সশস্ত্র বাহিনীবিহীন দেশের নিরাপত্তা : হাইতি

যার নাম ‘গণতন্ত্র’। শুধু একেক দেশে পাত্রপাত্রীর পোশাক ও মঞ্চ সজ্জার স্বাতন্ত্র্যে নাটকের পুনরাবৃত্তি সহজে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু চিত্রনাট্যটি খেয়াল করলে একটি সহজ-সরল সমীকরণ পাওয়া যাবে। প্রথমে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক তথাকথিত জনদরদী সংস্থাগুলো একটি দেশকে জানাবে যে উন্নয়ন দর্শনে তার দেশ চলছে সেটি তার জন্য অনুকূল নয়। সুতরাং তার কাছে যে স্বপ্নে পাওয়া অব্যর্থ ওষুধ আছে সেটি প্রয়োগের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ওষুধটি কেনাও খুব সহজ। ডাক্তারের কাছ থেকে আপাতত টাকা ধার নিয়ে সুস্থ হয়ে খেটেখুটে টাকাটা শোধ করে দিলেই হয়। তবে শর্ত শুধু একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য ডাক্তার দায়ী নয় এবং সুস্থ হতে চাইলে আরো ডোজ চালিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় প্রতিবাদকারীর কপালে একটি পদবি জুটবে। যেমন ধরা যাক স্বৈরশাসক, মৌলবাদী কিংবা দানব। কোনোভাবেই যদি তাকে এসব খেতাব না দেয়া যায়, তখন তার দেশে তার প্রশ্রয়ে কিংবা অমনোযোগে বিশ্বধ্বংসী তৎপরতা চলবে। এ সময় ডাক্তারের সমর্থনে সে দেশের ভেতর থেকেই এগিয়ে আসবে ‘সুশীল সমাজ’ বা ‘বুদ্ধিজীবী’ নামের মোড়কে কিছু চরিত্র। তাদের সাথে থাকবে সরকারবিরোধী কিছু দল। শেষে সবাই মিলেমিশে দানবের ঘাড় মটকে তাকে হত্যা করার মাধ্যমে নাটকের যবনিকাপাত টানবে। হাইতিতে এই নাটকের পুনঃপ্রচার বলতে গেলে চলছে ঊনবিংশ শতক ধরে।

মার্কিন সরকার কখনোই চায়নি হাইতি স্বাধীন হোক:
মার্কিন সরকার ফরাসি উপনিবেশের পতনের পর ১৮০৪ সাল থেকে কখনোই চায়নি হাইতি স্বাধীন হোক। গত শতকজুড়ে হাইতিকে সে অবমাননাকর মর্যাদা দিয়ে চলেছে। ১৯১৫ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত মার্কিন বাহিনী সরাসরি হাইতি দখল করে রাখে। এর মধ্য দিয়ে চার্লসেনের কাকোশ বিদ্রোহ (১৯১৯) দমন করে। ১৯৫৭ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সেবাদাস একনায়ক দুভালিয়ারকে শর্তহীন সমর্থন জুগিয়ে যায়। এ সময়ে হাইতি তার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে স্বকীয়তা হারিয়ে দারিদ্যপীড়িত ও দুর্দশাগ্রস্ত দেশে পরিণত হয়।

হাইতি এক সময়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। ছিল বিপুল বনজ সম্পদ। দুভালিয়ারের ৩০ বছরের শাসনামলে হাইতির কৃষি খাত ধ্বংস করা হয়। এ সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্যশস্য আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বিলুপ্ত হয় হাইতির কৃষক ও ব্যবসায়ীদের স্বাধীন সত্তা। ভূমিহীন ও পেশাচ্যুত হয়ে তারা পাড়ি জমায় শহরে। ঘনবসতিপূর্ণ বস্তিতে উদ্বাস্তু ও বেকার জীবন বেছে নিতে হয়। রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের লোকসংখ্যা হয় দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। দুর্বল ভিত ও কাঠামোর ওপর নির্মিত বাসগৃহে বসবাসকারী এসব দরিদ্রই গত ১২ জানুয়ারির ভূমিকম্পের শিকার হয়েছে বেশি।

