মে দিবসের বিশেষ আয়োজন : কি ভাবে শুভেচ্ছা জানাবো তাদের?

বিশেষ সম্পাদকীয় ॥

গোটা দেশটা আজ শোকে স্তব্ধ। রক্তে মাখামাখি। চারিদিকে লাশ আর লাশ! বাতাসে লাশের গন্ধ! হাজারো আহত শ্রমিকের বাঁচার আর্তনাদ। কারো পা নেই; কারো বা হাত। স্বজনদের আহাজারিতে গোটা দেশের মানুষের চোখ ভিজে একাকার। তার পরেও এ বেদনার মাঝে অতীতের ন্যায় এবারও ফিরে এসেছে মে দিবস।

আমাদের শ্রমজীবি মানুষের জন্য এবারের মে দিবসটি কঠিন বেদনা নিয়ে ফিরে এসেছে। মে দিবসের ঠিক এক সপ্তাহ পূর্বে সাভারের রানা প্লাজার ভবন ধ্বসে পড়ে শত শত শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছেন সহস্রাধিক শ্রমিকেরা। রানা প্লাজার দূর্ঘটনাটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। দেশের এমন এক শোকাহত সময়েই শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন হিসেবে ফিরে এসেছে মহান মে দিবস। এই দিনটি বিশ্ব শ্রমিক দিবস নামেও পরিচিত। এ দিনটি আমাদের দেশেও সরকারিভাবে ছুটির দিন। জাতিসংঘও এ দিনটিকে অনুমোদন দিয়েছে। এবারের শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিনে কেমনে কোন মুখে শুভেচ্ছা জানাবো তাদের। ভাবতেই চোখে জ্বল এসে যায়।

১৮৮৪ সনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন, এবং তাদের এ দাবি কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেন ১৮৮৬ সনের ১লা মে। কিন্তু কারখানা মালিকগণ এ দাবি মেনে নেয়নি। বরং ১৮৮৬ সনের ১লা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে আট ঘণ্টা শ্রমদিনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকের ওপর গুলি চালানো হয়। এতে ১১ জন শ্রমিক নিহত হয়। যে দেশে এই মে দিবসের সৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকেরা একতরফা ভাবে দিনটিকে পালন করলেও সরকারিভাবে সেখানে মে দিবস পালিত হয় না! ওখানে যে দিনটিকে লেবার ডে হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয় তা হচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার। কানাডাও দিনটি পালন করে না। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের জাতীয় দিবসগুলো আলাদাভাবে উদ্যাপিত হলেও একমাত্র মে দিবসটিই পৃথিবীর প্রায় সব দেশে সরকারিভাবে পালন করা হয়ে থাকে। মে দিবস আসলেই আমাদের দেশের শ্রমিক ফেডারেশন, শিল্পপতি, গামেন্টস মালিক সবাই মে দিবসে শ্রমিকদেরকে উদ্দেশ্য করে বড় বড় বুলি ছেড়ে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু মে দিবস পার হয়ে গেলে শ্রমিকদের প্রতি তাদের কর্তব্য ও এদিনে তাদের প্রদেয় আপ্তবাণী বেমালুম ভুলে যান। এ তথ্য আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। একজন শ্রমিক মরলো কি বাঁচলো তাতে মালিকদের যেন কিছুই আসে যায় না। একজন মানুষ হিসেবে তাদেরকে গণ্য করা হয় না। তাদের মূল্য কেবল এই কারণে যে, তারা শ্রমশক্তির যোগানদাতা। তাদের ঘামঝড়া কষ্টে তাদের অর্থের পহাড় গড়া। নুন্যতম শ্রমিকদের কথাভাবে না মালিকরা। ওরা যেন তাদের চোখে পশুর মতো।

তারই প্রতিফলন ঘটেছে গত ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজার গার্মেন্টস কর্মীদের ক্ষেত্রেও। গামেন্টর্স মালিকদের ধৃষ্টতার কারনেই রানা প্লাজা ধ্বসে পড়ে শত-শত গার্মেন্ট শ্রমিকেরা অকালেই ঝড়ে গেছেন। এর আগে আশুলিয়া ও তেজগাঁওতে একই ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও অসংখ্য কারখানায় আগুনে পুড়ে সহস্রাধিক শ্রমিকের অকাল মৃত্যু হয়েছে। গত নবেম্বরে আশুলিয়ায় তাজরীন গার্মেন্টসে এবং আদাবরে স্মার্ট গার্মেন্টসে দেড় শতাধিক শ্রমিক আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

দুর্ঘটনা নয়; হত্যাকান্ড ॥ সাভারের রানা প্লাজার ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা নয়; এটি একটি হত্যাকান্ড। সতর্কতা ও বাঁধা নিষেধ অমান্য করে কেবলমাত্র মুনাফার লোভে এ কারখানাগুলো চালু রাখা বড় ধরণের অপরাধ। সেই হিসাবে এই মালিক পক্ষ প্রশাসনের সাথে মিলে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছে। এ দ্বায় হত্যাকারীদেরই নিতে হবে। আমাদের দেশের শ্রমজীবি মানুষগুলোর জীবনে কোনো শুক্র ও শনিবার নেই। দিন আর রাত নেই। আরাম কিংবা বিরাম নেই। মে দিবসের অধিকার তাদের জীবনে কখনোই ফিরে আসে না। যে শ্রমিকেরা তাদের জীবন বাজি রেখে দিন-রাত সমান তালে কাজ করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে; সে সব শ্রমজীবী মানুষের জীবনের চাকা চিরদিনই থাকে পাথরের মতো স্থির, যা কিছুতেই সচল হয়না। আমরা শুধু মে দিবস পালন করি; মিছিল করি, জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেই। শ্রমিকদের দিয়ে যাই বুক ভরা আশ্বাস। এসব বক্তব্য ও বিবৃতীর কতটুকু প্রতিফলন ঘটেছে। এসবই কি মে দিবসের উদ্দেশ্য ছিল? যাদের জন্য মে দিবস তারাই যদি সুফল ভোগ না করলো তাহলে দিবস পালনে স্বার্থকতা কোথায়। মে দিবস স্বার্থক করতে সকলকে সচেতন হতে হবে। তবেই স্বার্থকতা আসবে মহান মে দিবসে। শ্রমিকদের প্রতিদিনকার শ্রমের মাত্রা এবং শ্রমের সঠিক মূল্য নির্ধারন করতে হবে। ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে সময়মত। সর্বোাপরি তাদের জন্য তৈরি করে দিতে হবে নিরাপদ কর্মস্থল। যেখানে অন্তত সাভারের রানা প্লাজা কিংবা তাজিন ফ্যাসনের মত অসংখ্য শ্রমিকদের জীবন দিতে হবে না। আর এটাই এবারের মে দিবসে আমাদের প্রত্যাশা।