রাখার চেষ্টা করেছি। আমেরিকার এই রুক্ষ্ম পশ্চিমে এসেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।২০০৯’এর জানুয়ারীতে দেশে গিয়েছিলাম প্রায় ৪ বছর পর। ফেরার পথে স্যুটকেস ভরে জিনিষপত্র টানার পর্ব শেষ করেছি সেই কবে। কিন্তু একেবারেই কিছু আনা হয়না এমনটা বোধহয় সত্য নয়। এ যাত্রায় বেশ ক’প্যাকেট বীজ এনেছি চাষাবাদ করব বলে। ঘরে ফিরেই স্থানীয় হোম-ডিপো হতে আলিশান ক’টা টব কিনে টমেটোর বীজ পুতে দিলাম দেশীয় টমেটো খাব বলে। গরম পেরিয়ে শীত এল। বীঁজ হতে গাছ বেরিয়েছিল সেই কবে, ডাল-পালাও গজিয়েছিল দেখার মত। কিন্তু হায়, টমেটোর মুখ আর দেখা হল না! উপড়ে ফেলতে হল ভালবাসার গাছগুলোকে।
যাই হোক, আমার লেখার বিষয় বিদেশে বসে দেশী টমেটো খাওয়ার তুঘলকি স্বাদ নিয়ে নয়। আসছি সে প্রসঙ্গে।
মোহাম্মদপুর অফিসটায় প্রথম যেদিন জয়েন করি সেদিনই মনে মনে হিসাব কষে নেই কোথায় সেট করব ফুলের টব গুলো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন সূত্র হতে জোগাড় করতে শুরু করি হরেক রকম ফুলের গাছ ও বীচি। বছর না ঘুরতেই বদলে যায় অফিসটার চেহারা। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় নিজের সন্তানের মত আগলে রাখি গাছগুলোকে। ফেব্রুয়ারির সোনাঝরা এক সকাল। অফিসে ঢুকতেই দেখলাম গাছগুলোর উপর দিয়ে বয়ে গেছে প্রচন্ড ঝড়। শুধু ফুল নয়, গাছগুলোও কেউ উপড়ে নিয়ে গেছে। অফিসের পিয়ন কাচুমাচু সূরে বলল, ’স্যার, পাড়ার পুলাপাইনে শহীদ মিনারে ফুল দিব, তাই গত রাইতে উঠ্যাইয়া লইয়্যা গেছে’, তার কথায় শোকের ছায়া দূরে থাক বরং উট্কো ঝামেলা হতে মুক্তি পাওয়ার ছায়া দেখতে পেলাম। কিন্তূ আমার মনে হল হূদপিণ্ডের অর্ধেকটা কেউ ছিড়ে নিয়ে গেছে। ঝিম মেরে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। হ্যাঁ, দিনটা ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি। প্রাইভেট কোম্পানী, বছরের প্রায় ৩৬৫ দিনই অফিস করতে হয়। সে দিনটাও এর ব্যতিক্রম ছিলনা।
দিনটার আয়োজন ছিল চোখে পরার মত, অফিসে আসার পথেই তা খেয়াল করেছি। চারদিকে ভাবগম্ভীর অথচ উৎসবমুখর পরিবেশ। পরনে শান্ত সৌম্য পোশাক আর হাতে ফুল নিয়ে অনেকেই ছুটছে শহীদ মিনারের দিকে। টুকটাক যা কাজ ছিল তা সেরে আমিও বেরিয়ে পরলাম একই গন্তব্যে। মোহাম্মদপুর বাজারটা পার হলেই চোখে পরবে শহীদ মিনারটা। মাসের ১ তারিখ হতেই শুরু হয়েছিল ঘষামাজার কাজ। একদল উৎসাহী তরুণ দিনরাত পরিশ্রম করে বদলে দিয়েছে মিনারটার চেহারা। আলপনা আর ফুলের নদীতে ডুবে আছে পাদদেশ। বাংলা অক্ষর আর শহীদদের স্মরণে লেখা ব্যানার ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে চারদিক। সাথে বাজছে ২১শে ফেব্রুয়ারির অমর সংগীত। মিনারের এক কোনায় আমার ভালাবাসার ফুলগুলো দেখে ভুলে গেলাম সকালের কষ্টগুলো। মন্ত্রমুগ্ধের মত গিলছিলাম সবকিছু। স্মৃতির অলি-গলি হাতড়ে কখন চলে গিয়েছিলাম