বরিশালের সাতজনের সন্ধ্যান আজো মেলেনি

আজো মেলেনি। র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর ওইসব রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ীদের হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছে বলেও এলাকায় নানা গুঞ্জন উঠেছে। র‌্যাব পরিচয়ে এসব ব্যক্তিদের তুলে নেয়া হলেও র‌্যাবের পক্ষ থেকে তা পুরোপুরি অস্বীকার করা হচ্ছে। তাহলে এ অপহরনকারীরা কারা, তাদের পরিচয়ই বা কি ! তারা কি আসলেই র‌্যাব, নাকি র‌্যাবের নাম ভাঙ্গিয়ে মূর্তিমান আতংকরূপে আর্ভিভাব হচ্ছে অন্ধকার জগতের কোন মাফিয়া চক্র ! এহেন নানা আলোচনার ঝড় উঠেছে সচেতন মহলের মাঝে।

বরিশালে সর্বপ্রথম র‌্যাব পরিচয়ে অপহরন করা হয় জেলা ছাত্রলীগ নেতা শফিকুল্লাহ মোনায়েম। সর্বশেষ অপহরনের স্বীকার হয় উজিরপুরের হারতা ইউনিয়নের জনপ্রিয় সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর খান ও মহানগরের ওয়ার্ড বিএনপি নেতা আবুল হায়দার। নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না মোনায়েব, হুমায়ুন ও হায়দার জীবিত না মৃত্যু! ফলশ্র“তিতে ওইসব পরিবার ও তাদের স্বজনদের কান্না আজো থামেনি। বিশেষ করে হায়দার অপহরনের পর তার বন্ধু-বান্ধবরাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নগরীর করিম কুটির এলাকার আব্দুর রশিদের পুত্র আবুল হায়দার। সে নগরীর ২১ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। করিম কুটিরের সামনে তার একটি ঔষধের দোকান রয়েছে। এছাড়াও একটি ঔষধ কোম্পানীতেও তিনি কর্মরত ছিলেন। ঔষধ কোম্পানীর অফিসিয়াল কাজের জন্য ২০১০ সালের ২৫ ডিসেম্বর হায়দার তার কলিক কবির হোসেনকে নিয়ে লঞ্চযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ওইদিন সকালে লঞ্চ থেকে নেমে তারা মহাখালীর জাকারিয়া আবাসিক হোটেলে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। হায়দার নিচে দাঁড়িয়ে থেকে হোটেলের দ্বিতীয় তলায় কেবিন বুকিং করতে পাঠায় তার কলিক কবিরকে। এ সময় কালো গাড়ি থেকে নেমে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা র‌্যাব পরিচয়ে গাড়িতে তুলে নেয় হায়দারকে। এরপর থেকেই হায়দার নিখোঁজ রয়েছে। এ ঘটনায় গুলশান থানায় হায়দারের ভাই হারুন-অর রশিদ একটি সাধারন ডায়েরী করেন। ডায়েরীতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জিয়াউর রহমান বিপ্ল­বকে অভিযুক্ত করা হয়। হায়দার অপহরনের পর তার স্ত্রী রোমানা হায়দার সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, হায়দারের সাথে নগরীর বৈদ্ধপাড়ার বিপ্ল­বের জমি সংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে। এ কারনে অপহরনের ঘটনার সাথে তাদের পরিবারকে সন্দেহ করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেছিলেন, হায়দার অপহরনের এক মাস পূর্বে বরিশাল আদালতের অভ্যন্তরে বসে বিপ্লব র‌্যাব দিয়ে হায়দারকে মেরে ফেলারও হুমকি দিয়েছিলো। র‌্যাব দিয়ে হত্যার হুমকির অভিযোগ অস্বীকার করে জিয়াউর রহমান বিপ্লব বলেছিলেন, হায়দারের পরিবার নয়; তার এক নিকট আত্মীয়ের সাথে তাদের জমিজমা নিয়ে মামলা চলছে। হায়দারের অপহরনের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলেও উল্লেখ করেন। এ ব্যাপারে বরিশাল মহানগর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মহসিন মন্টু বলেন, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগতভাবে বিএনপি নেতা আবুল হায়দার সাদামাটা ও স্বচ্ছতার সাথে জীবন যাপন করেছেন। তার বিরুদ্ধে একটি মামলা পর্যন্ত নেই। অপহরনের ঘটনাটি রহস্যজনক বলেও তিনি দাবি করেন। দিশেহারা হায়দারের পরিবার উপায়অন্তুর না পেয়ে অবশেষে অপহৃত হায়দারকে উদ্ধারের জন্য র‌্যাবের ঢাকা হেড অফিসে অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছেন।

