স্টাফ রিপোর্টার ॥ মাত্র কয়েক বছর আগেও বিশেষ করে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, নড়াইল, ঝিনাইদহ থেকে আমদানি করা শাকসবজির ওপর নির্ভরশীল ছিলো বরিশালের গৌরনদী, আগৈলঝাড়া উপজেলাসহ পাশ্ববর্তী উপজেলার বাসিন্দারা। মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে এলাকার দিনমজুর ও শিক্ষিত বেকার-যুবকেরা গৌরনদীসহ পাশ্ববর্তী উপজেলার বিভিন্নস্থানে বিশেষ করে মাছের ঘের কিংবা উঁচু জমি লিজ নিয়ে শাকসবজির চাষ করে বাম্পার ফলন ফলিয়ে প্রায় শতাধিক পরিবার হয়েছেন স্বাবলম্ভী। একদিকে মাছ চাষ আরেকদিকে সবজি চাষ করে বাম্পার ফলন পাওয়ায় এসব উপজেলাবাসীর নিত্যদিনের শাকসবজি ও মাছের চাহিদা মিটিয়ে এখন উৎপাদিত সবজি ও মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায়। স¦ল্পবিনিয়োগে বেশি লাভবান হওয়ায় বর্তমানে এ পেশায় ঝুঁকে পরেছেন অসংখ্য বেকার-যুবকেরা। ফলে গৌরনদীর মাহিলাড়া ইউনিয়নের পূর্ব বেজহার গ্রামটি এখন সবজির গ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এসব শাক ও সবজির ক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকা দমনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার না করে ফেরোমন ট্রাপ (জাদুর ফাঁদ) ব্যবহার করে চাষীরা উপকৃত হয়েছেন।
ওই গ্রামের সফল চাষী আব্দুস সাত্তার রাঢ়ী জানান, পাঁচ সদস্যর পরিবারে এতোদিন তিনি দিনমজুরের কাজ করে কোন একমতে সংসার চালাতেন। গত দু’বছর পূর্বে তিনি উপজেলা উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা (মাহিলাড়া ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত) মোঃ সিরাজুল ইসলাম সিরাজের পরামর্শে সবজি চাষ শুরু করেন। প্রথম বছরেই তিনি বাম্পার ফলন পাওয়ার পর চলতি বছর পরিত্যক্ত জমিকে চাষাবাদের উপযোগী করে তিনি ৩০ শতক জমিতে করল্লা ও ধুনিয়াপাতা, ৩৬ শতক জমিতে ঢেঁড়শ, ৬ শতকে পাট শাক, ৩০ শতক জমিতে ডাটা শাকের চাষাবাদ করে বাম্পার ফলন পেয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনি প্রায় লক্ষাধিক টাকার শাক-সবজি বিক্রি করেছেন। আরো লক্ষাধিক টাকার শাক-সবজি বিক্রি করতে পারবেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তার উৎপাদিক শাক-সবজি স্থানীয় মাহিলাড়া হাটের পাইকাররা এসে ক্রয় করে নিয়ে যায়।
একইগ্রামের সফল চাষী ফারুক সরদার জানান, ছয় সদস্যর অভাবের পরিবার নিয়ে তিনি কোন একমতে যেমন নুন আনতে পান্তা ফুরাতো এমনই অবস্থায় দিনাতিপাত করছিলেন। এমনই সময় গত দু’বছর পূর্বে তিনি উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলামের পরামর্শে শাক-সবজির চাষাবাদ করে বাম্পার ফলন পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি এ চাষাবাদের মাধ্যমে পরিবার পরিজন নিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দেই বসবাস করছেন। একই গ্রামের সফল চাষী এস্কেন্দার রাঢ়ী, মনির সরদার, জাহাঙ্গীর চোকদার, আবুল বাশার, আল-আমিন সরদার, শহীদ সরদার, খোকন খান, বরকত আলী সরদার, জালাল