পাহাড় কেটে পুরো হাইতির ভূ-পরিবেশের পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে:
হাইতির ২৩৯ বছরের ইতিহাসে ভূমিকম্পের কোনো ঘটনা নেই। তারা জানে না ভূমিকম্প হলে কিভাবে ঘরের বাইরে আশ্রয় নিতে হয়। এ জন্যই ভূমিকম্পের সময় দৌড়ে ঘরের ভেতরে আশ্রয় নিতে গিয়ে মারা পড়েছে বেশির ভাগ মানুষ। এক দিকে বন কেটে পাহাড় ন্যাড়া করা এবং অন্য দিকে খনিজসম্পদ আহরণে পাহাড় কেটে পুরো হাইতির ভূ-পরিবেশেরই পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে। কৃষি ভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া শহরের বস্তিবাসী পেশাচ্যুত কৃষকদের নিয়ে ধর্মযাজক এরিস্টিড ‘লাভালাস’ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন এসব বস্তি থেকেই। লাভালাস আসলে অনেকটা নয়া কৃষি আন্দোলনের মতোই। উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের মুক্ত স্বাধীন করে হাইতিকে পুনর্বার সবুজ করা। এরিস্টিড এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং এরই কাফফারা হিসেবে দু’বার ক্ষমতাচ্যুত হন মার্কিন মদদে। একবার তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন ১৯৯১ সালে এবং দ্বিতীয়বার ২০০৪ সালে। প্রথমবার সিনিয়র বুশ এবং দ্বিতীয়বার জুনিয়র বুশের আমলে। ১৯৯৪ সালে এরিস্টিডকে আবার ক্ষমতায় বসাতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। বাধ্য হয়েছিলেন কংগ্রেসের অশ্বেতাঙ্গ ককাসের চাপে। তবে সাথে দিয়েছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনী। সেই সাথে এরিস্টিডকে তার প্রিয় লাভালাস আন্দোলন বাদ দিয়ে নয়া উদারবাদ এজেন্ডা চালুর শর্ত দিতে হয়। হাইতিবাসী এর নাম দেন ‘মৃত্যুর পরিকল্পনা’। কিন্তু তারপরও জুনিয়র বুশের আমলে ‘রেজিম চেঞ্জের’ তত্ত্বে তারাই তাকে ক্ষমতাচ্যুত ও অপহরণ করে। এরিস্টিড এখন দক্ষিণ আফ্রিকায় ফেরারি জীবনযাপন করছেন।

হাইতির ভূ-কৌশলগত অবস্থান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ:
কৃষি ছাড়াও হাইতি খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ এক দেশ। এর রয়েছে তেল, গ্যাস, সোনা, ইরিডিয়াম, ইউরেনিয়াম, তামা, লোহার বিশাল মজুদ। এর বাইরে হাইতির ভূ-কৌশলগত অবস্থানও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিম গোলার্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘরের দুয়ারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ কিউবা ও ভেনিজুয়েলার মাঝে হাইতির অবস্থান। এর গভীর সমুদ্রবন্দর এবং এখানে যুগপৎ মেরিন ও সেনাঘাঁটি এক সাথে দু’টি লক্ষ্য অর্জনে সম্ভব করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। এক দিকে কিউবা ও ভেনিজুয়েলার নেতৃত্বে দক্ষিণ আমেরিকার নবউত্থান মোকাবেলা করা এবং অন্য দিকে নিজের ঘর সামলানো।
হাইতির আইনজীবী মানবাধিকার কর্মী, লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মী মার্গুয়েরাইট লরেন্ট ওরফে এজিলি দান্তো তার ‘অয়েল ইন হাইতি’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, তেল ও গ্যাসের ওপর ভাসছে হাইতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ তেল ও গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে কয়েক দশক আগেই। ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বড় ধরনের ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণেই সে এই সঞ্চিত ভাণ্ডারে হাত দিচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ শুকিয়ে আসার অপেক্ষাই সম্ভবত সে করছে। এই তেলের ওপর ভর করে মার্কিনি বড় বড় তেল কোম্পানি এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রতিরক্ষা ঠিকাদারি কোম্পানিগুলোও কয়েক দশক আগেই হাইতির গভীর সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের ছক এঁকে রেখেছে। তারা আরো পরিকল্পনা করেছে যে, এখানে তারা তেল শোধনাগার ও অপরিশোধিত তেলের রিজার্ভ ট্যাঙ্ক গড়ে তুলবে। উদ্দেশ্য এখানে অপরিশোধিত তেল সঞ্চিত করে তা শোধনের পর ছোট ছোট ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহ করা। হাইতির ফোর্ট লিবাট্রের ডুন প্লান্টেশন পরিকল্পনায় এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। তেল শোধনাগার পরিবেশ দূষণের বড় একটি কারণ। পরিবেশ দূষণের তথা বিশ্ব উষ্ণায়নের দায় এড়াতে নিজ ভূখণ্ডের বাইরে হাইতিতে সে তা স্থাপন করছে। অন্য দিকে এসব স্থাপনার নিরাপত্তার অজুহাতে সেনা মোতায়েন জায়েজ করছে।

ভূমিকম্প হাইতির জন্য বড় এক পেরেক:
যে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর নামে হাইতিতে মার্কিন সরকার সৈন্যদের হাতে অস্ত্র ও ‘প্রয়োজনে’ হাইতির জনগণের ওপর তা প্রয়োগের অধিকার দিয়ে পাঠিয়েছে সেই ত্রাণসামগ্রী বিশৃঙ্খলভাবে প্লেন থেকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে বেপরোয়া, অভুক্ত মানুষগুলোর ওপর। তাদের কাড়াকাড়ির ছবি মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে ‘অসংহত’ ও ‘বিপজ্জনক’ হাইতিতে অস্ত্রধারী সৈন্য পাঠানোর বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা চলছে। হাইতিতে জরুরি সহায়তা নিয়ে যেতে মার্কিন বিমানের সময় লেগেছে তিন দিন। অথচ চীন ভূমিকম্পের দুই ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসক টিম নিয়ে হাইতির উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। কিউবা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসক দল পাঠিয়েছে। ভেনিজুয়েলা বিদ্যুতের জন্য যে পরিমাণ জ্বালানি লাগে তা সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাঠিয়েছে অস্ত্র। সাহায্যের মুখোশে আমেরিকার সত্যিকার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ফ্রান্স, নিকারাগুয়া ও ভেনেজুয়েলা। প্যারিস জাতিসঙ্ঘের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য অনুসন্ধানের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ বলেছেন ‘যুক্তরাষ্ট্র হাইতির এই মানবিক দুর্যোগের সুযোগে হাইতি দখলে করতে এসেছে।’ শ্যাভেজ শত্রুর মুখে চুনকালি দিতে এমন বিশ্রী মন্তব্য করতেই পারেন। কিন্তু হাইতির ইতিহাসের পাতায় পাতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্তাক্ত হাতের যে ছাপ সেটি মুছে ফেলা সম্ভব নয় বলেই হাইতির জন্য আজকের ওবামা প্রশাসনের চোখের জল কুম্ভীরাশ্রু বলে ধরে নিতে কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয়।

