যানজটের আরেক নাম জীবনের অপচয়

সময়ের অপচয় হয়, তা পূরণ করা সম্ভব হয় না আর। আমার কাছে সময়ের অপচয় মানে জীবনের অপচয়। কারণ সময়ের পাত্রেই তো জীবনটা ধরা থাকে। অকারণে পাত্র ছোট হতে হতে একদিন টুপ করে ঝরে পড়বে এ জীবন।

দুঃখ করা অর্থহীন। কিন্তু তবু করি। কারণ বাঁচার জন্যই তো জš§ নিয়েছি। অথচ জীবনের অমূল্য সময়গুলো ডাকাতি করে নিচ্ছে ট্রাফিক জ্যাম, একি সহ্য হয়? কাজের জন্য বেরিয়ে স্থবির হয়ে বসে থাকি কোন না কোন যানে। সেদিন সোনারগাঁও হোটেলের মোড় থেকে ধানমণ্ডি ১১ নম্বরের বাসায় এসেছি দুই ঘণ্টায়। রোজ এরকমই হয়। অনেক কষ্টে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে কেনা গ্যাস প্রায় সবটুকুই পুড়ল।

 

সে আরও এক অপচয়। নিশ্চয় বহুজনের অভিজ্ঞতা আছে, কোন কোন ট্রাফিক সিগনালে লালবাতি জ্বলে প্রায় আট-দশ মিনিট। তারপর যদি মহাসড়কে ভিড় থাকে তাহলে ক্রসিংয়ের গাড়ি ছাড়া হয় না। আবার আট-দশ মিনিটের ধাক্কা। সবুজ বাতি জ্বলেই তো আধমিনিট। চার-পাঁচটা গাড়ির বেশি বেরিয়ে যেতেই পারে না। ট্রাফিক পুলিশ এটা বোঝেই না যে, গাড়ি জমতে দিলেই জ্যাম বাড়বে। ট্রাফিক প্রশিক্ষণ ওদের আছে কি না তাও বুঝি না। বহু দেশ দেখেছি। ট্রাফিকে লালবাতি আট-দশ মিনিট জ্বলে থাকতে দেখিনি।

একদিন ভেঙে ফেলা র‌্যাংগস ভবনের পাশে যে ফ্লাইওভার হয়েছে, সেখানে পড়েছিলাম আটকা। সেখানেও আট-দশ মিনিট ধরে জ্বলে লালবাতি। সবুজ জ্বলে এক মিনিটেরও কম। পাঁচ-ছয়টা গাড়ি বেরিয়ে যেতে না যেতেই আবার লালের দেখা। সেদিন প্রথম বুঝলাম, উড়াল সেতুর ডিজাইনাররা কী অপরিমিত বুদ্ধির অধিকারী! উড়াল সেতুটা এয়ারপোর্ট রোড পার হয়ে ওপারে গিয়ে ঠেকলে তেজগাঁও থেকে আসার সময় ঝামেলা কত কম হতো! উড়াল সেতুর তো এয়ারপোর্ট রোডের সঙ্গে কোলাকুলি করার কোন প্রয়োজনই ছিল না। নিচ দিয়ে সড়সড় করে না হোক ধুঁকে ধুঁকে গাড়ি যেত। আর তেজগাঁওয়ের গাড়ি উড়ে এসে নভোথিয়েটারের পথে পড়ত। প্রযুক্তি আর অনুদান নিতে গিয়ে যদি বুদ্ধি ও আরাম বিসর্জন দিতে হয়, তাহলে গোদের ওপর বিষফোঁড়া বসানোর দরকারটা কী? বিশেষত আমাদের এখানে একটা গন্তব্যে যাওয়ার জন্য বিকল্প রাস্তা নেই বললেই চলে। ওই একই রাস্তা দিয়ে মতিঝিল, একই রাস্তা দিয়ে সাভার বা মাওয়া যেতে হয়। কখনও কয়েক কিলোমিটার জ্যাম লেগে যায় ঘাটের পথে। শিশু ও মহিলাদের যে কত কষ্ট হয়, সেটা দেখেও কেউ দেখে না। আর পাবলিক টয়লেটের যে কী মারাÍক আকাল, তা ভুক্তভোগীরাই জানে। এ সমস্যার সমাধানে হাজার হাজার এনজিও তো কিছু অবদান রাখতে পারে! এর পরও শুনতে হয় উন্নয়নে ভেসে যাচ্ছি আমরা!

ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে এত যে কা কা করছে লোকে, কিচ্ছু আসে যায় না তাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এখনও শুনি, মনোরেল না পাতাল রেল, কিংবা দোতলা সড়ক, কোনটা হবে তারই সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। কষ্ট কমা তো দূরের কথা, জনগণের কষ্ট বাড়ছে দিন দিন। কারণ ক্ষুধা। কাজ না করলে খাবে কী? তাই মাটিতে উপুড় হয়ে একরকম বুক দিয়ে হেঁটেই কাজে যায় লোক। বাজারদরের কথা তো সবারই জানা। তাই ঘরে ফিরে তারা এঁটো পাতা চাটার স্বাদও পায় না। তবু ওরা বাঁচতে চায়। আমরাও চাই। এই চাওয়াটা নষ্ট হতে হতে মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে কখনও কখনও। তখন ছুতানাতায় ক্ষিপ্ত হয়ে মারামারি, খুনোখুনি বাধিয়ে দেয় মানুষ। নেশা করে, চুরি-ডাকাতি করে, দলে ভিড়ে গিয়ে গাড়ি ভাঙে, লোক পিটিয়ে হত্যা করে। পাশাপাশি অপরাধী চক্রের রাজারা তো আছেই।

শহরে যেভাবে বাস-ট্রাক-গাড়ি চলে তাতে দুর্ঘটনা না ঘটাই অস্বাভাবিক। পত্রপত্রিকার বরাতে জানা যায়, রাস্তার অনুপাতে বহুগুণ বেশি গাড়ি চলে। নতুন খবর হল, ‘মহাসড়কে অনুমোদনহীন দেড় লাখ যানবাহন’ (যুগান্তর, ১৬ জুলাই, ২০১১) পুলিশের ‘নাকের ডগায়’ চলাচল করছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ চালকের লাইসেন্সই ভুয়া। আমাদের ভাষ্য : ভুয়া লাইসেন্স তো দেশ থেকেই পাচ্ছে ওরা। আর হেলপাররাও কম যায় না। ঠিকমতো হেঁটে রাস্তা পার হতে পারে না, তারা আবার গাড়ি চালায়। মানুষ ভরা বাস-ট্রাক চালিয়ে স্বপ্রশিক্ষণ নেয়। চালক তখন হয়তো মোবাইলে কথা বলে, নয়তো বিড়ি ফোঁকে। এর ফল দুর্ঘটনা। গাড়ি খাদে পড়ে, রাস্তায় কাত হয়ে পড়ে, শত শত মানুষ মারা যায়। মিরসরাইয়ের লোমহর্ষক দুর্ঘটনা এবং প্রায় অর্ধশত শিশুমৃত্যু তো ঘটলই অজ্ঞ, অদক্ষ ইবলিশ চালকের জন্য। ওদের প্রকাশ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত তাৎক্ষণিকভাবে। আইন-আদালত, পুলিশ কেইস ইত্যাদি করাটা সময়, জনশ্রম এবং অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

