লাইলাতুল কদরের তাৎপর্য

অর্থাৎ লাইলাতুল কদর বা শবেকদরের মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে বেশি। হাজার রাত নয়, হাজার মাস অর্থাৎ ৮৩ বছর চার মাস থেকেও উত্তম এই মহারজনী শবেকদর। ফারসি ভাষায় শব শব্দের অর্থ রাত। আরবি লাইলুন শব্দের অর্থ রাত। কদর শব্দের অর্থ উচ্চ মর্যাদা। শবে কদরে বা লাইলাতুল কদরে সারা রাত জেগে আল্লাহর ইবাদত করলে ৮৩ বছরের ইবাদতের চেয়ে বেশি সওয়াব হবে।


মানুষের প্রতি আল্লাহর যত করুণা ও অনুগ্রহ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত ও অনুগ্রহ হলো বান্দার জন্য এমন একটি মহান রাতকে নির্দিষ্ট করা। যে একটি রাতেই তিনি বান্দাকে হাজার মাসে যতটুকু সওয়াব দেবেন, তার চেয়ে বেশি পুণ্য বা সওয়াব দেবেন। হাজার মাস ৩০ হাজার দিনের সমান। এ রাতে ১ টাকা দান করলে অন্য সময় ৩০ হাজার টাকা দানের সমান হবে।


শবেকদর মর্যাদাসম্পন্ন রজনী। এত বরকতময় হওয়ার কারণ বহু। তার মধ্যে একটি হলো মহাপরাক্রমশালী বিশ্ব প্রতিপালকের মেহেরবানি ও ইচ্ছা। “কুন ফা ইয়াকুন” অর্থাৎ মহাশক্তিশালী আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা-ই হয়। আল্লাহতায়ালা ইচ্ছা করেছেন ৩০ লাখ হ্যাজাক লাইট জ্বালালে যত আলো হবে, একটি নক্ষত্র এই সূর্যের আলো তার চেয়ে লাখো-কোটি গুণ বেশি হবে। আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত বেশি দেবেন, তাই তা হয়। আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন, মরুভূমিতে বৃষ্টিপাত হবে কম, তাই কম হয়। আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন, রাতের বেলা রজনীগন্ধা ফুটবে, তাই ফোটে। আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন, বসন্তকালে হরেক রকমের ফুল বেশি ফুটবে, কোকিল বেশি ডাকবে, তাই সে সময় বেশি ফুল ফোটে, কোকিল ডাকে। আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন, শবেকদরকে বা কদর রাতকে তিনি ৩০ হাজার রাত থেকে বেশি বরকতময় করবেন। আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুগ্রহেই সব কিছু হয়।


শবেকদর বরকতময় হওয়ার আরেকটি কারণ আছে। এ রাতে আল্লাহ কালামে পাক কোরআনুল কারিম নাজিল করেছেন। আল-কোরআন একটি পবিত্র কিতাব। এই কিতাবের মধ্যে আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন এবং মানুষকে তাঁর নির্দেশ জানিয়েছেন। শবেকদরে বা কদর রজনীতে নাজিলকৃত এই কিতাব কোরআনুল কারিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ। আল-কোরআন প্রতিদিন যত কোটি কোটি মানুষ তেলাওয়াত করে, অন্য কোনো কিতাবই ততসংখ্যক কেন, তার এক শতাংশ লোকও প্রতিদিন খোলে না। অন্য কোনো গ্রন্থ প্রতিদিন সকালে তেলাওয়াত করার প্রতিষ্ঠিত রেওয়াজ নেই। কোনো গ্রন্থই অতটুকু নিষ্ঠা, ভক্তি ও আগ্রহের সঙ্গে প্রতিদিন পাঠ করা হয় না।


বিশ্বে দ্বিতীয় এমন কোনো গ্রন্থ নেই, যা কোটি কোটি মানুষ শুধু বুঝে নয়, এমনকি না বুঝেও ভক্তির সঙ্গে পাঠ করে। সারা দুনিয়ায় কি আর একটি কিতাব আছে, যা মানুষ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি অক্ষরও ভুল না করে মুখস্থ রাখতে পারে ? এর আধখানা সাইজের কিতাবও কোটি কোটি মানুষের মধ্যে কোনো স্মৃতি শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি মুখস্থ রাখতে পারে না, অথচ আল হামদুলিল্লাহ ! সারা বিশ্বে কোরআন মুখস্থকারী হাজার হাজার হাফিজ রয়েছেন ! তাঁরা শুধু আরব নন, সুদূর মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বহু দেশের বহু লোক পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে এই কিতাব মুখস্থ করছেন।