খলিফা, মোবারক হোসেন হাওলাদার, বাবুল রাঢ়ী, ইউনুস আলী সরদারসহ অনেকেই জানান, তারা উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম সিরাজের পরামর্শে শাক-সবজির চাষবাদ করে বেশ অল্পদিনেই স্বাবলম্ভী হয়েছেন। ওই গ্রামের প্রায় শতাধিক বেকার ও যুবকেরা করল্লা, ধুনিয়াপাতা, ঢেঁড়শ, পাট শাক, ডাটা শাক, কচু, মরিচ, কুমড়াসহ বিভিন্ন শাক-সবজির চাষ করে নিজ গ্রামকে আজ পাল্টে দিয়েছেন। ফলশ্র“তিতে পূর্ব বেজহার গ্রামটি বেশ অল্পদিনেই আজ সবজির গ্রাম হিসেবে সর্বত্র পরিচিতি লাভ করেছে।
উপজেলা উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা (মাহিলাড়া ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত) মোঃ সিরাজুল ইসলাম সিরাজ বলেন, আমি সরকারি দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। মূলত চাষীদের কঠোর পরিশ্রমের কারনেই আজ তারা স্বাবলম্ভী হয়েছেন। তিনি আরো বলেন, চাষীদের শাক ও সবজির ক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকা দমনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার না করে ফেরোমন ট্রাপ (জাদুর ফাঁদ) ব্যবহার করে বেশ উপকারিতা পাওয়া গেছে। সঠিক সময়, সঠিক ভাবে যেকোন চাষাবাদ করলেই বাম্পার ফলন পাওয়া যায় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অপরদিকে আগৈলঝাড়া উপজেলার রতœপুর ইউনিয়নের পশ্চিম মোল্লাপাড়া গ্রামের কালিপদ হালদারের পুত্র অমল হালদার একই গ্রামের চার বিঘা জমির ওপরের মাছের ঘের লিজ নিয়ে শুরু করেন মাছ চাষ। পাশাপাশি মাছের ঘেরের পাড়ে সবজির চাষ শুরু করেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অমলের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। তিনি লিজ নেয়া ওই চার বিঘা জমির ঘেরে মাছ চাষের পাশাপাশি ঘেরের পাড়ে আলু, ঢেঁরশ ও ঘেরের ওপর ঝাঁকা দিয়ে চারিপার্শ্বে লাউ, করল্লা, বরবটি, সিমসহ বিভিন্ন শাকসবজির চাষ করে বাম্পার ফলন পেয়েছেন। প্রতিদিন সে গড়ে ২৫ থেকে ৪০ মন করল্লা ও একদিন পর পর ৮ থেকে ১২ মন ঢেঁরশ বিক্রি করছেন। অমল হালদার জানান, চলতি বছর মাছ ও শাক-সবজিতে দু’লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র সবজি বিক্রি করেছেন সাড়ে তিন লক্ষ টাকার। শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আরো তিন লক্ষ টাকার সবজি বিক্রি করা সম্ভব হবে। অমলের মাছের ঘের ও সবজি খামারে কাজ করে বেকারত্ব ঘুচিয়েছেন ১৫ জন নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা। শুধু অমলই নয়; উপজেলার আস্কর, কাঠিরা, কুয়াতিয়ারপাড়, বাকাল, রাজিহার, বারপাইকা, উজিরপুরের কারফা, বিলগাববাড়ি, ভাউধর, জল্লা, মুন্সিরতালুক, হারতা, জামবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় চলতি মৌসুমে শাকসবজি চাষে আশাতীত ফলন পাওয়ায় ওইসব এলাকার বেকার ও যুবক চাষীরা ক্রমেই এ পেশায় ঝুঁকে পরেছেন। তারা নিজ এলাকার চাহিদা পুরণ করে উৎপাদিত সবজি রপ্তানী করছেন রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়।