এক একটা রিপোর্টে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এমন সব কথা বলেন, যা শুনলে গায়ে জলবিছুটি লাগে। পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেছেন, জনবল সংকটে মহাসড়কে পুলিশের অভিযান জোরালো হচ্ছে না। এসব তো ধান্ধার কথা। তিনি আরও বলেছেন, পুলিশের জনবল এবং যানবাহন বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। পাঁচ কিলোমিটার পরপর একটি করে হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অপরাধীদের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ থাকার তথ্য পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে (যুগান্তর, ১৬ জুলাই, ২০১১)। কথাগুলো শুনতে শুনতে কানের ব্যামো হয়ে গেছে। বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান জানান, কোন রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করতে দেয়া হবে না।ঃ ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকদের শনাক্ত করার কাজ চলছে। বাকরোধ হয়ে যায় এমন বাকোয়াশি শুনলে। অনুমোদনহীন দেড় লাখ যানবাহন এবং লাখ লাখ ভুয়া লাইসেন্সের তথ্যটা যেন বাতাস। ওই দেড় লাখ যানবাহনের অনুমোদন নেই কেন? কেমন করে তারা রাস্তায় চলাচল করে? ওগুলো নিশ্চয় বুঁচি পেঁচি খাঁদু হাবুর গাড়ি নয়। অনুমোদনহীন গাড়ির চালকদের যে পাক্কা লাইসেন্স থাকবে, তেমন নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? সে কাজ তো বিআরটিএ’রই। ওই প্রতিষ্ঠান যখন বলে, ভুয়া লাইসেন্স শনাক্ত করার কাজ চলছে। কেমন লাগে শুনতে? ডিজিটাল বাংলাদেশে তো একটা ক্লিক করলেই ওসব তথ্য পাওয়ার কথা। তবে কি বিআরটিএ’র দফতরে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু হয়নি? সে কথাটা বরং শুনতে অনেক ভালো লাগবে। উল্টাপাল্টা বলার প্রয়োজন কী?

অন্যদিকে পুলিশের জনবল, গাড়ি এবং ফাঁড়ির কথা বলা হলেও জানানো হচ্ছে, দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি টেনে সরানোর জন্য উন্নতমানের রেকার নেই কোন মহাসড়কেই। একটা দুর্ঘটনা ঘটলে গাড়ি যদি রাস্তা থেকে পড়ে যায় তাহলে অন্য গাড়ি চলাচল অব্যাহত থাকে। আর যদি রাস্তার ওপর পড়ে থাকে বিধ্বস্ত গাড়ি, তাহলে দু’পাশ থেকে আসা গাড়ির বিশাল জ্যাম সৃষ্টি হয়। অবশ্য তাতেই বা কার কী? সে যাক, উন্নতমানের রেকার কেনাটা খুবই জরুরি বলে মনে করি আমি। আমাদের অবস্থাটা এমন, উঁচু দালানে আগুন লাগলে তা নেভানোর প্রযুক্তি নেই। উঁচু দালান ভাঙার জন্যও নেই আধুনিক কোন প্রযুক্তি। র‌্যাংগস ভবন ভাঙার সময় সেটা তো দেখেছি। এখন জানতে পারছি, দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহন টেনে সরানোর জন্য উন্নতমানের রেকারও নেই। রেল দুর্ঘটনা হলে তো আরও ছ্যারাব্যারা অবস্থা হয়। পুলিশের দফতরে দামি দামি বিলাসবহুল বহু গাড়ি তো ঠিকই আছে, নেই শুধু উন্নত রেকার! যানবাহনের মধ্যে রেলও তো আছে। রেললাইনগুলোর প্রধান সহায়ক শক্তি হল পাথরের টুকরো। শুধু লোহার পাত আর কাঠ বা লোহার স্লিপারের ওপর রেলের মতো ভারী যান চলাটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই পর্যাপ্ত পাথরের টুকরো লাইনের দু’পাশে ঠেসে রাখার নিয়ম। কিন্তু সে নিয়ম কে মানছে? রেল কর্তৃপক্ষের চোখ পড়েই না সেদিকে। রেল চলার সময় লাইন যেমনভাবে দেবে যায়, দেখলে ভয় লাগে। মাঝে মাঝে রেলবগি লাইনচ্যুত হওয়ার কারণই তো সেটা। হঠাৎ করে রেললাইন তো সরে যেতে পারে না। দেবে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে চাকা। আর তখন পড়ে যায় বগি। একটা বগি তো বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে না, কয়েকটা পড়ে যায় টানের চোটে।

