সারাদেশে অ্যানথ্রাক্স সতর্কতাঃ যা জানা দরকার

সতর্কতা জারি করেছে এবং দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য সকল পর্যায়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দিয়েছে।

অ্যানথ্রাক্স ৩ রকমের – শ্বাস-প্রশ্বাস সংশ্লিষ্ট (pulmonary), গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল (gastrointestinal) ও স্পর্শ সংশ্লিষ্ট (cutaneous)। শ্বাস-প্রশ্বাস সংশ্লিষ্ট অ্যানথ্রাক্স রোগই মূলতঃ বেশি আলোচিত হয় যা সবচেয়ে মারাত্মক, প্রাণঘাতীও বটে। ১৮৭৭ সালে ডা. রবার্ট কোচ (Robert Koch) সর্বপ্রথম প্রমান করেন যে, Bacillus anthracis জীবানুই এই রোগের কারণ।

অ্যানথ্রাক্স প্রকৃতপক্ষে পশুপাখীর রোগ, একার্থে এই রোগ বন্যপ্রাণীদেহকেই বেছে নেয়, মানুষকে নয়। আক্রান্ত প্রাণীকুলের মধ্যে ভেড়া, গরু-বাছুর, ঘোড়া, ছাগল প্রভৃতি। একটা সময় পর্যন্ত প্রাণীজাত দুষিত বস্তু নিয়ে কাজ-কর্ম বা নাড়াচাড়া করা, যেমন: পশুর চামড়া, চুল বা লোম, রক্ত ও রোগাক্রান্ত পশুবিষ্ঠা ইত্যাদি মানবদেহে এ রোগ ছড়াবার প্রধান কারণ হিসেবে গণ্য।

ব্যাকটেরিয়া
anthrax_bacteriaঅ্যানথ্রাক্স রোগের জন্য যে ব্যাকটেরিয়া দায়ী তার নাম ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাকিস (anthracis), একটি গ্রাম-পজিটিভ, ক্যাপস্যুল-সদৃশ ব্যাকটেরিয়া যা spore (৩ মাইক্রন আকৃতি বিশিষ্ট যে বীজানু বা রেনুর সাহায্যে শেওলাজাতীয় অপুষ্পক উদ্ভিদ বংশবিস্তার করে, মানুষের মাথার চুল ২৫ মাইক্রন) পয়দা করে। Cutaneous অ্যানথ্রাক্সের আক্রমন ঘটে যখন কোনো ক্ষতস্থান বা ছিলে-যাওয়া স্থানে spore বা bacteria সরাসরি সংষ্পর্শে আসে। প্রায় সমুদয় ক্ষেত্রেই ৪৮ ঘন্টার মধ্যে লক্ষণ প্রকাশিত হয়, যদিও ২-৭ দিনের মধ্যেও এটি হতে দেখা যায়।

অবয়ব
মানব দেহে অ্যানথ্রাক্স প্রবেশ করলে এবং তা খাদ্যদ্রব্যের সাথে কিংবা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে আক্রান্ত হলে উচ্চজ্বর, প্রলাপ, কথাবার্তায় জড়তা, শ্বাসপ্রশ্বাসে কষ্ট, খিচুনি দেখা দেয় ও অতঃপর মৃত্যু ঘটে। পশুপ্রাণীর ক্ষেত্রে গলা ও ঘাড় ফুলে ওঠা, দমবন্ধভাব পরিলক্ষিত হয়। Cutaneous anthrax-এর ক্ষেত্রে আক্রান্ত স্থানে হঠাৎ করেই ক্ষূদ্রাকৃতির, লালবর্ণ, চুলকানিযুক্ত স্ফোটক উৎপন্ন করে। দু’এক দিনের মধ্যে স্ফোটকের মধ্যে পানি বা রস জমে ফোস্কায় পরিণত হয় এবং সামান্য ঘর্ষণেই বিদীর্ণ হয়। ক্ষতস্থান শুকিয়ে কয়লার মত দেখতে কালো রঙ ধারণ করে এবং মামড়ি বা চটা পড়ে ক্ষতটি ঢেকে যায়। এভাবেই গ্রিক শব্দ anthrax থেকে বাংলায় কয়লা আর ইংরেজিতে coal শব্দের উৎপত্তি।

মূলসূত্র
মানব দেহে রক্তস্রোতে রোগের ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ার দরুন বিষাক্ততা এবং অচিকিৎসিত কাটেনিয়াস অ্যানথ্রাক্স রোগজনিত মৃত্যুহার ২০%। তবে সুচিকিৎসিত হলে এই রোগ মাত্র ১% রোগীর ক্ষেত্রে মারাত্মক হিসেবে গণ্য হয়। চিকিৎসার পরও আক্রান্ত স্থানের মৃতকোষগুলি বিকশিত অবস্থায় থেকে যেতে পারে।

