বাংলাদেশের পক্ষে একজন পাকিস্তানির সংগ্রাম

এর আগে সে দেশের ডেইলি জং-এ কাজ করেছেন। সম্পাদক ছিলেন ডেইলি পাকিস্তান-এর। প্রথম আলোর পাঠকদের কাছে হামিদ মির নামটি অপরিচিত নয়। গত বছরের মার্চ মাসে প্রথম আলোতে ‘বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিলেন। সেই হামিদ মির কয়েক দিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন ডেইলি স্টার-এর ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এসেছিলেন ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের আরও কয়েকজন খ্যাতনামা সাংবাদিক-সম্পাদকও।

গত শনিবার ঢাকা ত্যাগের আগে হামিদ মির এসেছিলেন প্রথম আলোর কার্যালয়ে। ঘরোয়া আলোচনায় তিনি যা বললেন, তাতে এই পাকিস্তানি সাংবাদিকের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও সমীহ আরও বেড়ে গেল। এত দিন তিনি পত্রিকায় লিখে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়ার কথাটি বলে আসছিলেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তিনি এটিকে তাঁর ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার পক্ষে একটি প্রস্তাব নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন হামিদ মির। ইতিমধ্যে তিনি বিষয়টি নিয়ে সে দেশের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি ও প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির সঙ্গে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন রাজনীতিক-পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে অন্তত দুজন পার্লামেন্ট সদস্য প্রস্তাব উত্থাপনে রাজি হয়েছেন। এই দুজনের একজন হলেন প্রখ্যাত বামপন্থী বালুচ নেতা গাউস বক্স বেজেঞ্জোর পুত্র। আরেকজন পাঞ্জাব থেকে নির্বাচিত এক সাবেক আওয়ামী লীগ নেতার পুত্র।

গাউস বক্স বেজেঞ্জো সম্পর্কে আমরা জানি, ১৯৭১ সালের মার্চে ন্যাপের অন্য নেতা ওয়ালি খানকে নিয়ে এসেছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করতে। তার আগে পাকিস্তান থেকে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে তাঁরা কোনো সাহায্য করতে পারেন কি না। শেখ মুজিব তাঁর সদিচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার মেহমান হিসেবে ঢাকায় থাকবে।’

অপরজনের পরিচয় দিতে একই সঙ্গে কুণ্ঠিত ও লজ্জিত বোধ করছি। যাঁরা এত দিন জেনে এসেছিলেন, সব পাকিস্তানি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ছিল, তাঁরা ভুল জেনেছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭টি পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো আসন পায়নি। যদিও সেখানে দলের পক্ষ থেকে ১১ জন প্রার্থী দেওয়া হয়েছিল। শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের এক আওয়ামী লীগ নেতাকে ঢাকায় কোনো আসনে উপনির্বাচন করার অনুরোধ করলে তিনি রাজি হন। এরপর সেই রাজনীতিক আততায়ীর হাতে খুন হন। তাহলে কি আমরা বলতে পারি না, বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তিনিও একজন শহীদ। তাঁর পুত্র বর্তমানে পাকিস্তান পার্লামেন্টের সদস্য এবং হামিদ মিরের অনুরোধে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার প্রস্তাব সমর্থন করতে রাজি হয়েছেন।

