‘গাবো সে অতীত কথা, গৌরব কাহিনী,
নাচাইতে মুসলেমের নিস্পন্ধন ধমনী।
গাবো সে দুর্দম বীর্য দীপ্ত উন্মাদনা,
কৃপা করি অগ্নিময়ী করো এ রসনা।’
পৃথিবীতে মুসলমানদের উন্নতির জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আশীর্বাদ হিসেবে যুগে যুগে যে সকল মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিককে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন আল ফারাবি তাদের অন্যতম। তার জন্ম তারিখ কত তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তার জন্ম তারিখের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো তৎকালীন যুগে কারও জন্ম তারিখ লিপিবদ্ধ করে রাখার ব্যাপারে তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না। যতদূর জানা যায় এ মনীষী ৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কিস্থানের অন্তর্গত ‘ফারাব’ নামক শহরের নিকটবর্তী ‘আল ওয়াসিজ’ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ‘ফারাব’ নামক শহরের নামানুসারে আবু নাসের মোহাম্মদ পরবর্তীতে ‘আল ফারাবি’ নামে পরিচিত হন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী পাঠ করলে দেখা যায়, অনেকেই তাদের জন্মস্থান, নিকটবর্তী শহর কিংবা দেশের নামে পরিচিত ছিলেন। আল ফারাবির ক্ষেত্রেও তার বিপরীত ঘটেনি। ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ তার নামকে বিকৃত করে ‘ফারাবিয়াস’ লিপিবদ্ধ করেছে। আল ফারাবির পিতা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তার পূর্বপুরুষগণ ছিলেন পারস্যের অধিবাসী। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ও রাজনৈতিক কারণে তার পূর্বপুরুষগণ পারস্য ত্যাগ করে তুর্কিস্থানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
আল ফারাবি বাল্যকাল থেকেই ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। অজানাকে জানার এবং অজেয়কে জয় করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল তার হৃদয়ে। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায় তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন তার সারাটা জীবন। জ্ঞানের সন্ধানে তিনি ছুটে চলেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় ফারাবায়। সেখানে কয়েক বছর শিক্ষা লাভের পর শিক্ষার উদ্দেশে চলে যান বোখারায়। এরপর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি গমন করেন বাগদাদে। সেখানে তিনি সুদীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর অধ্যয়ন ও গবেষণা করেন। কয়েকটি ভাষার ওপর ছিল তার পূর্ণ দখল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ছিলেন তিনি পারদর্শী। দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী হিসেবে তার সুখ্যাতি আস্তে আস্তে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা বাকি ছিল না যেখানে ফারাবির প্রতিভা বিসতৃত হয়নি। কিন’ তারপরও জ্ঞানের পিপাসা তার মেটেনি। জ্ঞানের অন্বেষণে তিনি ছুটে গিয়েছেন দামেস্কে, মিসরে এবং দেশ বিদেশের আরও বহু স্থানে। গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা ও প্রশাখা নিয়ে। পদার্থবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রভৃতিতে তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে বিজ্ঞান ও দর্শনে তার অবদান ছিল সর্বাধিক। পদার্থবিজ্ঞানে তিনিই ‘শূন্যতার’ অবস্থান প্রমাণ করেছিলেন। দার্শনিক হিসেবে ছিলেন নিয়প্লেটনিস্টদের পর্যায় বিবেচিত। বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক হিসেবে তিনি আরোহণ করেছিলেন জ্ঞানের শীর্ষে
একবার রাজা সাইফ আদ দৌলার শাহী দরবারে মনীষী আল ফারাবি উপস্থিত হন। ইতিপূর্বে রাজা বিজ্ঞানী আল ফারাবির নাম শুনেছিলেন কিন’ ফারাবির সাক্ষাৎ পাননি। ফারাবিকে নিকটে পেয়ে রাজা খুব খুশি হন এবং ফারাবির সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। আলোচনায় ফারাবির জ্ঞান ও গুণাবলিতে রাজা মুগ্ধ হন এবং তাকে খুব সম্মান দেখান। বিজ্ঞানী আল ফারাবি রাজার সঙ্গী হিসেবে এখানে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন।
বিজ্ঞানী আল ফারাবি সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে বহু রচনা করেছেন। কিন্তু তার রচিত গ্রন্থে’র সংখ্যা শতাধিক বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন। এ সকল অমূল্য গ্রন্থের অধিকাংশেরই সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তার রচিত ‘আল আহলে আল মদীনা আল ফাদিলা’ (দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত) গ্রন্থেটি সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কেও তার রচিত কয়েকটি গ্রন্থ তাকে বিখ্যাত করেছে। তিনি আজ পৃথিবীতে বেঁচে নেই। কিন’ মুসলিম জাতির কল্যাণে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে মৌলিক আবিষ্কার রেখে গেছেন তা চর্চা করলে মুসলমানরা আজও জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি লাভ করতে পারবে। তিনি কত সালে ইন্তেকাল করেন তা নিয়েও মতভেদ আছে। যতদূর জানা যায় তিনি ৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেছিলেন।