তবুও মাথা নত করেননি মুক্তিযোদ্ধা নুরজাহান

সেই রক্তাক্ত সময়? ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই  আমার রক্তাক্ত জাতীর পতাকা রুদ্র মুহম্মাদ শহীদুল্লাহ, বাতাসে লাশের গন্ধ বাবার হত্যার প্রতিশোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার ৩৯ বছর পর সমাজে মুখ দেখাতে পারেনা  (৫৫) বছর বয়সী বীরঙ্গনা নুরজাহান বেগম ওরফে নুরী। পাকিস্তানীদের বন্দি শিবির হতে ফেরার পরে এ লাঞ্ছিতা স্বাধীনতা যোদ্ধোকে মেনে নেয়নি স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ, সংসার, পরিবার এমনকি সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধারাও । দুর দুর করে কুকুর তাড়ানোর মতোই খেদিয়ে দিয়েছেন আপন মা, এক মাত্র সহোদর ভাই । অথচ এই নারী অবর্ণনীয় দুঃসহ পাশবিক নির্যাতনেও পাকিস্তানীদের কাছে ফাস করেননি সহমুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় বা অন্য কোন তথ্য। সমাজে সবার কাছে ঘৃণিত হয়ে লজ্জায়, ঘৃর্ণায়, অপমানে, অভিমানে  আর কারো কাছেও ফিরে যাননি তরুন নূরজাহান। রাজধানীর জনারন্য মিশে গিয়ে মুক্তি সংগ্রামী নুরজাহান শুরু করে ছিলেন আরেক জীবন সংগ্রাম। আশ্রায় নিয়েছিলেন বস্তিতে। বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ হতে প্রসূতির ধাত্রী বা দাইয়ের কাজের কোনটিই বাদ দেননি তিনি।

 

এই প্রতিবেদকের সাঙ্গে ১ ঘন্টার আলাপ চারিতায় তিনি আপনন বেদনা ও বঞ্চনার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা জানান, ১৯৯৯ সালের  ফেব্র“য়ারিতে গৌরনদীর মুক্তিযোদ্ধদের তালিকাভুক্ত করন  ও বাছাইয়ের সভায় এলাকার বীরঙ্গনাদের খুজে বের করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী গৌরনদীর বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব বীরাঙ্গনা নুরজাহান বেগমকে  ঢাকা হতে খুজে বের করে বরিশাল পাঠিয়ে ছিলেন। আমাদের সঙ্গে আলাপের সময় স্মৃতির দুঃসহ ভারে প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলে ছিরেন এই বীরঙ্গনা। উপস্থিত সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধারা খেই ধরিয়ে দিচ্ছিলেন তাকে।

নুরীর বক্তব্যে জানা যায়, জ্যৈষ্ঠের শেষে অর্থাৎ ১৯৭১-এর জুনের প্রথম দিকে পাকিস্তানিরা হানা দিয়েছিল গৌরনদী থানার বাটাজোর ইউনিয়নের চন্দ্রহার এলাকায় নুরীদের গ্রাম বংকুরাতে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে ছিল বাঙ্গালিদের ঘর-বাড়ি । অন্য গ্রামবাসী পালিয়ে প্রান বাচালেও নুরীর বৃদ্ধা মা পালাতে পারেনি এবং শহীদ হলেন পাকিস্তানিদের হাতে। সদ্য বিধাবা মাকে নিয়ে এক মাত্র ষোড়শী কন্যা নুরজাহান বেগম তখন দিশা হারা। একমাত্র বড় ভাই আবদুর রব (২৩)  তখন চাকরী করেন খুরনার বরফ কলে । বাবা আদর করে যে সুন্দরী কন্যার নাম রেখে ছিলেন নুরজাহান। বিশ্বের আলো তার ষোড়শীর বুকে তখন দেশ প্রেম ও প্রতিশোধের আগুনে নুরজাহান মাকে আত্মীয় স্বজনের জিম্মায় রেখে ছুটে গেলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুর হোসেন নুরুর কাছে। অনুনয়-বিনয় করলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনে সুযোগ ও প্রশিক্ষন দেওয়ার জন্য।

কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে ঐ বয়সী  মেয়েকে ক্যাম্পে রাখা সমীচিন মনে করলেন না কমান্ডার নুরু। বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিলেন বাড়ি । আবার নুরী গেলেন কিছু দুরের আরেক মুক্তিযোদ্ধের  ক্যাম্পের কমান্ডার নিজাম উদ্দিনর কাছে। তিনিও একই কারনে ফিরিয়ে দিলেন নুরজাহানকে। নুরী এবারে কোম্পানী কমান্ডার নুর হোসেনের কাছে এসে হাতে পায়ে ধরে ঝুলে পড়লেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের সুযোগ না দিলে আত্মহননের হুমকি দিলেন। অবশেষে নুরু কমান্ডার সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ নুরজাহানকে তৈরি করলেন সংবাদ আদান-প্রদান কারি ও ইনফরমার হিসেবে। বিভিন্ন বেশে পরিচয় দিয়ে ও সুযোগে খুজে নুরী বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের মধ্যে তথ্য সরবরাহসহ সংযোগ রক্ষার পাশাপাশি হানাদার দোসর  রাজাকারদের মনোবল ভাঙ্গার কাজে লিপ্ত হলেন। বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কে অবস্থিত শিকারপুর খেয়া ঘাট ছিল তখন হানাদারদের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ন কৌশল গত ঘাঁটি।

বরিশাল ঢাকা মহাসড়কের পাশে সরকারি গৌরনদী কলেজে স্থায়ী কমান্ড পোষ্ট তৈরি করে হানাদার ও দোসররা। শিকারপুর, মাহিলাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় তৈরি করে ফাড়ি ও বাঙ্কার । শিকারপুরে এ ধরনেরই এক রাজাকার ক্যাম্পে পাচক ছিলেন নুরজাহানের দুর সম্পর্কের খালু বিল বাড়ি গ্রামের রাজাকার সুরত আলী তার মারফত হানাদার হায়েনাদের অনেক গুরুত্বপূর্ন হানার খবর আনতো নুরজাহান । এ ক্যাম্পের রাজাকাররা পালাতে ও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চায় বলে খবর পাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার নুর হোসেন নুরু এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ন বার্তা দিয়ে নুরীকে ৫ নভেম্বর পাঠালেন শিকারপুরে । কিন্তু ততদিনে হানাদার ও তাদের দোসরেরা নুরীর চালচালনে সন্দেহ জনক গতিবিধি খুঁজে পাওয়ায় তার উপর চোখ রাখতে শুরু করেছিল। এ অবস্থাতেই ৫ নভেম্বর শিকারপুর রাজাকার ক্যাম্পের কাছে বরিশল-ঢাকা মহাসড়কে গৌরনদীর দিক হতে আগত হানাদারদের মিলিটারি সামনে পড়ে গেলেন ষোড়শী নুনজাহান। হানাদার দোসররা তাকে মুক্তিযোদ্ধার সহচর হিসেবে চিনতে পেরে থামতে বললে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করলেন তিনি। তখন পাক সেনারা গুলি ছুড়ে তার ডান পায়ের রানে গুলিবিদ্ধ করে ধরাশয়ী করলো। রাস্তার ওপরে ফেলেই রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে থেতলে দেওয়া হলো মাথাসহ সমস্ত শরীর । তথ্য আদায়ের জন্য অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হলো  শিকারপুর ক্যাম্পে । সেখানে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসাবাদ ও লাঞ্চনা-নির্পীড়নে কোন ফল না হওয়াতে ৭ নবেম্বর তাকে পাঠানো হলো পাক বাহিনীর গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পে। স্বাধীনতার ৩৯ বছর অতিবাহিত হলেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভূক্ত না করায় ও সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা না পাওয়ায় তিনি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।