শবে বরাতের প্রকৃত পরিচয়

বা ভাগ্য-রজনী বলা হয়। ‘শবে বরাত’ মুসলিম সমাজে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ইসলামে যার প্রকৃত মর্যাদা সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলিমই পরিপূর্ণরূপে জ্ঞাত নন, তাই বিভ্রান্তি চলছে অনেক। ২৩ হিঃ সালে হযরত উসমান রা. ৩য় খলিফা-ই-রাশিদাহ হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এ সময় এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইসলামের প্রসার ঘটে। অগণিত মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে বহু মানুষই সাহাবীগণের সাহচার্য থেকে বঞ্চিত ছিলেন, ফলে নওমুসলিমগণের অনেকেই ইসলামের শিক্ষায় দক্ষতা প্রাপ্ত হতে পারেননি। তাঁদের অনেকের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা, চরিত্র ও কর্মের পূর্ণবিকাশ ঘটেনি। তাই নওমুসলিমদের অজ্ঞতা, পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাব, ইসলাম ও আরবদের প্রতি আক্রোশ ইত্যাদির ফলে এদের মধ্যে বিভিন্ন বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইসলামের অনেক শত্র“ সামরিক ময়দানে ইসলামের পরাজয় ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে মিথ্যা ও অপপ্রচারের মাধ্যমে ইসলাম ধ্বংসের চেষ্টা করতে থাকে। আর সবচেয়ে কঠিন ও স্থায়ী মিথ্যা, যে মিথ্যা ওহী বা হাদীসের নামে (জাল হাদীস) প্রচারিত হতে থাকে।

এমনি এক দুশমন ছিলো আব্দুল্লাহ ইবনু সাবা-ইয়ামানের ইহুদী।  হযরত উসমানের রা. খিলাফতকালে সে মুসলমান নাম ধারণ করে ইসলামের ক্ষতি করার জন্য বিভিন্ন শহরে ও জনপদে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক কথা প্রচার করতে থাকে। হিজায, বসরা, কূফা ও সিরিয়ায় তেমন সুবিধা করতে না পেরে সে মিশর গিয়ে জাল হাদীস তৈরী করে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকে। অন্যদিকে হিঃ ৪র্থÑ৫ম শতাব্দীতে একদল মানুষ যারা নেককার ও দরবেশ বলে পরিচিতি লাভ করে। তারা তাদের অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তির কারণে (সওয়াবের আশায়?) বানোয়াট কথা হাদীসের নামে সমাজে প্রচার করতেন। এদের বাহ্যিক পরহেজগারী, নির্লোভ জীবন যাপন পদ্ধতি দেখে মানুষ সরল মনে এদের কথা বিশ্বাস করে এসকল বানোয়াট কথা হাদীস বলে গ্রহণ করতো। পরবর্তী সময়ে হাদীসের অভিজ্ঞ ইমামগণ সুক্ষ্ম নিরীক্ষার মাধ্যমে এদের মিথ্যাচার ও জালিয়াতি ধরে ফেলেন এবং তা প্রকাশ করে গ্রন্থ রচনা করেন। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা এ বিষয়ে “শবে বরাত” সংক্রান্ত প্রকৃত অবস্থা ও এর সঠিক মর্যাদা, পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে আলোচনা করবো। সাথে সাথে সমাজে প্রচলিত বিভ্রান্তির কারণ সরূপ এ সংক্রান্ত জাল-হাদীসগুলোও কিছু আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ।  

  • প্রথমতঃ ‘শা’বানের মধ্যম রজনীর’ বিশেষ ফযীলতঃ মধ্য শা‘বানের রজনীতে সৃষ্টি জীবের প্রতি বিশেষভাবে আল্লাহর ক্ষমা প্রদানের বিষয়টি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানিত। এ সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে : (ইন্নাল্লাহা লাইত্তালিউ’ ফিলাইলাতিন নিছফিমিন শা’বানা ফাইয়াগফিরু লিজামিয়ি’ খলক্বিহি ইল্লালি মুশরিকিন আও মুশাহিনিন।)Ñ “আল্লাহ তা’আলা মধ্য শা’বানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং ‘শিরিককারী’ ও বিদ্বেষ-হিংসা পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।”    এই অর্থের হাদীস কাছাকাছি শব্দে ৮ জন সাহাবী ঃ আবূ বকর সিদ্দীক, আয়েশা, আবু হুরায়রা, আবূ মূসা আশ’আরী, মুয়ায ইবন জাবাল, আব্দুল্লাহ ইবন্ ‘আমর, ‘আউফ ইবন্ মালিক ও আবূ সা‘লাবা আল-খুশানী (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) থেকে বর্ণিত হয়েছে।  (ইবন মাজাহ, আস-সুনান ১/৪৪৫, বায্যার, আল-মুসনাদ ১/১৫৭, ২০৭, ৭/১৮৬; আহমদ ইবন্ হাম্বল, আল-মুসনাদ ২/১৭৬; ইবন্ আবি আসিম, আস-সুন্নাহ, পৃ-২২৩-২২৪; ইবন্ হিব্বান, আস-সহীহ ১২/৪৮১; তাবরানী, আল-মু‘জাম আল-কাবীর ২০/১০৮, ২২/২২৩; আল-মু’জাম আল-আওসাত, ৭/৬৮; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, ৩/৩৮১; ইবন্ খুযায়মা, কিতাবুত্ তাওহীদ ১/৩২৫-৩২৬)। এ সকল হাদীসের মধ্যে কিছু সনদ দূর্বল ও কিছু সনদ ‘হাসান’ পর্যায়ের। সামগ্রিক বিচারে হাদীসটি সহীহ। ‘আল্লামা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) বলেন, ‘হাদীসটি সহীহ, যে মূলকথা অনেক সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে, যা পরস্পর একে অপরকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করে। …. (আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীস আস-সাহীহাহ ৩/১৩৫)।

