এক অনন্য স্থাপনা দেড়’শ বছর পুরনো বরিশালের উলানিয়া মসজিদ

উপজেলার উলানিয়া গ্রামে এ মসজিদটি নির্মিত হয়। নির্মানের আলাদা বৈশিষ্টের কারনে এই মসজিটি সবার দৃষ্টি কেড়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের মে মাসে মসজিদটি সংস্কার করা হয়। সংস্কার শেষে মসজিদটি পর্যটকসহ সবার প্রশংসা লাভ করেছে।

মসজিদটির গোড়ার কথা
পঞ্চদশ সালের গোড়ার কথা এতদ অঞ্চলে ছিল,মগ-পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমনে পর্যুদস্ত। এই মগ হার্ম্মাদদের প্রধান কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ। অতঃপর এদের দমনের উদ্দেশ্যে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব সুবেদার শায়েস্তাখানকে পাঠান। শায়েস্তাখান পুত্র উমেদ খান, বিশাল রনতরী সৈন্য গোলাবারুদ নিয়ে জলদস্যু প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেন। মেহেন্দীগঞ্জের গোবিন্দপুরে কেল্লা তৈরী করা হল। স্থানীয়ভাবে যা সংগ্রাম কেল্লা নামে পরিচিত ছিল। এই অভিযানে মোঃ হানিফ নেতৃত্ব দিয়ে বীরত্ব প্রদর্শন করেন। মগ-পর্তুগীজ-হার্ম্মাদরা বিতারীত হলেন। কিন্তু পারস্য বংশোদ্ভুত হানিফ খান এদেশে ভালোবেশে থেকে গেলেন। মোঃ হানিফের এক কন্যা সন্তান ছিল। মোঃ হানিফের ভ্রাতস্পুত্র ও জামাতা এবং উত্তরাধিকারী শেখ মোঃ হাবিজ পরবর্তিকালে সংগ্রাম কেল্লা থেকে সামান্য পশ্চিমে উলানিয়া অঞ্চলে এসে বসবাস করেন। মোঃ হাবিজের পুত্র শেখ মোঃ সদরুদ্দিনের আমলেই মূলত উলানিয়া জমিদারি প্রতিষ্ঠাত হয়। তার ৩ পুত্র ছিল। এরা হলো নয়া রাজা চৌধুরী,কালা রাজা চৌধুরী,হাসান রাজা চৌধুরী। এদের সময়েই বসত বাড়িটিকে উচু প্রাচীর ঘেড়া দুর্গের মত করে নির্মান করা হয়। এরপর বাড়ির প্রধান ফটকের পাশেই নির্মান করা হয় একটি মসজিদ। এটিই মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া জামে মসজিদ।

মসজিদটির বৈশিষ্ট
১৮৬১ সালে প্রতিষ্টার পর মসজিদটি কয়েকবার সংস্কার করা হলেও মুল অবয়ব এখনও অক্ষন্ন রয়েছে। ৩ গম্বুজ বিশিষ্ঠ এই মসজিদটি অনেক অনেকটা তাজমহল আকৃতির। মসজিদের সামনে বাধানো চওরা,পুকুর রয়েছে। মুল গৃহের আগে লোহার ৬ খামের উপর প্রতিষ্ঠিত জাফরির কাজ রয়েছে। এখানে বীমের ছাদ রয়েছে। মসজিদের তিনটি দরজা। মসজিদের ভিতরে একসাথে শতাধিক মুসল্লী নামাজ পড়তে পারে। মসজিদের আর একটি বৈশিষ্ট রয়েছে যা তাকে অন্য মসজিদের থেকে আলাদা করেছে। সেটি হলো মসজিদ গাত্রে শিলালিপি। এই শিলালিপী। এই মসজিদ গাত্রের পুরোনো শিলালিপীটি এখন আর নেই। তবে একই রকম শিলালিপী উৎকীর্ন রয়েছে। মসজিদের বাহিরের গাত্রে চিনে মাটির টুকরা দিয়ে গড়া রয়েছে। মসজিদটি মূলত মুগলরীতিতে তৈরী। ভেতর ও বাহিরের গাত্রে জ্যামিতিক লতাপাতা ও ফলের নকশা রয়েছে।