চিকিৎসা
অধিকতর প্রাণঘাতী inhalational anthrax এর তুলনায় Cutaneous anthrax অপেক্ষাকৃত কম ঝুকিপুর্ণ হলেও শুধুমাত্র antibiotics প্রয়োগের মাধ্যমেই এর চিকিৎসা সম্ভব। প্রথম ধাপের চিকিৎসা বলতে ciprofloxacin বা doxycycline ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য অনুমোদিত antibiotics-এর মধ্যে erythromycin এবং penicillin-এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
তবে প্রথমতঃ ciprofloxacin-ই এরোগের সবচেয়ে কার্যকর ঔষধ হিসেবে গণ্য যার শুভফল দেখা যাবে ৭২ ঘন্টার মধ্যেই। এসময়ের মধ্যে রোগের নমুনা কালচার করে সুনির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া শণাক্ত করার পর রোগীদেহে এন্টিবায়োটিকের স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে সম্মক উপলব্ধির পর প্রয়োজনীয় ঔষধের কোর্স নির্ধারণ করা হয়। এই কোর্স ১০-১৪ দিন কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ৬০ দিনও হতে পারে।

ভ্যাক্সিন
উন্নয়ণশীল বায়োসলিউশন (Emergent BioSolutions) হিসেবে “BioThrax AVA” ও “BioThrax IM” উর্দ্ধবাহুর পেশীতে ইনজেকশন আকারে ০-৪ সপ্তাহব্যাপী, ৬, ১২ ও ১৮ মাসে ৩ বারে সমাপ্য; ক্রমোন্নতিসূচক বাৎসরিক ফলো-আপ প্রযোজ্য। গর্ভকালীন সময়ে এই ভ্যাক্সিন প্রয়োগ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দেয়। অ্যানথ্রাক্স রোগের ভ্যাক্সিন সচরাচর সহজপ্রাপ্য নয়। তাছাড়া কোন ধরনের মানুষজন এ ভ্যাক্সিন গ্রহনের জন্য উপযুক্ত তা অদ্যাবধি শণাক্ত বা নির্ধারণ করাও সম্ভব হয়নি। কাজেই এসব নিয়ে ডাক্তার বা স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীদের মধ্যে সার্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখনো চলছে। ১৮৮১ সালে Louis Pasteur, Jean Joseph Henri Toussaint ও William S. Greenfield নামক তিনজন স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী স্বতন্ত্রভাবে অ্যানথ্রাক্স রোগের ভ্যাক্সিন আবিস্কার করেন।

সতর্কতা
১০০ ডিগ্রী তাপমাত্রায় কমপক্ষে ৩০ মিনিটকাল কোনোকিছু সিদ্ধ করলে অ্যানথ্রাক্স জীবানু সম্পুর্ণরূপে ধ্বংস হয়। এছাড়া steam sterilization ও সরাসরি আগুনে ভস্মিভুত করলে অ্যানথ্রাক্সের অস্তিত্ব থাকে না। Microwave woven-এ রান্না করা খাবার-দাবার অ্যানথ্রাক্সমুক্ত ভাবা হয়।

ফিরে দেখা
gruinard_iland ১৯৭৯ সালের এপ্রিল-মে মাসে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত স্ভার্দলোভস্ক শহরের অধিবাসীদের মধ্যে সর্বপ্রথম অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সে সময় মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রাদুর্ভাবকে সোভিয়েত ইউনিয়নের মওজুদকৃত জীবানু অস্ত্রের ‘লিকেজ’ বা সংরক্ষণের আনাড়িপনা হিসেবে প্রচার করে।

জীবানু অস্ত্র হিসেবে ‘অ্যানথ্রাক্স’
সম্ভবতঃ অদ্যাবধি আবিস্কৃত জীবানু অস্ত্রের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স বোমা হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক biological weapon বা জীবানুঘটিত মারণাস্ত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশরা সর্বপ্রথম এই বোমা আবিস্কার করে এবং তা স্কটল্যাণ্ডের গ্রুইনার্ড দ্বীপে পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়। পরীক্ষার ৫০ বছর পর্যন্ত ওই এলাকা মানুষ ও প্রাণীকূলের জন্য নিষিদ্ধ থাকে। ধারণা করা হয় দ্বীপটি এখন পর্যন্ত আগের মতই বিপদজনক অবস্থায় রয়ে গেছে। তবে পৃথিবীতে কোনও যুদ্ধে এ ধরনের বোমা এখন পর্যন্ত ব্যবহার হয়নি।