অত্র হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, শা’বান মাসের মধ্যম রজনীটি একটি ফযীলত পূর্ণ বরকতময় মাগফিরাতের রাত। এই রাতে আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাহদেরকে (যারা-মুশরিক নন, অংশীবাদী নন, জীবনে সকল ধরণের শিরকমুক্ত এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত জীবন যাপন করেন) ক্ষমা করে দেন। কিন্তু এই ক্ষমা অর্জনের জন্য শিরক ও বিদ্বেষ বর্জন ব্যতীত অন্য কোনো ইবাদত বন্দেগীর প্রয়োজন আছে কিনা তা অত্র হাদীসে উল্লেখ করা হয়নি।

  • দ্বিতীয়তঃ “লাইলাতুম্মুবারাকাহ” আয়াতের তাফসীর ঃ

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে : “ইন্না আনযালনাহু ফিলাইলাতিম মুবারাকাতিন, ইন্না কুন্না মুনযিরিন”,- (সূরা: ৪৪ দুখান, আয়াত-৩)। “আমি তো তা (আল-কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী।”

অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় শুধুমাত্র তাবিয়ী’ ‘ইকরিমাহ’ বলেন, এখানে ‘মুবারক রজনী’ বলতে ‘মধ্য শা’বানের রাতকে বুঝানো হয়েছে। ইকরিমাহ আরও বলেন, অত্র রাতে গোটা বছরের সকল বিষয়ে ফয়সালা করা হয়। (তাবারী, তাফসীর ২৫/১০৭-১০৯।

কিন্তু প্রখ্যাত মুফাসসিরগণ ইকরিমার উল্লেখিত ব্যাখ্যায় প্রদত্ত মত গ্রহণ করেননি। ইমাম তাবারী বিভিন্ন সনদে ইকরিমার উল্লেখিত ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করার পর তার প্রতিবাদ করে বলেছেন যে, ইকরিমার এই মত ভিত্তিহীন। তিনি বলেন যে, সঠিক মত হলো, এখানে ‘মুবারক রজনী’ বলতে ‘লাইলাতুল ক্বাদরকে বুঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ যে রজনীতে কুরআন কারীম অবতীর্ণ করেছেন সেই রাত্রিকে একস্থানে লাইলাতুল ক্বাদর বা ‘মহিমান্বিত রজনী’ বলে অবহিত করেছেন (সূরা: ৯৭ ক্বাদরঃ-১)। অন্যত্র এই রাত্রিকেই ‘লাইলাতুম্মুবারাকা’ বা ‘বরকতময় রজনী’ বলে অভিহিত করেছেন এবং এই রাত্রিটি নিঃসন্দেহে রামদান মাসের মধ্যে; কারণ অন্যত্র আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, তিনি রমাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন। (সূরা:-১ বাকারা, আয়াত-১৮৫)। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুবারক রজনী রামাদান মাসে, শা’বান মাসে নয়। (তাবারী, তাফসীর-২৫/১০৭-১০৯)।