শিলালিপী
মসজিদে মুল নামাজ ঘরে ৩টি প্রবেশ পথ রয়েছে। ৩টি দরজার মধ্যে মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং এটির দুই পার্শ্বের দুই দেয়ালে নকশার নীচে উৎকীর্ন লিপিমালা ছিল। ডানদিকের  দেয়ালে উৎকীর্ন কোরাআন শরীফের আয়াত ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অধিকাংশ লেখা টিকে আছে। বাদিকের দেয়ালে উৎকীর্ন ছিল মসজিদ প্রতিষ্ঠা বিষয়ক বক্তব্য। এগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আগেই ফটোগ্রাফি করে রাখা হয়েছিল। অতঃপর এই ফটোগ্রাফি ব্যবহার করেই নতুন শিলালিপী খোদাই করে মসজিদের গাত্রে উৎকীর্ন করা হয়েছে। শিলালিপীতে ১০টি লাইন থাকলেও সবগুলো অক্ষুন্ন নেই। যেগুলো রয়েছে তার থেকে অর্থ করলে দাড়ায়-
১. প্রভু আল্লাহর উপর ভরসা করে।
২. সর্পসংকুল চন্দ্রদ্বীপের দক্ষিন পূর্বে প্রান্তে।
৩. শোকে পশিুদ্ধ মানুষ।
৪. নামাজের জন্য রাজ্যে মসজিদ নির্মান করে।
৫. নয়া রাজা, কালা রাজা, হাসন রাজার বসতিতে।
৬. বারশ’ আটষট্টি সনে।
৭. …………।
৮. নামাজ পড়া শুরু করল।
৯. মসজিদে।
১০. ……….।

শেষ কথা
১৯৯৩ সালে প্রত্মতত্ম বিভাগ মসজিদটিকে সংরক্ষনযোগ্য ঘোষনা করেন। জমিদারীর পক্ষে আপনজন,কিছু সংস্কার করে। ২০০৩ সালে ইঞ্জিনিয়ার হারুন অর রশিদ মসজিদ সংস্কারে ভুমিকা রাখেন। অতপর কুয়েত ভিত্তিক মসজিদে সাহায্য দানকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ইঞ্জিনিয়ার মোঃ এস কীওয়ান মসজিদটি সংস্কারের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলে মসজিদের ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয়। সংস্কার শেষে মসজিদের অভ্যন্তরীন ও বাহিক সৌন্দয্য বহুগুনে বর্ধিত হয়। বর্তমানে মসজিদটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে বহু পর্যটক আসে।

মসজিদ কমিটির সম্পাদক ইউসুফ চৌধুরী বলেন, মসজিদ কমিটি ও মুসল্লিদের সাহায্য সহযোগীতায় ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হয় গত মে মাসে। তিনি আরো বলেন এছাড়াও “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্র“য়ারী”গানের রচয়িতা ও বিশিষ্ট কলাম লেখক আব্দুল গফফার চৌধুরী মসজিদ কমিটিকে মসজিদ সংস্কার করার জন্য ১০হাজার টাকা অনুদান দিয়েছে। এছাড়া সংস্কারের জন্য বড় কোন অনুদান পাইনি। পুরাকৃর্তী হিসেবে মসজিদটি সংস্কারের জন্য সরকারের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। সরকারিভাবে মসজিদটি সংস্কারের উদ্দ্যোগ নিলে এ মসজিদটি হতে পারে দক্ষিনাঞ্চলের আইডাল বা পর্যটনকেন্দ্র।

এ ব্যপারে স্থানীয় মেহেন্দীগঞ্জ উলানিয়া ৪নং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল মোল্লা জানান এ বছরই আমি প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। এর পূর্বে বা পরে মসজিদ কমিটি থেকে আমার কাছে কোন সহযোগীতা চাওয়া হয়নি। তবে আমি সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগীতা করবো। মসজিদটি মেঘনা নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। সরকার নদী ভাঙ্গন রোধে ওয়াবদার মাধ্যমে ১১০ কোটি টাকা ব্যায়ে নদী ভাঙ্গন রোধের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। খুব শীঘৃই কাজটি শুরু করবে।