আল-কোরআন একটি মহাগ্রন্থ। কবিতা মানুষ মুখস্থ করতে পারে। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ মুখস্থ করা খুবই কষ্টকর, হয়তো সম্ভবও নয়। আল-কোরআন এমন একটি গ্রন্থ, যার ছন্দবিন্যাস এত উন্নত যে এই অদ্বিতীয় মহাকাব্য শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ করা সম্ভব। আরো আশ্চর্য যে একটি শব্দ না বুঝেও এই মহাগ্রন্থ মুখস্থ করা সম্ভব।


দু’শ বছর আগেকার বাংলা কাব্য বা গ্রন্থ বিনা সম্পাদনায় বিশ শতকে পাঠোপযোগী নয়। কিন্তু ১৪০০ বছর আগের আরবি কোরআনের ভাষা ও ছন্দ আজও জীবন্ত ও অপরিবর্তনীয়। দুনিয়ায় এমন দ্বিতীয় কোনো গ্রন্থ নেই, যার কোনো সম্পাদনা বা পরিবর্তন প্রয়োজন হয় না। বহু ধর্মগ্রন্থ যুগে যুগে সংশোধিত হয়। এত পরিবর্তন, সংশোধন ও আধুনিকীকরণ দরকার হয় যে আদিতে এ গ্রন্থের কী রূপ ছিল, কী ছিল তার ভাষা, তাও খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু আল-কোরআন এমন একটি গ্রন্থ, যার একটি শব্দ বা অক্ষরও সম্পাদনা বা পরিবর্তনের প্রয়োজন কখনো হয়নি বা কিয়ামত পর্যন্ত হবে না। এই যে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। যা নাজিল হলো কদর রাতে বা শবেকদরে, এর প্রথম বাণী কী ছিল ? আমাদের রাসুল (সা.)-এর মাধ্যমে মানুষের কাছে প্রেরিত আল্লাহর প্রথম শব্দ ও নির্দেশ হলো “’ইকরা” পাঠ করো, পড়ো। শুধু পড়ো নয়, পড়ো’ তোমার প্রতিপালকের নামে “আল্লাজি আল্লামা বিল কালাম” যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। কলমের সাহায্যে শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে সাক্ষরতার প্রশ্নটি এসে যায়। এ বরকতময় মহারজনীতে আমরা আল্লাহকে সিজদা করি। কিন্তু মানুষের প্রতি আল্লাহর প্রথম নির্দেশ “উসজুদ” অর্থাৎ সিজদা করো। বা উরকুউ অর্থাৎ রুকু করো। সিজদা ও রুকু সর্বোত্তম কাজ। কিন্তু অজুর আগে নয়। ইবাদতের হুকুমের আগে আল্লাহ হুকুম দিয়েছেন “ইকরা” পাঠ করো। কিন্তু আমাদের এ পবিত্র মাতৃভূমির প্রায় ৯ কোটি মানুষের মধ্যে পাঁচ কোটির বেশি মানুষই নিরক্ষর।


আমরা আল্লাহর প্রথম হুকুমই বরখেলাপ করছি। তার পরিণতিতে বিরাজ করছে সর্বগ্রাসী দারিদ্র্য ও অনটন। অথচ আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে রাসুল (সা.) বলেছেন, “দারিদ্র্য মানুষকে কুফরের পথে টেনে নিয়ে যায়” দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। যে ব্যক্তি দেশকে ভালোবাসে না, সে ইমানদার হতে পারে না। যে ব্যক্তি দেশকে ভালোবাসে না, দেশের সমস্যা সমাধানে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসে না, তার মৃত্যু বেইমানের মৃত্যু। পবিত্র শবেকদরে রাব্বুল আলামিনের কাছে আমাদের এই ওয়াদা করা কর্তব্য যে আল্লাহর সর্বপ্রথম নির্দেশ, “ইকরা” আমরা পালন করবো। আমাদের প্রাণপ্রিয় পবিত্র মাতৃভূমি বাংলাদেশের মাটি থেকে নিরক্ষতার অভিশাপ দূর করব। আমরা অবশ্যই নামাজ পড়ব, রোজা রাখব, যাকাত দেব ; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর সর্বপ্রথম নির্দেশ “ইকরা” পাঠ করে নির্দেশ পালনকারী অনুগত বান্দা হওয়ার শপথ নেব। বাংলাদেশের তথা মুসলিম বিশ্বের কোটি কোটি কণ্ঠে আজ ধ্বনিত হোক মানবতার প্রতি আল্লাহর প্রথম নির্দেশ “ইকরা”। আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হোকথ “ইকরা” পাঠ করো, পাঠ করো। হিজরি পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমাংশেই সম্পূর্ণ মুছে যাক বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ললাট থেকে নিরক্ষরতার গ্লানি ও কালিমা। হে রাব্বুল আলামিন, মহাপবিত্র শবেকদরে আমাদের এই মোনাজাত তুমি কবুল করো।