পরবর্তী মুফাসসিরগণ ইমাম তাবারীর সাথে ঐক্যমত পোষণ করে বলেছেন যে, ‘লাইলাতুল ক্বাদর ও ‘লাইলাতুম্মুবারাকা’ একই রাতের দুটি উপাধি। দুটি কারণে মুফাসসিরগণ ইকরিমার তাফসীরকে বাতিল বা অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন ঃ
১.    ইকরিমার এইমতটি পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট বাণীর সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ কুরআন কারীমে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে যে, একটি মুবারক রাত্রিতে ও একটি মহিমান্বিত রাত্রিতে তিনি কুরআন নাযিল করেছেন। এ সকল আয়াতের সমন্বিত স্পষ্ট অর্থ হলো, আল্লাহ রামাদান মাসের একরাত্রিতে কুরআন নাযিল করেছেন এবং সেই রাত্রিটি বরকতময় ও মহিমান্বিত। মুবারক রজনীর ব্যাখ্যায় মধ্য শা’বানের রজনীর উল্লেখ করার অর্থ হলো উল্লেখিত আয়াতগুলোর স্পষ্ট অর্থের ভুল ব্যাখ্যা।
২.    বিভিন্ন সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা ‘মুবারক রজনী’র ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এইরাতটি হলো ‘লাইলাতুল ক্বাদর’ বা মহিমান্বিত রজনী। সাহাবীগণের মধ্য থেকে ইবন্ আব্বাস রা. ও ইবন্ উমার রা. থেকে এ ধরণের ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। তাবেয়ীগণের মধ্য থেকে আবূ আব্দুর রহমান আল-সুলামী (৭৪হিঃ), মুজাহিদবিন জাবর (১০২ হিঃ), হাসান বসরী (১১০হিঃ), ক্বাতাদা ইবন্ দি‘আমা (১১৭হিঃ), ও আব্দুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম মাদানী (১৮২হিঃ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা সকলেই ব্যাখ্যা করেছেন যে, ‘লাইলাতুম্মুবারাকাহ অর্থ হলো ‘লাইলাতুল ক্বাদর। (নাহ্হাস মা’আনিল কুরআন ৬/৩৯৫; যামাখশারী, আল-কাশ্শাফ ৩/৪২৯; ইবনুল ‘আরাবী, আহকামুল কুরআন ৪/১৬৯০; ইবনু আতিয়্যাহ, আল-মুহাররার আল-ওয়াজীয ৫/৬৮-৬৯; কুরতুবী, তাফসীর ১৬/১২৬; আবু হাইয়্যান, আল-বাহর আল-মুহীত ৮/৩২-৩৩; ইবন্ কাছীর, তাফসীর ৪/১৪০; সূযুতী, আদ-দুররুল মানছুর ৫/৭৩৮-৭৪২; শাওকানী, ফাতহুল কাদীর ৪/৫৭০-৫৭২; আলুসী, রুহুল মা’আনী ১৩/১১০; থানবী, তাফসীর-ই আশরাফী ৫/৬১৫-৬১৬; সাবুনী মুহাম্মদ আলী, সাফওয়াতুত্ তাফাসীর ৩/১৭০-১৭১; মুফতী শফী, মা’আরেফ আল-কুরআন ৭/৮৩৫-৮৩৬; ও আবুল ‘আলা, মওদূদী, তাফহীমুল কুরআন ১৪/১৩৯)।  

  • মধ্য শা’বানের রাত্রে ভাগ্য লিখন ঃ

“কিছুকিছু হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই রাত্রিতে ভাগ্য অনুলিপি করা হয় বা পরবর্তী বছরের জন্য হায়াত-মউত ও রিযক ইত্যাদির অনুলিপি করা হয়। উক্ত হাদীসগুলোর সনদ বিস্তারিত নিরীক্ষার পর দেখা যায় যে, এই অর্থে বর্ণীত হাদীসগুলো অত্যন্ত দূর্বল অথবা বানোয়াট। এই অর্থে কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয়নি।” (ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি, পৃ-৪১৪)।

  • শবে বরাতে নির্ধারিত রাক’আত ও পদ্ধতির সালাত আদায় সংক্রান্ত ফযীলতের হাদীস ঃ

শবে বরাত উপলক্ষে কিছু বর্ণনায় এরাত্রিতে বিশেষ পদ্ধতিতে বিশেষ সূরা পাঠের মাধ্যমে, নির্দিষ্ট সংখ্যক রাক‘আত সালাত আদায়ের বিশেষ ফযীলতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী এই অর্থে বর্ণিত যাবতীয় হাদীস বানোয়াট ও জাল বলে প্রতীয়মান হয়েছে। হিজরী ৪র্থ শতকের পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামে বানিয়ে এগুলো প্রচার করা হয়েছে। এখানে এ জাতীয় কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলো।
১.    ৩০০ রাক‘আত সংক্রান্ত জাল-হাদীস ঃ বর্ণিত আছে যে, “যে ব্যক্তি মধ্য শা’বানের রাতে প্রত্যেক রাক‘আতে ৩০বার সূরা ইখলাস পাঠের মাধ্যমে ৩০০ রাক‘আত সালাত আদায় করবে, জাহান্নামের আগুন অবধারিত এমন ১০ ব্যক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।” হাদীসটি আল্লামা ইবনুল ক্বায়্যিম বাতিল বা ভিত্তিহীন হাদীস সমূহের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। (ইবনুল ক্বাইয়্যিম, নাক্বদুল মান্কুল ০১/৮৫)।