হাইতির ভূমিকম্প মানবসৃষ্ট বলে দাবি:
সম্প্রতি হাইতিতে ঘটে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প মানবসৃষ্ট বলে অভিযোগ করে আসছেন অনেকে। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ ভূমিকম্পের জন্য দায়ী করেছেন আমেরিকাকে। তার মতে, আমেরিকা টেকটোনিক অস্ত্রের সাহায্যে হাইতিতে ওই প্রলয় ঘটিয়েছে। শ্যাভেজ অভিযোগ করেন, আমেরিকা হাইতিতে টেকটোনিক ওইপন বা ভূমিকম্প অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। ওই পরীক্ষার ফলে হাইতির পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে সৃষ্টি হয় রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার ভূমিকম্প। শ্যাভেজ বলেন, এই বিধ্বংসী অস্ত্র এর আগে মার্কিন সেনাবাহিনী ইরানের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করে। ফলে সেখানেও ভয়াবহ ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। শ্যাভেজ বলেন, এই অস্ত্র দূরবর্তী কোনো স্থানের পরিবেশের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। পরিবেশকে ধ্বংস করে দিতে পারে। শক্তিশালী ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ সৃষ্টির মাধ্যমে ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে বা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটাতে পারে। শ্যাভেজ বলেন, হারপ বা হাই ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাকটিভ অরাল রিসার্চ কর্মসূচির আওতায় অস্ত্রটি তৈরি করা হয়েছে। ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই কর্মসূচি শুরু হয়। পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিধায় সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম কোহেনও এর বিরোধিতা করেছিলেন। শ্যাভেজ আমেরিকাকে এই ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প অস্ত্র প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ঈশ্বরের সাথে খেলা ভালো নয়। এ খেলা বন্ধ করুন। এর আগে শ্যাভেজ অভিযোগ করেন, ভূমিকম্পের অজুহাতে আমেরিকা হাইতি দখলের পাঁয়তারা করছে।