কৈশোরে খেয়াল করিনি। পাকিস্তান আমলে পাথর মেরে ইংরেজী সাইনবোর্ড ভাংগার স্মৃতি মনে হল এই তো সেদিনের কথা। অথচ দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পার হয়ে গেল। ’ভাইয়া এই ব্যাজটা নিতে হবে আপনাকে’, অফিস পিওনের সেই পুলাপাইনদের একজনের কর্কশ কথায় ফিরে এলাম ১৯৯২ সালে। নিতেই হল কালো ফিতার ব্যাজটা, বিনিময়ে পকেট হতে খসে গেল বেশ কিছু টাকা। রিক্সা নিয়ে আসাদগেটের দিকে এগিয়ে যেতে পুলাপাইনের আরও দু’তিনটা দল পথ আগলে দাঁড়াল, সাবার হাতে একই জিনিষ। প্রায় জবরদস্তি করে খসিয়ে নিল আরও কিছু টাকা।
পরদিন আফিস যাওয়ার পথে আবারও দেখলাম শহীদ মিনারটাকে। ব্যানারগুলো নেই, ফুলগুলোর অর্ধেকটাই হাওয়া, বাঁকি অর্ধেক মরি মরি করছে। চারদিকে বিদায়ের চিহ্ন। সপ্তাহ জুড়েই চল্ল এ দেখাদেখি। এভাবে ফেব্রুয়ারী গড়িয়ে মার্চ ঠাঁই নিল ক্যালেন্ডারের পাতায়। প্রথম তারিখেই চোখে পরল দৃশ্যটা; ২১শে ফেব্রুয়ারির সব চিহ্ন মুছে গেছে শহীদ মিনার হতে। ব্যানার গুলোর জায়গায় ঠাঁই নিয়েছে ভাসমান পতিতাদের শুকাতে দেয়া বাবুরহাটী শাড়ি। ওটাই ওদের স্থায়ী ঠিকানা। সারা রাত খদ্দেরের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়, সকাল হতেই ফিরে আসে আপন ঠিকানায়। এভাবেই কেটে যায় সারাটা বছর, ব্যতিক্রম শুধু ফেব্রুয়ারি মাসটা।
আমার এক দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়, জাদ্রেল রাজনীতিবিদ। ভদ্রলোকের পোশাক ভান্ডারটার কথা না বল্লেই নয়। ভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্যে থরে থরে সাজানো থাকে ভিন্ন পোশাক। ২১শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে শহীদ মিনার যাওয়ার জন্যে এক সেট, সন্ধ্যায় শহীদ্দের স্মরণে মহতী সভায় বক্তব্য দেয়ার এক সেট এবং রাতে মদ ও জুয়ার আসরে যোগ দেয়ার ভিন্ন সেট। শহীদ দিবসে রাজনীতিবিদদের ভাল ভাল কথা শুনলেই কেন জানি না ঐ আত্মীয়ের কথা মনে পরে।
২১শে ফেব্রুয়ারি, জাতীয় শহীদ এবং আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস। বাংলা ভাষাবাসী প্রতিটা মানুষের রক্তে মিশে আছে এ দিনটার মূল্যবোধ। সময়ের চাহিদা মিটিয়ে অদ্যাবধি দিবসটা টিকে আছে আপন মহিমায়, এবং ভবিষ্যতে হাজার বছর টিকে থাকবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। নতুন সহস্রাব্দের সাথে বদলেছে আমাদের প্রয়োজন এবং চাহিদা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে বিস্ফোরণোন্মুখ গতিতে। যে ইংরেজিকে তাড়ানোর জন্যে এক সময় রণ সাজে সজ্জিত হতাম সে ইংরেজির দৈন্যতা ই আমাদেরকে এখন অপদস্থ করছে পৃথিবীর অলিগলিতে । সন্দেহ নেই বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে বদলেছে জাতিতে জাতিতে সহাবস্থানের নিয়ম কানুন। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে, এমন একটা বাস্তবতায় আমাদের জাতীয় জীবনে ২১শে ফেব্রুয়ারির ভূমিকা কি পুনর্মূল্যায়নের দাবী রাখে? বিদেশী বর্গীদের বিদায় করেছি অনেকদিন হয়ে গেল, ভাষা নিয়ে তেজারতী করার স্পর্ধাও কবর দিয়েছি স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে। সময়ের চাকায় চড়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালনকে আমরা কোন গলিতে নিয়ে গেছি আসুন তার দু’একটা উদাহরণের সাথে পরিচিত হইঃ একটা সময় ছিল যখন ২১শে’র প্রথম প্রহরে মিনারে ফুল দেয়া নিয়ে রক্তারক্তি ছিল রাজনৈতিক সাংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মিনারের পাদ্দেশে ধর্ষণের মত ন্যক্কারজনক ঘটনাও আছে দিনটা উদযাপনের তালিকায়। অন্যের সাজানো বাগান তচনচ করে মিনারে ফুল অর্পণের কথা নাইবা উল্লেখ করলাম। এক কথায়, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবক্ষয়ের যে ভয়াবহ চিত্র তা হতে রেহাই পায়নি শহীদ দিবস পালনের ইতিহাসও।
৩৯ বছরেও একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের শিক্ষিতের হার ৫০ ভাগ অতিক্রম করেনি, এ সংখ্যাটাই কি হতে পারে না ভাষা দিবস পালনে আমাদের সাফল্যের মাপকাঠি? মিনারকে বৈধ-অবৈধ ফুলের সাগরে ভাসিয়ে, ভণ্ড নেতা-নেত্রীর ততধিক ভণ্ড ভাষণে আপ্লুত হয়ে আমরা সাধারণ মানুষেরা আন্দোলিত হই শহীদ্দের আত্মত্যাগে। কিন্তু ফুল একদিন শুকিয়ে যায়, সে ফুল সরিয়ে মোহাম্মদপুর মিনারের মত অনেক মিনারে পতিতারা ফিরে পায় তাদের স্থায়ী আবাস। নেতা-নেত্রীরা দিনান্তে শহীদ্দের জন্যে নির্গমিত চোখের জল মুছে হাতে তুলে নেন লাল নীল পানি। আমরা চাইলেই কি পারিনা অন্তত এই দিনটাকে গতানুগতিক বলয় হতে বের করে নির্দ্দিষ্ট কিছু কর্মসূচী নিয়ে পালন করতে? এই যেমন, শিক্ষার হারকে সন্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে আসা, শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমাসাময়িক চাহিদার সাথে খাপ খাইয়ের পুনর্বিন্যাস করা, শিক্ষাঙ্গন হতে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি দূর পূর্বক সন্ত্রাস সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা, এমন আরও কিছু কর্মসূচী। ফুলের মালায় শহীদ মিনার ভাসানোর চাইতে শিক্ষা ব্যবস্থার জ্বলন্ত সমস্যাগুলো সমাধান করা গেলে সালাম, রফিক, বরকত ও জাব্বরদের আত্মদানের প্রতি অধিকতর সন্মান প্রদর্শন করা যেত, আশাকরি আমার এ ভাবনা অন্যায় কোন ভাবনা নয়।
শীত এবং বসন্ত পেরিয়ে আবারও ফিরে আসবে গ্রীষ্মকাল। দেশ হতে আনা বীজগুলোর ভান্ডার শেষ হয়নি, সযত্নে উঠিয়ে রেখেছি সামনের গরমে রোপনের আশায়। না ফলুক দেশী টমেটো, অন্তত আশায় তো কাটানো যাবে ক’টা দিন! একই আশায় সাড়াটা জীবন বুক বেধে আছি, আমার দেশ হতে একদিন, কোন একদিন দূর হবে ভণ্ডামীর রাজত্ব, জয় হবে সত্য, ন্যায় আর বেঁচে থাকার নূন্যতম মূল্যবোধ।
সবাইকে ফেব্রুয়ারি মাসের শুভেচ্ছা।।
WatchDog – AmiBangladeshi.Org