২.    ১০০ রাক‘আত সংক্রান্ত জাল-হাদীস ঃ মধ্য শা’বানের রজনীতে ১০০ রাকা‘আত সালাত আদায়ের প্রচলন হিজরী ৪র্থ শতকের পরে মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, ৪৪৮ হি. সনে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রথম ইহার প্রচলন শুরু হয়। (মোল্লা‘আলী ক্বারী মিরক্বাতুল মাফাতীহ ৩/৩৮৮)। এসময়ে বিভিন্ন মিথ্যাবাদী-গল্পকার, ওয়াযেয় এই অর্থে কিছু জাল হাদীস তৈরীকরে প্রচার করে। এই অর্থে বেশ কিছু জাল হাদীস বর্ণিত হয়েছে যার প্রত্যেকটিই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হওয়ার দলিল বিদ্যমান, তার মধ্য থেকে একটি বর্ণনা এখানে উল্লেখ করছি। এ বিষয়ে হযরত আলী ইবন্ আবি তালিব রা.-এর নামে প্রচারিত; “যে ব্যক্তি মধ্য শা’বানের রাতে ১০০ রাকা‘আত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকা‘আতে সূরা ফাতিহা ও ১০ বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে সে উক্ত রাতে যত প্রয়োজনের কথা বলবে আল্লাহ তা‘আলা তার সকল প্রয়োজন পূরণ করবেন। লাওহে মাহফুযে তাকে দুর্ভাগা লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরিবর্তন করে সৌভাগ্যবান হিসেবে তার নিয়তি নির্ধারণ করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা তার কাছে ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার পাপরাশি মুছে দিবে, বছরের শেষ পর্যন্ত তাকে সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন রাখবে, এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা ‘আদন’ জান্নাতে ৭০ হাজার বা ৭ লক্ষ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা বেহেশতের মধ্যে তার জন্য শহর ও প্রাসাদ নির্মাণ করবে এবং তার জন্য বৃক্ষরাজি রোপন করবে ….। যে ব্যক্তি এ নামায আদায় করবে এবং পরকালের শান্তি কামনা করবে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য তার অংশ প্রদান করবেন।”
হাদীসটি সর্বসম্মতভাবে বানোয়াট ও জাল হিসেবে প্রমাণিত। এর বর্ণনাকারীগণ কেউ অজ্ঞাত পরিচয় এবং কেউ মিথ্যাবাদী জালিয়াত হিসেবে পরিচিত। (ইবনুল জাওযী, আল-মাওদু‘আত ০২/৪৯-৫০; সূয়ুতী আল-লাআলী, ০২/৫৭-৫৮; ইবন্ ইরাক, তানযীহ, ০২/৯২-৯৩; মোল্লা ক্বারী, আল-আসরার, পৃ-৩৩০-৩৩১; আল-মাসনু’, পৃ-২০৮-২০৯; শাওকানী, আল ফাওয়ায়েদ ০১/৭৫-৭৬)।

৩.    ৫০ রাকা‘আত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম যাহাবী একে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট হাদীস হিসেবে হাদীসটির বর্ণনাকারী অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মদ বিন সাঈদ আলমীলী আত-তাবারীর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন। উক্ত মুহাম্মদ বিন সাঈদ এ হাদীসটি তার মতই অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মদ বিন আমর আল-বাজালী এর সনদে হযরত আনাস রা. থেকে মরফু হিসেবে বর্ণনা করেছেন। (যাহাবী, মীযানুল ই‘তিদাল, ০৬/১৬৮-১৬৯)।

৪.    মধ্য শা’বানের রজনীতে ১৪ আকা‘আত সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসটি উল্লেখ করে ইমাম বায়হাক্বী বলেন, “ইমাম আহমদ বলেছেন যে, এই হাদীসটি আপত্তিকর, পরিত্যাক্ত, জাল ও বানোয়াট বলে প্রমাণিত। কেননা হাদীসটির সনদে অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারীগণ রয়েছে।” (বায়হাক্বী, শু‘আব আল-ঈমান, ০৩/৩৮৬-৩৮৭, হাদীস নং- ৩৮৪১)।

৫.    উক্ত রাত্রে ১২ রাক‘আত সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসটি জালিয়াতকারীগণ হযরত আবু হুরায়রা রা. পর্যন্ত একটি জাল সনদ তৈরী করে তাঁর সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে প্রচার করেছে। উক্ত হাদীসটির সনদের অধিকাংশ বর্ণনাকারীই অজ্ঞাত। পরিচিত বর্ণনাকারীগণ দূর্বল ও পরিত্যাজ্য। (ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত, ০২/৫২; সূয়ুতী, আল-লাআলী ০২/৫৯)।
উপরের আলোচনার মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, মধ্য শা’বানের রাত্রে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সূরার মাধ্যমে নির্দিষ্ট রাকা‘আত সালাত আদায় সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসসমূহ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। পরীক্ষা-নিরীক্ষাকারী মুহাদ্দিসগণ এব্যাপারে সকলেই একমত। মোল্লা আলী ক্বারী (১০১৪ হি.) মধ্য শা’বানের রাত্রে সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসগুলোর অসারতা উল্লেখ পূর্বক বলেন, এ সালাত ৪র্থ হিজরী শতকের পর ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে, যার উৎপত্তি হয়েছে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে। এব্যাপারে অসংখ্য জাল-হাদীস তৈরী করা হয়েছে, যার একটিও সঠিক বা নির্ভরযোগ্য নয়। (মোল্লা ‘আলী ক্বারী, আল-আসরার, পৃ-৩৩০-৩৩১; ইবনুল ক্বাইয়্যেম, আল-মানার আল-মুনীফ, পৃ-৮৯-৯৯)।