১৯১৫ সালে মার্কিন নৌবাহিনী দ্বীপদেশটি দখল করে নিয়েছিল:
ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র হাইতিতে গত ১২ জানুয়ারির আঘাত হানা ভয়াবহ ভূমিকম্পে অন্তত দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আড়াই লাখ মানুষ আহত হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপকহারে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে ৩০ লাখের মতো মানুষ। রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট প্রাসাদটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে বিমানবন্দর ও নৌবন্দরের মতো বড় বড় স্থাপনা। স্মরণকালের এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের জন্য কেবল প্রকৃতিকে দায়ী করা চলে না। এর জন্য প্রধানত দায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেশটির গত ১০০ বছরের সম্পর্ক। ১৯১৫ সালে মার্কিন নৌবাহিনী প্রথম এই দ্বীপদেশটি দখল করে নেয়। পরবর্তী ২০ বছর ধরে সেখানে নিজেদের আধা ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম রাখে। এরপর পরবর্তী তিন দশক তারা সেখানে দুবেলীয়র একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন জুুগিয়ে যায়। আশি ও নব্বই দশকে ওয়াশিংটন দেশটিতে মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাপকহারে বেসরকারিকরণে উৎসাহ জোগায় এবং কৃষি খাতকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে ভয়ানক দারিদ্র্য দেখা দেয়ায় গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র কৃষকরা বিপুল সংখ্যায় রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সে ভিড় জমাতে শুরু করে।
মার্কিন নৌসেনা উপস্থিতির পাশাপাশি ওয়াশিংটন হাইতিকে এ পর্যন্ত যে ঋণ দিয়েছে তার বড় একটা অংশই দেশটির দুর্নীতিবাজ শাসকগোষ্ঠীর পকেটস্থ হয়েছে। ঋণের বাদবাকি অংশে মার্কিন তত্ত্বাবধানে যেসব নিম্নমানের অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল তার বেশির ভাগই গত ১২ জানুয়ারির সাত মাত্রার ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়েছে। হাইতিবাসীর দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এই দেশটিতে পুনর্গঠন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও তথাকথিত মানবিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের নামে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে আবার নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে বেশি বেশি নৌসেনার সমাবেশ ঘটাতে শুরু করেছে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে নিজের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন নতুন ব্যবসারই শুধু সুযোগ তৈরি করছে না, নিরাপত্তার নামে তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার ত্রাণ কার্যক্রমের পথেও বাধা সৃষ্টি করছে। এসব অভিযোগ ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা, কিউবা, ইরানসহ অনেক দেশের।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে সামরিক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র:
হেরিটেজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে জিম রবার্টস্ বলেছেন, ভূমিকম্প বিধ্বস্ত হাইতিতে যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সাহায্য প্রদানের বাইরেও সে দেশের দীর্ঘদিনের সরকারি অব্যবস্থাপনা এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূর করার কাজে যুক্ত হতে চায়। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সে ওই অঞ্চলে নিজের ভাবমূর্তিকেও উজ্জ্বল করতে চায়। কারণ দীর্ঘদিন ধরে ওই অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কোনো কার্যকর রাজনৈতিক প্রভাব নেই।
ভূমিকম্প-পরবর্তী হাইতিতে আমেরিকার উপকূলীয়রক্ষীরা সমুদ্র উপকূলের সীমান্তে কড়া নজরদারি শুরু করে, যাতে হাইতির কোনো নাগরিক পালিয়ে যেতে না পারে। আহত কিংবা দুর্গতদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ, খাদ্য ও পানির যে অভাব রয়েছে ব্যাপারটা তা নয়। আসল সমস্যা হলো সঠিকভাবে ও দ্রুততার সাথে ত্রাণ কার্যক্রম চালানো। এ ক্ষেত্রে মার্কিন সেনাদের অসহযোগিতাই প্রধান বাধা। ভাবতে অনেকেরই অবাক লাগবে যে, এই মার্কিন সেনাবাহিনীই হাজার হাজার মাইল দূরের ইরাকে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে আড়াই লাখের মতো সৈন্য পাঠিয়ে বাগদাদ দখল করে নিয়েছিল। অথচ মূল মার্কিন ভূখণ্ডের মাত্র ৭০০ মাইল দূরে আহত ও দুর্গত লাখ লাখ হাইতিবাসী খাদ্য এবং চিকিৎসার অভাবে কাতরাচ্ছে, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে শত শত। অথচ সেখানে দেখেও না দেখার ভান করে মার্কিন ও জাতিসঙ্ঘ কর্মকর্তারা বলেছিল উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার আর দরকার নেই।
এ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, হাইতিতে মার্কিন উপস্থিতির উদ্দেশ্য মানুষের জীবন বাঁচানো নয়। তাদের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে সেখানে আরো বেশি মাত্রায় মার্কিন সামরিক দখলদারিত্ব কায়েম করে ত্রাণ ও পুনর্গঠনের নামে বাণিজ্য করা। তা না হলে সৈন্যসহ অন্যান্য রসদ সামগ্রী নামিয়ে দিয়ে মার্কিন পরিবহন বিমানগুলো খালি অবস্থায় ফেরত যেত না। তারা সেসব বিমানে করে চিকিৎসার জন্য বহু আহত হাইতিবাসীকে নিয়ে যেতে পারত। পোর্ট-অ-প্রিন্সে নিয়োজিত জাতিসঙ্ঘ শান্তি রক্ষীবাহিনীর ব্রাজিলীয় কর্মকর্তা এবং ফ্রান্স সরকার মার্কিন সেনাদের আচরণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগও জানিয়েছেন ওয়াশিংটনের কাছে। ফরাসি সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী আ্যলেইন জাঁদি জাতিসঙ্ঘের কাছে ওয়াশিংটনের আচরণের ব্যাখ্যা দাবি করে বলেছেন, হাইতিতে যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে সেখানকার দুর্গত মানুষকে সাহায্য করা, হাইতি দখল করে নেয়া নয়। ত্রাণকাজে অংশ নেয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কর্মকর্তারাও ত্রাণ পরিচালনার ক্ষেত্রে মার্কিন সেনাবাহিনীর ভূমিকার নিন্দা জানিয়েছেন প্রকাশ্যে। ডকটর্স উইদাউট বর্ডার্স নামের আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা জানিয়েছে, ১২ টন চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধপত্র বহনকারী তাদের একটি বিমানকে মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন পোর্ট-অ-প্রিন্স বিমানবন্দরে অবতরণে তিন দফা বাধা প্রদান করা হয়েছে। ১৪ জানুয়ারির পর তাদের অন্তত পাঁচটি বিমানকে পোর্ট-অ-প্রিন্স বিমানবন্দরে নামতে না দিয়ে ডোমিনিকান রিপাবলিকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফল হলো শত শত আহত হাইতিবাসীর চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ। পোর্ট-অ-প্রিন্সে ত্রাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী স্পেনের একটি সংস্থা মাদ্রিদ বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলন করে ভূমিকম্পদুর্গত এলাকায় মার্কিন সামরিক বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা বলেছে, নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে তার সামরিকীকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এর ফলে সেখানকার ত্রাণ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু করে তুরস্ক পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণকাজ চালাতে গিয়ে এমন বাধার মুখে তারা কখনো পড়েনি বলেও সংস্থাটি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