হামিদ মির তাঁর প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা করেছেন ওয়ালি খানের পুত্রের সঙ্গেও। যিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে নির্বাচিত সদস্য। এখনো সম্মতি দেননি। তাঁর আশঙ্কা, এ ধরনের প্রস্তাবে সমর্থন দিলে দলের লোকেরা তা ভালোভাবে নেবেন না।
এরপর হামিদ মির বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত আবেগের যে ঘটনাটি আমাদের কাছে বিবৃত করলেন, তা এতই বেদনা ও শোকের যে, সে সম্পর্কে কিছু বলার আগে তাঁর ও তাঁর প্রয়াত বাবা ওয়ারিশ মিরের কাছে আরেকবার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। হামিদ মিরের বাবা রাজনীতি করতেন না। তবে একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি সাংবাদিক ছিলেন। জিয়াউল হকের সামরিক স্বৈরশাসন ও ধর্মের নামে চাপিয়ে দেওয়া বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে পত্রিকায় লিখেছেন। তাঁর শাণিত যুক্তি ও লেখনশৈলী পাঠককে আকৃষ্ট করত। তিনি ও তাঁর মতো উদারপন্থী ইসলামি পণ্ডিতেরা মনে করতেন, জিয়াউল হক ইসলামের নামে যা করেছেন, তা প্রকৃত ইসলাম নয়, ইসলামের বিকৃতি। সে সময়ে পাকিস্তানে কঠোর সেন্সরশিপ ছিল। সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কিছু লেখা যেত না। তৎকালীন ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর সংবাদদাতা ছিলেন সালামত আলী। সরকারের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করায় তাঁকে বেত্রাঘাত করা হয়েছিল। সে সময় অনেক সাংবাদিক-লেখকের ওপর নেমে আসে অত্যাচার-নির্যাতনের খড়্গ। জিয়াউল হক সরকার ওয়ারিশ মিরকেও প্রথমে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তা তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলে সরকার ভয়ভীতি দেখায়। লেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। একপর্যায়ে ওয়ারিশ মির সাংবাদিকতা ছেড়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন। তার পরও সরকারের জিঘাংসা থেকে রেহাই পাননি।

ওয়ারিশ মিরের যে রাজনীতিক বন্ধুটি জিয়াউল হকের সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে সভাসমাবেশ করতেন, তিনি এ রকম একটি সমাবেশে বোমা বিস্ফোরণে মারা যান। সন্দেহ করা হচ্ছে, সরকারের লোকেরাই এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। পাকিস্তান বা বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা বিরল নয়। কিন্তু ওয়ারিশ মির তো রাজনীতি করেন না, প্রকাশ্য সমাবেশে বক্তৃতাও দেন না। তিনি ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের পড়ান। তাঁকে কীভাবে বোমা মারবে ঘাতকেরা? তাই ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়।

ওয়ারিশ মির বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ক্যানটিনে খাওয়াদাওয়া করতেন, সেই ক্যানটিনে নতুন এক বেয়ারা নিযুক্তি পেলেন, যিনি তাঁকে চা ও খাবারদাবার পরিবেশন করতেন। কয়েক দিনের মধ্যে ওয়ারিশ মির শারীরিকভাবে অসুস্থতা বোধ করলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসক তাঁকে শরীর পরীক্ষা করতে বলেন। সেই পরীক্ষার রিপোর্ট আসার আগেই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর মুখ থেকে নীল রক্ত পড়তে থাকে। তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না, তাঁকে বিষ প্রয়োগেই হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানি রাজনীতিতে বিষ প্রয়োগের ঘটনা এটাই প্রথম নয়, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকেও বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় বলে অনেকে সন্দেহ করেন। ওয়ারিশ মিরের মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরা তাঁর মরদেহ ময়নাতদন্ত করতে চাইলেও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির সদস্যরা জোর করে লাশ নিয়ে যান। তাঁরা বলেন, ‘তিনি আমাদের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর অসম্মান হতে দেব না।’ একেই বলে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, জিয়াউল হকের এগারো বছরের শাসনে জামায়াতে ইসলামী তাঁকে সহযোগিতা করে গেছে। হামিদ মিরের মহান পিতা সত্য কথা বলে স্বৈরশাসকের হাতে জীবন দিয়েছেন, পুত্র আরেক সত্যানুসন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। বলা যায়, বিষয়টিকে তিনি জিহাদের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এ জন্য এক শ্রেণীর পাকিস্তানির কাছ থেকে তাঁকে অনেক গালমন্দও শুনতে হচ্ছে। অনেকে শর্মিলা বসুর উদাহরণ টেনে বলেছেন, ‘আপনি পুরো সত্য বলছেন না। অর্ধসত্য বলছেন।’ তবে পাকিস্তানি শাসকেরা কোনো সত্যই দেশবাসীকে জানতে দেননি।

