বিশেষ প্রতিনিধি ॥ জনতা ব্যাংকের জরিপে সারাদেশের ৬৭৬ জন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার জীবন পর্যালোচনা করে “একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জীবনগাঁথা” নামের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে তেমন কোনো তথ্য না থাকায় জনতা ব্যাংকের উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমে সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে এ গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বরিশালের বীর প্রতীক আব্দুর রহমান জীবিকার তাগিদে জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে গিয়ে বসবাস করতেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়েছে। সেখানকার একটি জরাজীর্ণ কুটিরে অর্থাহারে অনাহারে এখনও বসবাস করছেন তার সন্তানেরা। চুয়াডাঙ্গার মজিবর রহমান, নড়াইলের হাজারী লাল তরফদার (বীর প্রতীক), নবাবগঞ্জের শহীদ আমির হোসেনসহ (বীর প্রতীক) অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধারা কেউ সাপের খেলা দেখান, আবার কারো স্ত্রী মাছের ঘের পাহারা দেন ও কারো মেয়ে কাবিখা প্রকল্পে মাটি কাটার কাজ করে জীবন-যাপন করছেন বলেও প্রকাশিত গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে।
জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত গত ১১ মে বরিশালের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উল্লেখিত তথ্যগুলো তুলে ধরেছেন। এসময় তিনি আরো বলেন, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কিংবা বীর মুক্তিযোদ্ধা অথবা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বার বার তালিকা রদবদল নয়। বরং ১৯৭১ সনে গুটিকয়েক স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর ও আলশামস পরিবারকে বাদ দিলে প্রায় সাত কোটি বাঙ্গালির পরিবার কোনো না কোনো ভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে জড়িত। দুঃখের বিষয়, যারা সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন, স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। আর স্বাধীনতা বিরোধী সেই গুটিকয়েক মৌলবাদী পরিবার বিত্তশালী ও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী মৌলবাদী চক্র বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তাদের অর্থনীতি শক্তিশালী করেছে। তিনি আরো বলেন, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে অনুদান দিয়ে একটি মডেল তৈরি করা হয়েছে। একই সঙ্গে সারাদেশে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের আবেদনের জন্য ইতোমধ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে মুক্তিযোদ্ধা তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনী এই তিন প্রজন্মকে স্বচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার একটি রূপরেখা তৈরি করে দেয়া হয়েছে। জনতা ব্যাংক শুধু অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার একটি নমুনা তৈরি করে দিয়েছে। এ নমুনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা অসচ্ছল পরিবারগুলোকে সচ্ছল করা সম্ভব হবে বলেও ড. আবুল বারকাত উল্লেখ করেন।
খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে জনতা ব্যাংক লিমিটেডের উদ্যোগে গত ১১ মে মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদদের নিয়ে এক নৌ-বিহারের আয়োজন করা হয়। ফলে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার-পরিজন উপভোগ করেছেন ভিন্ন স্বাদের একটি দিন। ওইদিন বেলা ১১টায় জলযান এমভি সুন্দরবন-৭ বরিশাল নৌ-বন্দর থেকে রওয়ানা হয়। কীর্তনখোলা নদীতে অতিথি ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ভেসে বেড়ানো লঞ্চেই অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা সভার প্রধান অতিথি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আনোয়ার হোসেন মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চনার কথা স্বীকার করে বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী চক্র কখনোই বীর বাঙ্গালি মাথা উঁচু করে ভালোভাবে বেঁচে থাকুক তা চায়নি। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত, অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালক এ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার। বক্তব্য রাখেন ড. জামাল উদ্দিন আহম্মেদ-এফসিএ, অতিরিক্ত সচিব মোঃ ইমাদুল হক, বরিশালের জেলা প্রশাসক মোঃ শহীদুল আলম, জনতা ব্যাংকের পরিচালক মোঃ আবু নাসের, সঙ্গীতা আহমেদ, কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের প্রমুখ। সংবর্ধনা সভার সভাপতিত্ব করেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস.এম আমিনুর রহমান। শেষে বরিশাল অঞ্চলের দু’বীরশ্রেষ্ঠ’র পরিবারসহ ৩১ জন খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা স্মারক গ্রন্থ ও ক্রেষ্ট প্রদান করা হয়। সবশেষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গানসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে বিকেল সাড়ে চারটায় অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।