বুশ-ক্লিনটন দু’জনেই হাইতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিলেন:
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও বিল ক্লিনটন দু’জনেই হাইতিতে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। ২০০৪ সালে বুশ প্রশাসন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে হাইতির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জ্যাঁ বার্টেন্ড এরিসটিডকে ক্ষমতাচ্যুত ও অপহরণ করেন। সে ঘটনায় সিআইএ’র ঘাতক বাহিনীর হাতে হাজার হাজার হাইতিবাসী নিহত হয়েছিল। আর ১৯৯৪ সালে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও হাইতিতে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন।

মাদক ব্যবসার প্রতিরক্ষা দিচ্ছে সিআইএ:
হাইতির মাদক ব্যবসার প্রতিরক্ষা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। একটু খুলে বলার চেষ্টা করছি। ভয়াবহ দারিদ্র্যে জর্জরিত একটি দেশের যেখানে প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ বেকার সেখানে মরিয়া মানুষদের পক্ষে জীবিকার জন্য মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ে যখন দেখা যায় হোয়াইট হাউজের ঘোষিত ‘মাদক যুদ্ধ’-এর পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করার পরও হাইতিতে শক্ত নিয়ন্ত্রণ ঘাঁটি স্থাপনে সফল হওয়ার পরও হাইতি যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ শতাংশ কোকেন সরবরাহকারী দেশ হিসেবে গণ্য হয়। তবে বিশ্ব মাদক ব্যবসার সূত্র খুঁজতে গিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, প্রেসিডেন্ট দুভালায়ারের সময় থেকে সিআইএ এই মাদক ব্যবসাকে প্রতিরক্ষা দিচ্ছে। ওয়াশিংটন সরকারের ইচ্ছা হাইতি সরকার তাদের পক্ষ হয়ে এই মাদক ব্যবসাকে রক্ষা করবে। কারণটিও সন্তোষজনক। মাদক ব্যবসায় অর্জিত এই বিশাল পরিমাণ অপ্রদর্শিত অর্থ মায়ামির ব্যাংকে জমা হয়ে বিভিন্ন সাদা ব্যবসায় খাটে, বিভিন্ন পশ্চিমা প্রাইভেট ব্যাংকের মূলধন জোগায়। সেই সাথে এই মাদক ব্যবসায় লব্ধ অর্থ ও মাদক ক্রয়ের জন্য ছাপানো ডলার মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত হয়ে মার্কিন অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।

এনজিও ঘনত্ব বিশ্বে সবচেয়ে বেশি:
হাইতিতে এই মুহূর্তে কাজ করছে দশ হাজার এনজিও। জনসংখ্যা ও এনজিও’র পরিমাণের অনুপাতে হাইতিতে এনজিও ঘনত্ব বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। এই এনজিওগুলোর কোনো কোনোটির বাজেট হাইতির সরকারের চেয়ে বেশি। কৃষি, বাণিজ্য থেকে শুরু করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে এই এনজিওগুলো মার্কিন সরকারকে ঘনিষ্ঠ সহায়তা দিয়ে থাকে।