২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিঠির খামের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স জীবানু ভরে ব্রুস আইভিন্স নামক জনৈক বিজ্ঞানী নিজের দেশেই এক হামলা চালান। ওই হামলায় পাঁচ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছিলেন। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন আরও ১৭ জন। ওই ঘটনার পর পৃথিবীজুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তবে ২০০৮ সালে ব্রুস আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার আগে অ্যানথ্রাক্স হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ব্রুস।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন জনগণ যখন মানসিকভাবে বিচলিত, তখন অ্যানথ্যাক্সভর্তি ওই খামগুলো আইনপ্রণেতা ও প্রখ্যাত সাংবাদিকসহ বিভিন্ন কার্যালয়ে পাঠানো হয়। ওই ঘটনার পর তল্লাশির জন্য ডাক বিভাগের কার্যালয়, ইউএস ক্যাপিটাল ভবন ও বেশ কিছু বেসরকারি কার্যালয় সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ পরিস্থিতি: ২০১০
anthrax_bdসিরাজগঞ্জে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ১৯৬, কুষ্টিয়ায় ৩৬ জন
সিরাজগঞ্জে অ্যানথ্রাক্স-আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত শুক্রবার পর্যন্ত জেলার বেলকুচি উপজেলায় একজন ও কামারখন্দে আরও পাঁচজন রোগীর সন্ধান মিলেছে। সব মিলে সিরাজগঞ্জে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১৯৬। এদিকে অবস্থার অবনতি হওয়ায় দুজন রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় ১৯টি গরু ও তিনটি ছাগল এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে বলে নিশ্চিত করেছে।

কুষ্টিয়া
কুষ্টিয়ায় অ্যানথ্রাক্স-আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আশরাফ আলী। গত তিন দিনে কুষ্টিয়ায় দৌলতপুর উপজেলায় ৩৬ জন অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়েছে।

পাবনায় আরও চারজন রোগী শনাক্ত
গত বুধবার পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ছোট পাথাইল হাটগ্রামে অ্যানথ্রাক্স জীবাণুতে আক্রান্ত আরও চারজন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। ওই এলাকায় কর্মরত উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষ দল বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এই চার রোগীসহ অ্যানথ্রাক্স জীবাণুতে আক্রান্তের সংখ্যা এখন ৩২ বলে তাঁরা জানান। আক্রান্ত রোগীরা হলো চুমকি খাতুন (৪), লাবলী খাতুন (৮), আব্দুল বারী (৪২) ও হোসেন আলী (৫৫)।
এ ব্যাপারে পাবনার সিভিল সার্জন এ এইচ এম খাইরুল আলম চৌধুরী বলেন, এব্যাপারে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ ও টিকা দেওয়া হচ্ছে।
উপজেলা পশু কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান জানান, ওই এলাকায় তাঁরা এ পর্যন্ত ৪৪৯টি গরুকে অ্যানথ্রাক্স টিকা দিয়েছেন। গত ২৬ জুলাই সাঁথিয়ার ছোট পাথাইল গ্রামে একটি গরু অসুস্থ হয়ে পড়লে সেটিকে জবাই করা হয়। সেই গরুর মাংস খেয়ে ওই এলাকার ২৮ জন অ্যানথ্রাক্স জীবাণুতে আক্রান্ত হয়।

পাবনায় পাঁচজন অ্যানথ্রাক্স রোগী শনাক্ত
গত সোমবার পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার নাগডেমরা ইউনিয়নের বড়পাথাইলহাট গ্রামে নতুন করে আরও পাঁচজন অ্যানথ্রাক্স রোগী শনাক্ত হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের একটি দল এ নতুন পাঁচজনকে শনাক্ত করে।
তাঁরা হলেন—রেনু খাতুন (২৫), আবদুস সালাম (৩৫), যমুনা খাতুন (২৬), আবু সরকার (৭৫) ও তানিয়া খাতুন (৮)। এ নিয়ে সেখানে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ২৪ জনে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা মনসুর রহমান জানান, তাঁর নেতৃত্বে একটি পরিদর্শন দল এলাকায় সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করছে। দলটি আজ এ নতুন পাঁচ রোগীকে শনাক্ত করে।
গতকাল রোববার থেকে সাঁথিয়া উপজেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগ অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গ্রামটিসহ আশপাশের চার-পাঁচটি গ্রামে গরু ও ছাগলকে অ্যানথ্রাক্সের ভ্যাক্সিন দিতে শুরু করেছে এবং আক্রান্ত এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, অ্যানথ্রাক্স রোগে বাংলাদেশে এপর্যন্ত কোনো মৃত্যূর খবর পাওয়া যায়নি।
আরো খবর –BBC AFP

 


 

লিখেছেন : মুক্তিযোদ্ধা৭১ | Source : আমার ব্লগ