যানবাহনের মধ্যে রেলই সবচেয়ে বড় এতিম। রেলের জমি দখল করে লোকে। স্লিপার তুলে আসবাবপত্র বানায়। পাথরগুলো নিয়ে ব্যবহার করে নির্মাণ কাজে। আগে রেলযাত্রা ছিল সবচেয়ে আরামদায়ক। এখন ঝুঁকিপূর্ণ। তার ওপর চুরি-ডাকাতির উৎপাত প্রতিষ্ঠিত। বড় যান বলেই হয়তো অনুমোদনহীন রেল চালানো সম্ভব হচ্ছে না। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর এমনিভাবেই গেল। কোন উন্নতি হল না রেল যাতায়াতের। তাহলে টঙ্গী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত শাটল ট্রেন চলতে পারত। উপকার হতো বহু মানুষের। বহুলাংশে কমত যানজট।

নদীমাতৃক দেশ এখন নদীখেকোর দেশ হয়েছে। নইলে টঙ্গীর তুরাগ নদী থেকে সদরঘাট পর্যন্ত চলতে পারত বহু নৌযান। তাতেও কমত যানজট। সেসব কথা না ভেবে শুধু সড়কপথের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছি আমরা। লঞ্চে এখনও যাতায়াত করে লাখ লাখ লোক। ঢাকা থেকে চলে যায় দক্ষিণাঞ্চলের দিকে। তাহলে ঢাকাবাসী কেন নৌপথে যাতায়াত করতে পারবে না। বিআইডব্লিউটিএ উদ্যোগ নেয় না কেন? দেশে খাতওয়ারি দফতর আছে। যেমন : সড়ক ও জনপথ দফতর, নৌপথ দফতর, রেলপথ দফতর ইত্যাদি। বিমানপথ আপাতত আকাশেই থাক। প্রতি দফতরে আছে পর্যাপ্ত লোকলস্কর। আছে কাজের দায়ভার। আছে দায়বদ্ধতা। অথচ ট্যাক্স দিয়ে, স্বপ্ন দেখে, কথা বলে, রাগ করে, লেখালেখি করে আমরা ঠকেই যাচ্ছি শুধু। কেন? কী দোষ করেছি আমরা? কেন আমাদের দুর্নীতির চক্রে পিষ্ট হতে হবে? আমাদের জীবনের এমন নিকৃষ্ট অপচয় কেন? কোনভাবেই যানজট নিরসনের উপায় বের করবে না কেউ, এটা কেমন কথা? যানজট কমানোর জন্য মনোরেল, পাতাল রেল, উড়াল সেতু, বহুতলা রাস্তা যবে হয় হোক গে। আমরা চাই যানজটের নিরসন। বাঁচতে চাই আয়ুক্ষয়ের হাত থেকে। তাই আশু তাগাদার ভিত্তিতে ত্রিমুখী চেষ্টায় রেল, নৌ এবং সড়কপথে যাতায়াতের সুষ্ঠু ব্যবস্থা হোক, এটাই আমাদের দাবি। আর একটা কথা। আইনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা মানে তদারকি ও বিচার হতেই হবে। তা সে যেই হোক। কথাটা অবশ্য বলা হয় বক্তৃতায়। নইলে ক্ষুব্ধ জনগণ হাতে তুলে নেবে আইন। পিটিয়ে মানুষ মারা দেখেও কি জ্ঞান হচ্ছে না আমাদের? এসব কিন্তু ভয়ানক বিপদের আলামত। একদিকে বস্তুগত চাপে আয়ুক্ষয়, অন্যদিকে ভয়ে কুঁকড়ে থাকা সারাক্ষণ। এ কি একটা জীবন হল? এর থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। তাই নড়েচড়ে বসতেই হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে। গালভরা কথা নয়। কাজ দেখতে চাই। আয়ুর সুরক্ষা চাই।

সূত্র: প্রিয় ডটকম ব্লগ