং গণঅসচেতনতার জন্যই মনে হয় ক্যান্সার রোগীদের সত্যিকার পরিসংখ্যান থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। ফলে এই রোগের কারণে-যার প্রায় ৯০ শতাংশ এড়ানো যেত-তারা অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
গণসচেতনতা বৃদ্ধি, সত্বর ও সঠিক রোগ নির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতির সহজলভ্যতা, চিকিৎসা ব্যয়স্বল্পতা ইত্যাদি বিষয় নিঃসন্দেহে ক্যান্সার প্রকোপের হার কমিয়ে আনবে। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির দেয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায় মুখ, কণ্ঠ ও গলনালি, ফুসফুস, খাদ্যনালি, স্তন, জরায়ু ও লিউকিমিয়ায় প্রায় ৭৫ শতাংশ নর-নারী আক্রান্ত। তাদের দেয়া (১) ক্যান্সারের বিপদ সংকেত (২) সূচনায় ক্যান্সার নির্ণয়ের সুপারিশমালা (৩) ক্যান্সার প্রতিরোধের সুপারিশমালা প্রায় হুবহু নিচে তুলে ধরা হলো-
ক্যান্সারের বিপদ সংকেত
খুশখুশে কাশি কিংবা ভাঙা ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠস্বর। কাশির সাথে রক্ত, বুকে ব্যথা, ওজন কমে যাওয়া, শারীরিক দুর্বলতা, রক্তস্বল্পতা, কণ্ঠনালি স্বরযন্ত্র বা ফুসফুসের ক্যান্সার কি না তা রুল আউট করুন, নিঃসন্দেহ হোন।
সহজে সারছে না এমন কোনো ক্ষত।
অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ : এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, মহিলাদের বেলায় (১) সহবাসোত্তর রক্তক্ষরণ (২) যোনিপথে অস্বাভাবিক কোনো রক্তক্ষরণ
স্তনে বা শরীরের অন্য কোথাও (টিউমার) পিণ্ডের সৃষ্টি। স্তনের বোঁটার নিম্নগামিতা, রক্তমিশ্রিত রস নিঃসরণ। স্তনের ঊর্ধ্ব ও বহিঃচতুর্থাংশে বেশি ক্যান্সার পরিলক্ষিত হয়। সংশ্লিষ্ট স্তনের বগলে গুটলি বাঁধা খারাপ লক্ষণ।
গিলতে অসুবিধা অথবা দীর্ঘদিন যাবৎ হজমের গোলমাল-গলনালি বা পাকস্থলীর ক্যান্সার হতে পারে। বামদিকে ‘কলার বোন’-এর ওপর দিকে গুটলি বাঁধা-পাকস্থলীর ক্যান্সার।
মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন। নিয়মিতভাবে কিছুদিন পাতলা আবার কিছুদিন শক্ত পায়খানা বা কোষ্ঠকাঠিন্য। মাঝে মাঝে রক্তক্ষরণ, বিশেষ করে যাদের অর্শ (পাইলস) নেই।
তিল বা আঁচিলের সুস্পষ্ট পরিবর্তন বড় হওয়া, চুল গজানো, রঙের পরিবর্তন, রক্তক্ষরণ, বর্ডার বা সীমানায় পরিবর্তন।
সূচনায় ক্যান্সার নির্ণয়ের সুপারিশমালা
আমাদের দেশে কেন, পৃথিবীর সব দেশেরই ক্যান্সার সোসাইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান হচ্ছে ‘সূচনায় পড়লে ধরা, ক্যান্সার রোগ যায় যে সারা’। এই স্লোগানটি সমস্ত গণমাধ্যমে রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, সিনেমা হল সর্বত্রই গণসচেতনতা বৃদ্ধির সহায়ক বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
ক্যান্সারের যে কোনো বিপদ সংকেত দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন। সবুজ ছাতাযুক্ত স্থানে যান ‘সেবা নিন সুস্থ থাকুন।’
সম্ভব হলে প্রতি বছর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নিন।
প্রতিমাসেই নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করুন।