একইভাবে উজিরপুর উপজেলার হারতা ইউনিয়নের জনপ্রিয় সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর খানকে ২০১০ সালের ২৩ নভেম্বর র‌্যাব পরিচয়ে ঢাকার মালিবাগ থেকে অপহরন করা হয়। অপহরনের খবর উজিরপুরে ছড়িয়ে পরলে হুমায়ুনের মুক্তির দাবিতে উপজেলার ১০টি গ্রামের হাজার-হাজার নারী-পুরুষ কয়েকদফা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশও করেছেন। সূত্রমতে, অদৃশ্য কারনে জনপ্রিয় এ নেতাকে অপহরন কিংবা আটকের খবর এখনো স্বীকার করেনি কোন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। উদ্বেগ উৎকন্ঠায় হুমায়ুনের স্বজনরা চোখের জ্বলে দিনাতিপাত করছেন। একটি সূত্র জানিয়েছেন, অপহৃত হুমায়ুন কবীর খান এখনো জীবিত রয়েছেন। তবে কবে তিনি মুক্তি পাবেন তার কোন নিশ্চয়তা দিতে পারেননি সূত্রটি। মুক্তির অপেক্ষার প্রহর গুনছেন অসহায় হুমায়ুনের পরিবার ও স্বজনেরা।

সূত্রমতে, নিখোঁজের পাশাপাশি অপহরনের পর বরিশালে লাশ হয়ে ফেরার ঘটনাও একেবারে কম নয়। তুলে নেয়া এসব রাজনৈতিকদের মধ্যে কেউ কেউ দীর্ঘদিন পরে ফিরলেও রহস্যজনক কারনে তাদের মুখ রয়েছে বন্ধ। গত বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে উজিরপুর থেকে নিখোঁজ হয় সাবেক সর্বহারা নেতা বাদল ওরফে কানা বাদল। কয়েকদিন পর মাদারীপুর থেকে উদ্ধার করা হয় তার গুলিবিদ্ধ লাশ। অনুরূপ ঢাকার দৈনিক বাংলার মোড় এলাকা থেকে সাদাপোষাকে  একদল অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা মাইক্রোবাসে তুলে নেয় বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপি নেতা গোলাম মোস্তফা নান্নাকে। তিনদিন পর নান্নার গ্রামের বাড়ির সন্নিকটে তার (নান্নার) লাশ পাওয়া যায়। এ দু’টি অপহরনের বিষয়ে র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল সংশ্লিষ্টদের পরিবার। কিন্তু র‌্যাবের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছিলো। গত বছরের ১৯ মার্চ পাথরঘাটার চরদোয়ানি বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয় তালুকেরচর গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী আবুল কালাম। সম্পতি সংবাদ সম্মেলন করেন নিখোঁজ আবুল কালামের পরিবার। র‌্যাব সদস্যরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে বলে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়। র‌্যাব পরিচয়ে গত বছরের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী এলাকা থেকে নিখোঁজ হয় সাগরের জেলে শাহ আলম। আজো তার কোন সন্ধ্যান মেলেনি। অনুরূপ নিখোঁজ রয়েছেন পাথরঘাটার পদ্মাস্লুইচ গ্রামের জেলে কবির হোসেন। গত বছরের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে তুলে নেয়া হয় তাকে। কবিরের বাবা আব্দুল হালিম জানান, সাদাপোষাকে একদল ব্যক্তিরা আমার ছেলে কবির ও বেল্ল­াল নাজির নামের এক ট্রলার মালিককে অপহরন করে নেয়। কিছুদিন পর বেল্ল­াল নাজির ফিরে আসলেও এখনো কবিরের কোন খোজ মেলেনি। বেল্লাল নাজির অপহরনের ব্যাপারে কোন কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ঝালকাঠির রাজাপুরের সাতারিয়া এলাকার মিজানুর রহমান নামের এক ব্যাক্তিকে গত বছরে ঢাকার বাড্ডা এলাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে গাড়িতে তুলে নেয়া হয়। অপহরনের কিছুদিন পর তুরাগ নদী সংলগ্ন বালুর মাঠ থেকে মিজানের বস্তা বন্দী লাশ উদ্ধার করা হয়। গত বছরের আগস্ট মাসে গৌরনদীর টরকী এলাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়া হয় পার্শ্ববর্তী কালকিনি উপজেলার সর্বহারা নেতা হুমায়ুন কবির টিপুকে। আজো তার কোন হদিস মেলেনি। ২০০৭ সালের ১ ডিসেম্বর র‌্যাব পরিচয়ে বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক শফিকুল্লাহ মোনায়েমকে কাউনিয়ার বাসা থেকে তুলে নেয়া হয়। সেই থেকে অদ্যবর্ধি তার আর কোন সন্ধ্যান মেলেনি। পরবর্তীতে আইনের আশ্রয় নেয় মোনায়েমের পরিবার। আবেদন করা হয় মানবাধিকার কমিশনে। প্রায় দু’বছর ধরে চলে চিঠি চালাচালি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব কিছুতেই ব্যর্থ হয় মোনায়েমের পরিবার।

এ ব্যাপারে বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডাঃ মিজানুর রহমান বলেন, একের পর এক নিখোঁজ এবং গুপ্ত হত্যার ঘটনায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছে সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দরা। র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেয়া কিংবা অপহরন করা ব্যক্তিরা আসলেই কি র‌্যাবের সদস্য, নাকি র‌্যাবের নাম ভাঙ্গিয়ে মূর্তিমান আতংকরূপে আর্ভিভাব হচ্ছে অন্ধকার জগতের কোন মাফিয়া চক্র। এনিয়ে সচেতন মহলের মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।