  • মধ্য শা’বানের রাতে কিয়াম ও দিনে সিয়াম সংক্রান্ত হাদীসঃ

ইমাম ইবন্ মাজাহ তাঁর সুনান গ্রন্থে উল্লেখিত বিষয়ে একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন, “আলী রা. বলেন, যখন মধ্য শা’বানের রাত আসে তখন তোমরা রাতে (সালাতে-দোয়ায়) দণ্ডায়মান থাকো এবং দিবসে সিয়াম পালন করো। কারণ ঐদিন সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, ‘কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করবো। কোনো রিয্ক অনুসন্ধানকারী আছো কি? আমি তাকে রিয্ক প্রদান করবো। কোনো দূর্দশাগ্রস্থ ব্যক্তি আছো কি? আমি তাকে মুক্ত করবো।’ এভাবে সুবহে সাদিক উদয় হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে।”
অত্র হাদীসটি ইমাম ইবন্ মাজাহ কর্তৃক সংকলিত হওয়ার কারণে হাদীসটি আমাদের সমাজে বহুল পরিচিত, প্রচারিত ও আলোচিত। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে বানোয়াট বলে চিহ্নিত করেছেন। এ হাদীসটি একমাত্র ইবন্ আবি সাবরাহ ছাড়া অন্যকেউ বর্ণনা করেননি। শুধুমাত্র ইবন্ আবি সাবরাহ দাবী করেছেন যে, তিনি ইবরাহীম বিন মোহাম্মদ থেকে, হাদীসটি শ্রবণ করেছেন।
ইবন্ আবি সাবরাহ (১৬২ হি.)-এর পূর্ণ নাম আবু বকর বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন আবি সাবরাহ। তিনি মদীনায় বসবাস করতেন। কিন্তু তুলনামূলক নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে হাদীসের ইমামগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে, তিনি হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিতেন। অসংখ্য ইমাম তাকে মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। তন্মধ্যে,ইমাম বুখারী, ইমাম আহমদ, ইয়াইয়া বিন মাঈন, আলী ইবনুল মাদীনী, ইবনু আদী, ইবন্ হিব্বান ও হাকিম নাইসাপুরী অন্যতম। (ইবন্ হাজার আস-কালানী, তাকরীব পৃ-৬২৩; তাহযীব, ১২/২৫-২৬)।
এরই আলোকে আল্লামা শিহাবউদ্দিন আহমদ বিন আবি বকর আল-বুসীরী (৮৪০ হি.) অত্র হাদীস এর টিকায় বলেছেন, ইবন্ আবি সাবরাহ এর দূর্বলতার কারণে উক্ত সনদটি দূর্বল। ইমাম আহমদ ও ইবন্ মাঈন তাকে হাদীস বানোয়াটকারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। (আল-বুসীরী, যাওয়ায়েদ ইবন্ মাজাহ পৃ-২০৩)।
শাইখ নাসির উদ্দিন আলবানী, (ইবন্ আবি সাবরাহ) সম্পর্কে বলেছেন যে, তিনি অত্যন্ত দূর্বল ও তার হাদীস বানোয়াট। তিনি আরও বলেছেন যে, অত্র হাদীসটি বানোয়াট। (আলবানী, দাঈফু সুনানি ইবন্ মাজাহ, পৃ-১০৬; যাঈফাহ, ৫/১৫৪)।

  • দুই ঈদ ও মধ্য শা’বানের রাতভর ইবাদত ঃ

এ সংক্রান্ত একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে: “যে ব্যক্তি মধ্য শা’বানের রাত ও দুই ঈদের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকবে তার অন্তরের মৃত্যু হবেনা। যেদিন সকল অন্তর মরে যাবে।”
অত্র হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী ‘ঈসা ইবন্ ইবরাহীম ইবন্ তাহমান’ বাতিল হাদীস বর্ণনাকরী হিসেবে পরিচিত। ঈমাম বুখারী, নাসায়ী, ইয়াহইয়া বিন মাঈন ও আবু হাতিম রাযি ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস একবাক্যে তাকে পরিত্যাক্ত বা মিথ্যাবাদী বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন, এছাড়া ঈসা ইবন্ ইবরাহীম নামক এই ব্যক্তি তার উস্তায হিসেবে যার নাম উল্লেখ করেছেন সেই ‘সালামা বিন সুলাইমান’ ও তিনি তার যে উস্তায বলে উল্লেখ করেছেন, ‘মারওয়ান বিন সালিম’ মিথ্যা হাদীস বর্ণনার অভিযোগে অভিযুক্ত। (ইবন্ জাওযী, আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়া ০২/৫৬২; ইবন হাজার, আল-ইসাবা ফী তাময়ীযীস সাহাবা ০৫/৫৮০; তালখীস আল-হাবীর, ০২/৬০৬)।