জরায়ুর ক্যান্সার বিশেষ করে জরায়ুমুখের ক্যান্সার হতে পারে (১) যদি আপনার দুর্গন্ধযুক্ত রক্তমিশ্রিত স্রাব হয় (২) যদি আপনার সহবাসোত্তর রক্তক্ষরণ হয়। এসব ক্ষেত্রে প্যাপ টেস্ট অথবা বায়োপসি টেস্ট করুন।
অন্ত্রের ক্যান্সার সন্দেহ করলে (আপনার মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাস পরিবর্তন) চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ‘এনডোস্কোপি’ করে নিশ্চিত হোন।
ক্যান্সার প্রতিরোধের সুপারিশমালা
মনে রাখবেন ধূমপান নয় আসলে বিষপান। অধূমপায়ীরা ধূমপায়ীদের আশপাশে থাকলে আসলে ধূমপায়ীর মতোই সমান ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সার ও হৃদরোগের ন্যায় মারাত্মক ব্যাধির সৃষ্টি করে। কাজেই ধূমপানের বদঅভ্যাস পরিত্যাগ করুন। এর জন্য আপনার ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।
তামাক পাতা, তামাক পাতায় প্রস্তুত জর্দা, কিমাম, দোক্তা, খৈনী ইত্যাদি সেবন পরিহার করুন। পানপাতা শুধু চুন, খয়ের ইত্যাদি সহকারে সেবনের অভ্যাস গড়ে তুলুন। আর তা না পারলে মুখগহ্বর, জিহ্বা, গলা, ফেরিংস, লেরিংস এসবের ক্যান্সারকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত থাকুন। উল্লেখযোগ্য যে, আমাদের দেশে মুখ ও গলার ক্যান্সারের হার অত্যধিক, যার প্রায় ৪০ শতাংশ কমানো সম্ভব।
সুরাপান স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এতে শুধু যকৃতের ক্যান্সারই হয় না বরং খাদ্যনালি, কণ্ঠনালি ও ফুসফুসের ক্যান্সারেরও হার বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে যদি এর সাথে ধূমপানও যুক্ত হয়। কাজেই মদ্যপান বর্জন করুন।
অত্যধিক চর্বি বা চর্বিযুক্ত খাদ্য এবং যখন তখন খাওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করুন। খাদ্য তালিকায় ছোবড়া (যেমন ডাঁটা) সবুজ পাতা-শাক-সবজি, ভিটামিন এ, সি এবং ই। জিঙ্ক (দস্তা) ও সেলেনিয়ামযুক্ত খাবার সংযোজন করুন।
নিয়মিত শরীরচর্চার অভ্যাস গড়ে তুলুন। শরীরের ওজন পরিমিত রাখুন। যথাসাধ্য নিজেকে চিন্তামুক্ত রাখুন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুমের ব্যবস্থা নিন (প্রত্যহ ৬-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত)।
ক্যান্সারের চিকিৎসা
ক্যান্সার চিকিৎসার সফলতা রোগের স্তর বা বিস্তৃতির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির স্লোগান হচ্ছে যে, ‘সূচনায় পড়লে ধরা, ক্যান্সার রোগ যায় যে সারা’ এই কথাটি সর্বতোভাবে সত্য। ক্যান্সার যখন সূচনা কোষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তখন ওই স্থান বা অঙ্গ কেটে ফেললেই একশত ভাগই নিরাময় সম্ভব। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, এ স্তরে রোগের কোনো প্রকার লক্ষণ প্রকাশ পায় না। ফলে চিকিৎসকেরও শরণাপন্ন হয় না কেউ। রোগ যখন আশপাশে বা দূরবর্তী স্থানে ছড়িয়ে পড়ে অথবা লক্ষণাদি প্রকাশ পায় তখনই কেবল আমরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিই। একজন সাধারণ চিকিৎসক ৫-৬ বছরের একটি শিশুর সর্দি-কাশি-জ্বর এবং শরীরের কোনো কোনো জায়গায় কালো দাগকে (কালসিটে পড়া) কোনো প্রকার খারাপ অসুখ চিন্তা না করেই সাধারণ চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। কালসিটে পড়া অথবা মাঢ়ি দিয়ে রক্ত পড়া, সর্দি-কাশি জ্বরের সাথে, কিংবা নাক দিয়ে রক্ত পড়া এই শিশুটির একটি মারাত্মক রোগ হয়ে থাকতে পারে, যাকে আমরা একিউট লিউকিমিয়া বলি। এখানে রক্ত পরীক্ষা ছাড়া সঠিক রোগ নির্ণয় করা সম্ভব নয়। বড়দের বেলাতেও এ কথা খাটে।
সাধারণত তিনটি পদ্ধতিতে ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে একাধিক পদ্ধতির প্রয়োজন দেখা দেয়। পদ্ধতিগুলো হচ্ছে- (১) সার্জারি বা শল্যচিকিৎসা (২) সেঁক দেয়া, বিকিরণ চিকিৎসা বা রেডিওথেরাপি এবং (৩) কেমোথেরাপি বা ক্যান্সারবিধ্বংসী ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা।
শল্য চিকিৎসা বা সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্ট
প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার আক্রান্ত স্থানকে সম্পূর্ণ কেটে বাদ দিয়ে শরীরকে ক্যান্সারমুক্ত করা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্যান্সারের প্রাথমিক অবস্থায় শল্যচিকিৎসায় সম্পূর্ণ নিরাময়ের সম্ভাবনা হচ্ছে সর্বাধিক। উদাহরণস্বরূপ আমরা মহিলাদের জরায়ুমুখের ‘ক্যান্সার ইন সাইট’র কথা উল্লেখ করতে পারি। জরায়ু কেটে ফেলে দিলেই তিনি সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে গেলেন।
সেঁক, বিকিরণ চিকিৎসা বা রেডিওথেরাপি
অনেক ক্যান্সার রোগীই শল্য কিংবা অন্যান্য চিকিৎসকের সাথে অথবা এককভাবে শুধু বিকিরণ চিকিৎসা পেয়ে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বিকিরণের সাহায্যে, কোনো প্রকার অস্ত্রোপচার না করেই, ক্যান্সার কোষগুলোকে শরীরের ভেতরে ধ্বংস করে ফেলা হয়।
কেমোথেরাপি বা
ক্যান্সারবিধ্বংসী ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা
কোনো কোনো ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসা ও বিকিরণ চিকিৎসার সাথে অথবা এর আগে বা পরে ক্যান্সার কোষ বিধ্বংসী ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা করা হয়। বস্তুত রোগের স্তর এবং রোগীর অবস্থাভেদে সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্ট, রেডিওথেরাপি অথবা কেমোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়।
উপসংহার
হুজুর আকরাম (সা.) ইরাশাদ করেছেন, প্রত্যেক রোগেরই ওষুধ আছে। কাজেই ক্যান্সারও এর ব্যতিক্রম নয়। ‘মরিতে চাহি না আমি এই সুন্দর ভুবনে’-যেমন মানুষের কাম্য, তেমনি আবার জন্ম নিলে মরতে হবে, অমর কে কোথা কবে? এর মধ্যেও কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ পাক বলেন, ‘তাদের জন্য যখন নির্ধারিত সময় (মৃত্যু) উপস্থিত হয় তখন এক মুহূর্তও এদিক-সেদিক করা হবে না।’ ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে আশার বাণী হলো এই যে, এক-তৃতীয়াংশ ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়। তৃতীয়াংশ ক্যান্সার নিরাময় করা সম্ভব, আর অধিকাংশ অনিরাময়যোগ্য বেদনাদায়ক ক্যান্সারের ব্যথা উপশম করা সম্ভব।