যৌন হয়রানি বিরুদ্ধে প্রয়োজন কঠোর আইন

মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিন ॥ প্রতিনিয়তই খবরের শিরোনাম হচ্ছে যৌন হয়রানির কোন ঘটনা। যৌন হয়রানির ছোবল থেকে  রক্ষা পাচ্ছে না কোমলতি শিশুরাও। সবগুলোই যে খবরের কাগজে কিংবা মিডিয়ায় আসছে তা নয়। সমাজের অনেক ঘটনাই অগোচরে, অন্তরালে থেকে যায়। গ্রাম্য মাতব্বরা ঘটনাকে থামাচাপা দেয়ার জন্য অপতৎপরতা চালান। ফলে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারীই পুনরায় নির্যাতিত হন যথাযথ বিচার না পেয়ে। যৌন হয়রানির পাশাপাশি যারা এর প্রতিবাদ করেন তারাও নির্যাতিত হন। তাদের কেউ কেউ প্রাণ হারিয়েছেন বখাটেদের অত্যাচারে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া তথ্যমতে, চলতি বছরে প্রথম থেকে জুন মাস পর্যন্ত যৌন হয়রানির কারণে দুশ’ ৭ জন নারী লাঞ্ছিত হয়েছেন। আÍহত্যা করেছেন ১৩ জন।  এছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন ২২৭ জন পুরুষ ও ৮ জন মহিলা। যৌন হয়রানির কারণে কোন না কোনভাবে প্রায় পাঁচশ’ ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ হিসাব পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী। কিন্তু মিডিয়ার অগোচরে যৌন হয়রানির বহু ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। বখাটেদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না অভিভাবকসহ শিক্ষকরাও। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থলসহ পথে-ঘাটে ঘৃণিত এই ঘটনার প্রতিনিয়তই মুখোমুখি হচ্ছেন নারীরা। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্টের দেয়া নীতিমালা অনুযায়ী নারীর শারীরিক ও মানসিক যে কোন ধরনের নির্যাতনই যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। ই-মেইল, এসএমএস, টেলিফোনে বিড়ম্বনা, পর্নোগ্রাফির যে কোন ধরনের চিত্র, অশালীন উক্তিসহ কাউকে ইঙ্গিপূর্ণভাবে সুন্দরী বলাও যৌন হয়রানির মধ্যে গণ্য হবে। শুধু কর্মস্থল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে না, রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় যে কোন ধরনের অশালীন উক্তি, কটূক্তি করা ও খারাপ দৃষ্টিতে তাকানোও যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে বলে হাইকোর্টের রায়ে উলে¬খ করা হয়। যৌন হয়রানির অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে কেউ কেউ বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ। ৩ অক্টোবরের পত্রিকার পাতার খবরঅনুযায়ী যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কিশোরী রুমা রানী দাস ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিশোরী মুন্নী আচার্য্য। শুধু এই দুই কিশোরীই নয়, যৌন হয়রানির কারণে দেশের অনেক মেধাবী তরুণীর প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে।

দেশে দু’বছরেরও বেশি সময় আগে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্ট একটি নীতিমালা প্রণয়ন করলেও তার পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের মহারাষ্ট্রে সম্প্রতি যৌন হয়রানি ও শ¬ীলতাহানিকে জামিন অযোগ্য করে আইন প্রণয়নের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আর সেখানে বাংলাদেশে এরকম একটি মারাÍক সামাজিক ব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার একটি কঠোর আইন পর্যন্ত করেনি।

যৌন হয়রানি রোধে এদেশে যে আইন আছে তা অনেক পুরনো ও যুগোপযোগী নয় বলে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। পত্রিকার মারফত জানা যায়, ১৮৬০ সালের তৈরি দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) অধ্যাদেশের ৭৬ ধারা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০-এ বিচ্ছিন্নভাবে যৌন হয়রানিমূলক কিছু কর্ম শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে তা যথোপযুক্ত নয়। ওইসব আইনে যৌন হয়রানির সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি। এমনকি শ¬¬ীলতাহানির বিষয়টি রয়েছে অনেক উপেক্ষিত। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতির কারণে এই যৌন হয়রানির ধরনেরও পরিবর্তন এসেছে। সঙ্গত কারণে যৌন হয়রানির জন্য কঠোর ও যুগোপযোগী আইন তৈরি ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সরকারকে কঠোর আইন প্রণয়নসহ তা বাস্তবায়নের উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। আইনের শাস্তির কথা প্রচারের মাধ্যমে এমন ঘৃণিত কাজ থেকে সবাইকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে। যারা উত্ত্যক্ত করে তারা এ সমাজেরই কারো কারো আত্মীয়। পারিবারিকভাবে তাদের সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও সাহায্য নেয়া যেতে পারে।

মূলত মানসিক পরিবর্তন না হলে এ ধরনের অপকর্ম রোধ করা কষ্টকর হলেও সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সোচচার হতে হবে সমাজের সর্বস্তরের সবাইকে। আর উত্ত্যক্তকারীর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই সমাজ থেকে এরকম ঘৃণ্য কাজ কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।