  • এভাবে আরও বর্ণিত হয়েছে, “যে ব্যক্তি পাঁচ রাত (ইবাদতে) জাগ্রত থাকবে তার জন্য জান্নাত অপরিহার্য হবে, ‘‘যিলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখের রাত্রি, ৯ তারিখের (‘আরাফার) রাত্রি, ১০ তারিখের (ঈদুল আযহার) রাত্রি, ঈদুল ফেতরের রাত্রি ও মধ্য শা’বানের রাত্রি।” হাদীসটির বর্ণনাকারী আব্দুর রহীম ইবন্ যাইদ আল-‘আম্মী (১৮৪ হি.) নামক ব্যক্তি মিথ্যা ও জাল হাদীস বর্ণনাকারী বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইমাম বুখারী, নাসাঈ, ইয়াহইয়া ইবন্ মাঈন, আহমদ ইবন্ হাম্মল, আবূ হাতিম রাযী, আবূ দাউদ ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস এই ব্যক্তির জালিয়াতির বিষয় উল্লেখ করেছেন। এজন্য অত্র হাদীসটি মাওযূ বা জাল হাদীস বলে গণ্য। ইবনুল জাওযী, ইবন্ হাজার ‘আসকালানী, মুহাম্মদ নাসিরউদ্দিন আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। (আল-মুনযিরী, আত-তারগীব ০২/৯৬; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ০৪/৩৩৬; আলবানী, যায়ীফাহ ০২/১২)।

  • শবে বরাতের গোসল ঃ

শবে বরাত বিষয়ক প্রচলিত কথাগুলোর অন্যতম হলো ‘এই রাত্রে গোসল করার ফযীলত।’ বিষয়টি যদিও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবুও আমাদের সমাজে তা বহুল প্রচলিত। আমাদের দেশের প্রচলিত অনেক পুস্তকেই এই জাল হাদীসটি লেখা হয় এবং ওয়াযে আলোচনা করা হয়। ‘মাও: গোলাম রহমান’ রচিত মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ-২৪০; মুফতী হাবীব ছামদানী রচিত বার চান্দের ফযীলত, পৃ-২৬; অধ্যাপিকা কামরুনেসা দুলাল রচিত পুস্তক পৃ-৩০৯-এ অত্র হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, “একটি হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি উক্ত রাত্রিতে এবাদতের উদ্দেশ্যে সন্ধায় গোসল করবে, সেই ব্যক্তির গোসলের প্রত্যেকটি বিন্দু পানির পরিবর্তে তাহার আমল নামায় ৭০০ রাকাত নফল নামাযের ছওয়াব লিখা যাইবে। গোসল করিয়া দুই রাকাত তাইয়্যাতুল অজুর নামায পড়িবে।…”

  • শবে বরাতে প্রচলিত আরও কিছু ভিত্তিহীন কথাবার্তার নমুনাঃ

আমাদের দেশে কিছু বই-পুস্তকে অনেক সময় লেখকগণ বিশুদ্ধ ও অশুদ্ধকে একসাথে মিশ্রিত করেন। অনেক সময় নিজেদের খেয়াল-খুশি মত বুখারী, মুসলিম সহ সহীহ হাদীস গ্রন্থের নাম ব্যবহার করেন। এগুলোর বিষয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। শবে বরাত বিষয় কিছু ভিত্তিহীন কথা আমাদের দেশে প্রচলিত কয়েকটি পুস্তকে কমবেশী লিখা হয়েছে। এর একটি পুস্তক থেকে কিছু কথা উদ্ধৃত করছি। উক্ত বইয়ের লেখক বলেন,

“হাদীসে আছে, যাহারা এই রাত্রিতে এবাদত করিবে আল্লাহ তা‘আলা আপন খাছ রহমত ও স্বীয় অনুগ্রহের দ্বারা তাহাদের শরীরকে দোজখের অগ্নির উপর হারাম করিয়া দিবেন। অর্থাৎ তাহাদিগকে কখনও দোজখে নিক্ষেপ করিবেন না। হযরত (সা.) আরও বলেন, আমি জিবরাইল (আ.) এর নিকট শুনিয়াছি, যাহারা শা’বানের চাঁদের ১৫ তারিখের রাত্রিতে জাগিয়া এবাদত বন্দেগী করিবে, তাহারা শবে ক্বদরের এবাদতের সমতুল্য ছওয়াব পাইবে।”