শেষকথা:
যুক্তরাষ্ট্র হাইতির অসহায় ও দুর্দশাগ্রস্ত গরিব মানুষগুলোর বিরুদ্ধে যে অপরাধ করে চলেছে তা দুনিয়ার অন্যান্য স্থানে গরিব মানুষের প্রতি তার করা আচরণ থেকে আলাদা কিছু নয়। এই আচরণ ও অপরাধ প্রবণতা আসলে পুঁজিবাদের ভয়াবহ সঙ্কটেরই বহিঃপ্রকাশ। গত ১০০ বছরে হাইতির শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষদের প্রতি সাম্রাজ্যবাদ যে অবিচার করেছে তার থেকে বের হয়ে আসার উপায় হচ্ছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর ক্ষোভ ও সংগ্রামকে এক সুতায় গাঁথা।

সূত্র : বিবিস, রয়টার্স, এপি, এএফপি, উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট, বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী।

একনজরে:
হাইতির সশস্ত্র বাহিনী ভেঙে দেয়া হয় ১৯৯৫ সালে। এর আগে পাঁচটি শাখার সমন্বয়ে সশস্ত্র বাহিনী ছিল। এগুলো হচ্ছে হাইতিয়ান আর্মি, হাইতিয়ান নেভি, হাইতিয়ান কোস্টগার্ড, হাইতিয়ান এয়ারফোর্স ও পোর্ট-অ-প্রিন্স পুলিশ। এই ছয় বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ছিল সব মিলে প্রায় এক হাজার। মিলিটারি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ শুরু করলে এই বাহিনী ভেঙে দেয়া হয়। এ সময়ে ডজনখানেক মিলিটারি সদস্য রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পরে জাতিসঙ্ঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় হাইতিয়ান ন্যাশনাল পুলিশ ও হাইতিয়ান কোস্টগার্ড প্রতিষ্ঠা করে। তবে শান্তিরক্ষার জন্য পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ওপর। জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর পূর্বে কানাডা, চিলি, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি দেশটির ভিত্তি গঠন করতে সহায়তা করে।

হাইতিয়ান ন্যাশনাল পুলিশ:
প্রতিষ্ঠা : ১৯৯৫
প্রশিক্ষণ গ্রহণ : ৮,৫০০ জন
প্রশিক্ষণে সহায়তা : যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স
প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র : সমাবেশ/ভিড় নিয়ন্ত্রণ, ভিআইপি প্রোটেকশন
প্রশিক্ষক প্রতিষ্ঠান : আইসিআইটিএপি (ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস এর ক্রিমিনাল ডিভিশনের একটি শাখা)
পুলিশের প্রধান কাজ : দীর্ঘকালীন অপরাধ শনাক্ত, যেমন অপহরণ, মাদক, অবৈধ অস্ত্র
সদস্য টার্গেট : ২০১২ সালে এই বাহিনীর সদস্য ১৪ হাজারে উন্নীত করা (জাতিসঙ্ঘের পরিকল্পনা)।

হাইতিয়ান কোস্টগার্ড:
প্রতিষ্ঠা : ১৯৩০ সাল (হাইতিয়ান নেভি বিলুপ্ত করার ২০ বছর পর)
* হাইতিয়ান কোস্টগার্ড হাইতিয়ান ন্যাশনাল পুলিশের একটি শাখা
প্রধান কাজ : ওয়াটার পুলিশিং ও কোস্টগার্ড
বেইজ : তিনটি; কিল্লিক (দ্য বেইজ অব পোর্ট-অ-প্রিন্স), ক্যাপ হাইতিয়ান, জ্যাকমেল।


 

লেখক পরিচিতি :
মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান
সহ-সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত
ই-মেইল: pavelmostafiz@gmail.com