হামিদ মিরও স্বীকার করেন, একাত্তরে বাংলাদেশে কী ঘটেছিল, তা সাধারণ পাকিস্তানিদের জানতে দেওয়া হয়নি। এমনকি ১৬ ডিসেম্বরের নিয়াজির আত্মসমর্পণের খবরও তাঁরা জানতে পেরেছেন তিন দিন পর—১৯ ডিসেম্বর। পাকিস্তানি পাঠ্যপুস্তকেও এ সম্পর্কে কিছু নেই। হামিদ মির জানালেন, একটি ঘটনা তাঁকে দারুণভাবে নাড়া দেয়, যে কারণে তিনি পাকিস্তানিদের ক্ষমাপ্রার্থনার বিষয়টি সামনে এনেছেন। ১৯৯৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর সঙ্গে একটি সম্মেলনে জেনেভায় গিয়েছিলেন। সেখানে এক বাংলাদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় (নামটি মনে করতে পারেননি)। বাংলাদেশি সাংবাদিক তাঁর পরিচয় পেয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মানুষের ওপর কী ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন করেছে, তা তিনি জানেন কি না। এরপর কোনো পাকিস্তানির সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে পারে না। এ কথা বলেই তিনি কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান।

এরপর হামিদ মির বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হন এবং একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে, তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। তিনি জিয়ো টিভিতে ক্যাপিটাল টক নামের টক শো উপস্থাপনা করেন, যাতে সুযোগ পেলেই পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনার প্রসঙ্গটি আনেন। কয়েক মাস আগে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক ইমরান খানও তাঁর প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, হ্যাঁ, পাকিস্তানের ক্ষমতা চাওয়া উচিত। উল্লেখ্য, হামিদ মির সাংবাদিকতার আগে ক্রিকেট খেলতেন। বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পরই তিনি সাংবাদিকতায় আসেন।

হামিদ মির আশা করছেন, ‘একদিন পাকিস্তান পার্লামেন্ট বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে একটি প্রস্তাব নেবে এবং দুই দেশের সম্পর্কেরও উন্নতি ঘটবে।’ তিনি মনে করেন, ‘আমাদের কদর্য অতীত ভুলে গিয়ে সামনের দিকে এগোতে হবে। সরকারের পাশাপাশি মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।’

হামিদ মির যখন পাকিস্তানিদের অপকর্মের জন্য ক্রমাগত ক্ষমাপ্রার্থনার কথা বলে আসছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিচ্ছেন, তখন আমাদের সরকারি ও বিরোধী দলের বিজ্ঞ রাজনীতিকেরা কী করছেন? তাঁরা অতীত খুঁড়ে ময়লা-আবর্জনা বের করছেন, যা থেকে দুর্গন্ধ আসে। কেউ মুক্তিযুদ্ধের কোনো সেক্টর কমান্ডারকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে আনন্দ পাচ্ছেন, কেউ বা স্বাধীনতার প্রধান নেতার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে দুই দলই মৃত নেতাদের লাশ নিয়ে টানাটানি করছেন। ইতিহাসে যার যা প্রাপ্য, তা দিতে হবে। তাই বলে বড়কে ছোট করে কিংবা একজনকে বড় করতে গিয়ে অন্য সবার ভূমিকা বাতিল করে দেওয়ার নাম ইতিহাস নয়।

হামিদ মির বলেছেন, বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের অনেক কিছু শেখার আছে। জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ অনেক সফল হয়েছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর খবরদারি কম। এর কোনোটাই হয়তো অসত্য নয়। কিন্তু আমাদেরও হামিদ মিরের কাছ থেকে অনেক শেখার আছে। সেটি হলো দল, দেশ ও ধর্মকে ছাপিয়ে মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান।

আমাদের ‘দেশপ্রেমিক’ রাজনীতিকেরা এ থেকে কিছু শিক্ষা নেবেন কি?

 

sohrab.hassan's picture লেখক : – প্রিয় ডট কম