উক্ত বইয়ের লেখক আরও উল্লেখ করেছেন যে, আরও একটি হাদীসে আছে, “হযরত (সা.) বলিয়াছেন, শা’বানের চাঁদের ১৫ তারিখের রাত্রিতে এবাদতকারী আলেম, ফাজেল, অলী, গাউছ, কুতুব, ফকীর, দরবেশ ছিদ্দীক, শহীদ, পাপী ও নিষ্পাপ সমস্তকে আল্লাহ তা‘আলা মার্জনা করিবেন। কিন্তু যাদুকর, গণক, বখীল, শরাবখোর, যেনাকারী, নেশাখোর ও পিতা-মাতাকে কষ্টদাতা এই কয়জনকে আল্লাহ তা‘আলা মাফ করিবেন না।” লেখক বলেন, “আরও একটি হাদীসে আছে, আল্লাহ তা‘আলা শা’বানের চাঁদের ১৫ তারিখের রাত্রিতে ৩০০ খাছ রহমতের দরজা খুলিয়া দেন ও তাহার বান্দাদের উপর বে-শুমার রহমত বর্ষণ করিতে থাকেন।”

উক্ত পুস্তকের লেখক আরও উল্লেখ করে লিখেছেন যে, “হাদীসে আছে, শা’বানের চাঁদের চৌদ্দই তারিখের সূর্য অস্ত যাইবার সময় নিম্নলিখিত দোওয়া ৪০ বার  পাঠ করিলে ৪০ বৎসরের ছগীরা গুনাহ মাফ হইয়া যাইবে। (লা হাওলা অলা কুও্যাতা ইল্লা বিল্লাহ)। দুই দুই রাকাত করিয়া চারি রাকাত নামায পড়িবে ……. সূরা ফাতেহার পর প্রত্যেক রাকাতেই সূরা এখলাছ দশবার করিয়া পাঠ করিবে ও এই নিয়মেই নামায শেষ করিবে। হাদীস শরীফে আছে, যাহারা এই নামায পড়িবে  নিশ্চয়ই আল্লাহ তাহাদের চারিটি হাজত পুরা করিয়া দিবেন ও তাহাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন।

তৎপর ঐ রাত্রিতে দুই দুই রাকাত করিয়া আরও চারি রাকাত নফল নামায পড়িবে। ……… প্রত্যেক রাকাতে সূরা ক্বদর একবার ও সূরা এখলাছ পাঁচশবার পাঠ করিবে এবং এই নিয়মে নামায শেষ করিবে।” লেখক আরও লিখেছেন, “হাদীস শরীফে আছে, যাহারা এই নামায পাঠ করিবে আল্লাহ তা‘আলা তাহাদের পঞ্চাশ বৎসরের গুনাহ মার্জনা করিয়া দিবেন। (তিরমিযি)। তিনি আরও বলেন, “হাদীস শরীফে আছে, মাতৃগর্ভ হইতে লোক যেরূপ নিষ্পাপ হইয়া ভূমিষ্ট হয়, উল্লেখিত ৪ রাকাত নামায পড়িলেও সেইরূপ নিষ্পাপ হইয়া যাইবে (মেশকাত)।

তিনি আরও লিখেছেন, “হাদীস শরীফে আছে, যাহারা উক্ত রাত্রে বা দিনে ১০০ হইতে ৩০০ মরতবা দরূদ শরীফ হযরত (সা.) এর উপর পাঠ করিবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাহাদের উপর দোজখ হারাম করিবেন। হযরত (দ:) ও সুপারিশ করিয়া তাহাদিগকে বেহেশতে লইবেন। (সহীহ বোখারী)। আর যাহারা উক্ত রাত্রিতে সূরা দোখান সাতবার ও সূরা ইয়াসীন ৩ বার পাঠ করিবে, আল্লাহ তাহাদের তিনটি মকছুদ পুরা করিবেন যথা: (১) হায়াত বৃদ্ধি করিবে, (২) রুজি-রেজক বৃদ্ধি করিবেন, (৩) সমস্ত পাপ মার্জনা করিবেন।” (মাও: গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ-২৩৬-২৪১)।
আসলে উল্লেখিত হাদীসের নামে বর্ণিত কথাগুলো মিশকাত, তিরমিযী ও বুখারী শরীফে অনুসন্ধান করে কোথাও পাওয়া যায়নি।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার আল-হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ড. খোন্দকার আ.ন.ম.আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর কর্তৃক রচিত “এহ্ ইয়াউস সুনান গ্রন্থে শবে বরাত সংক্রান্ত বিভিন্ন লেখকদের গ্রন্থ সমূহের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে ২৩১ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “এ রাতটি সাহাবীগণের যুগে কেউ পালন করেননি। তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীগণের যুগ থেকে কেউ কেউ এরাত পালন শুরু করেন। তখন অন্যান্য তাবেয়ী তাঁদের এ কাজের প্রতিবাদ করে বলেন যে, যেহেতু কোনো সাহাবী বা মশহুর তাবেয়ী ইমাম ও ফকীহ এ রাত পালন করেননি, সেহেতু তা পালন করা জাযেয় নয়। এ রাত পালনের প্রতিবাদে মদীনার প্রখ্যাত তাবে-তাবেয়ী আব্দুর রহমান বিন যাইদ বিন আসলাম (১৮২ হি.) বলেন: আমাদের কোনো উস্তায, মদীনার কোনো (ইমাম) ফকীহ (এমনকি) কোনো ‘আলেমকে দেখিনি যে শা’বান মাসের মাঝের রাতের দিকে কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ করেছেন। (ইবন্ ওয়াদ্দাহ, আল-বিদাউ’, পৃ-৪৬)।

অবশেষে আমরা নিশ্চিতভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারি যে, “লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান” বা শবে বরাতের রাতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাহদের মধ্যে অংশীবাদী (মুশরিক) ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকেই ক্ষমা করে দেন।” কিন্তু এ রাতের ফযীলতে অনেক মিথ্যা ও বানোয়াট কথা আবিষ্কার করা হয়েছে, যা বিদ‘আত ছাড়া কিছু নয়। কয়েকটি দূর্বল (যয়ীফ সনদে বর্ণিত) হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরাতে একাকী গোরস্থানে যিয়ারত করে মুর্দার জন্য দোয়া করেছেন, নিজের ঘরে একাকী নামাজ পড়েছেন ও দোয়া করেছেন। কিছু ‘আলেমের মতে “ফযীলত সংক্রান্ত বিষয়ে যয়ীফ বা দূর্বল হাদীসের উপর ‘আমল করা যায়।” এই কারণেই পরবর্তী সময়ে অসংখ্য বানোয়াট বা জাল হাদীসের আবিষ্কার হয়েছে। যার ফলে শবে বরাতের রাতে গোসল করা, নির্দিষ্ট সূরা দিয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক রাকা‘আত নামায পড়া, হালুয়া-রুটি তৈরী, খাওয়া ও বিতরণ করা ইত্যাদি অনেক বিষয় আমরা নিজেরাই বানিয়ে নিয়েছি। সমাজে মুসলিম নামধারী বহু লোক নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত ফারয সালাত, সওম, যাকাত ও হাজ্জ আদায় না করেও উক্ত রাতের বানোয়াট ইবাদত দ্বারাই জান্নাত প্রাপ্তির আশায় মসজিদ সমূহে রাত কাটিয়ে নিজের দায় সারার চেষ্টায় লিপ্ত হচ্ছেন।

বর্তমানে রাতটি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যা কখনই রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণের যুগে ছিলনা, এরাত্রে বানোয়াট ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমেই কোনো মুসলমান নামধারী ব্যক্তি তাঁর জীবনে ইচ্ছাকৃত অপরাধ সমূহ সুদ, ঘুষ, যিনা, ব্যাভীচার, যুলুম, অন্যের অধিকার হরণ করা, হিংসা-বিদ্বেষে পূর্ণ জীবন যাপন করে কুফর, শিরক-সহ কবীরা গুনাহ সমূহ তওবা ছাড়াই ক্ষমা প্রাপ্তির আশা করা বাতুলতা ছাড়া কিছুনা। যার দ্বারা যালিম, সুদখোর, ঘুষখোর ও অন্যের অধিকার হরণকারীরা একরাত্রের কথিত ইবাদত দ্বারা ক্ষমার মিথ্যা আশায় আরও অধিক অপরাধী হয়ে যাচ্ছে না’? কারণ তারা এই ধারণা করতে পারেন যে, শবে বরাতের এক রাতের ইবাদতেই যদি জীবনের সকল অপরাধ ক্ষমা হয় ও এত সহজেই জান্নাত প্রাপ্তি নিশ্চত  হয় তাহলে সারাজীবনে এত কষ্ট করে নিয়মিত নামায, রোযা, হাজ্জ, যাকাত ও হালাল-হারাম মেনে চলা, সত্য প্রতিষ্ঠা ও অসত্য উৎখাতের চেষ্টার দরকার কি? চুরি, ডাকাতী, সুদ, ঘুষ, যেনা-ব্যাভীচার ও অপরের অধিকার হরণ এবং যুলুম পরিহার করারও কোনো প্রয়োজন নেই। এরূপ ধারণার কারণেই শবে বরাত এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। মুসলমানরা যদি সারা বছর অসংখ্য গুনাহের কাজ করে এক রাতের ইবাদতের মাধ্যমে সবকিছু ক্ষমা করিয়ে নিতে পারে তাহলে অপরাধ করতে আরা বাধা কোথায়? বস্তুত পক্ষে মুসলিম সমাজকে চরিত্রহীন ও অপরাধী একটি জাতিতে পরিণত করার জন্য শবে বরাতের নামে এরূপ ফজিলত বর্ণনা করেছেন জাল হাদীস বর্ণনাকারীগণ। এটি একটি সুগভীর ষড়যন্ত্র বলে মুসলিম বিশেষজ্ঞগণের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথে চলার তৌফিক দিন, আমিন।

ড. মুহা: নজীবুর রহমান
সহকারী অধ্যাপক
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।