নিহত শিক্ষিকা শারমিনের স্বামীর ফরিয়াদ – ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন

সাইদুর রহমান স্বপন, আগৈলঝাড়াঃ ছয় বছরের দাম্পত্য জীবনে ওর সব কিছুই আজ আমার কাছে স্মৃতি। কারণ, ওর আচরণ ছিল বাচ্চাদের মত। সব সময় আমার খোঁজ খবর নিত। কোন বড় চাহিদা ওর ছিলনা, বাচ্চাদের মত আব্দার ছিল- মিমি চকলেট, চিপস, চানাচুর। এখনও ওর রক্ত মাখা ব্যাগে চিপস ও চানাচুর রয়েছে। আজ শুক্রবার ছুটির দিনে বাসায় থাকলে ও আমাকে জিজ্ঞেস করত কি খাবে, কি রান্না করব। ছয় মাসের অন্তঃস্বত্বা শারমিনের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যত ভেবে আমরা অনেক কিছুই স্বপ্ন দেখতাম। আর মাত্র ১১ দিন পর আগামি ২৬ অক্টোবর ছিল আমাদের ৫ম বিবাহ বার্ষিকী, সেদিন ও আমাকে ছুটি নিয়ে আসতে বলেছিল। আজ সে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। শ্বশুরের আগৈলঝাড়া প্রভাতি ফ্লাটের বাসায় বসে ছোট ভাই নাজমুল, শারমিনের বোন আইরিন জাহান ইনুর উপস্থিতিতে কথাগুলো বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন বুধবার ঘাতক আবুলের হাতে নিহত স্কুল শিক্ষিকা শারমিন আক্তারের স্বামী সেনা সদস্য জসিম উদ্দিন আনোয়ার সোহেল। কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি এসময় দেশের প্রচলিত আইনের মাধ্যমে হত্যাকারী আবুল ও তার গড ফাদারদের সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য প্রশাসনের কাছে দাবি জানান। পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকদের মাধ্যমে খুনি আবুলকে রিমান্ডে এনে তার মুখ থেকে গড ফাদারের নাম মামলায় অন্তর্ভুক্তিরও আবেদন করেন পুলিশ প্রশাসনের প্রতি।

আজ শুক্রবার সকালে উপজেলার দক্ষিন গৈলা গ্রামে নিহত স্কুল শিক্ষিকা শারমিনের পৈত্রিক বাড়িতে গেলে তার মা কামরুন নাহার রুমি সাংবাদিক আসার কথা জানতেই শারমিনের কবরের উপর থেকে দৌড়ে এসে হাউ মাউ করে কান্নায় ভেঙ্গেঁ পড়েন। তিনি তার মেয়ে হত্যাকারী আবুলের ফাঁসির দাবি জানান। এসময় তিনি বলেন, শারমিনের জীবনে এমন ঘটনা ঘটবে জানলে তাকে গ্রামে চাকুরি করতে আসতেই দিতামনা। শারমিন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিল। সে মতিঝিল মডেল স্কুল থেকে ৫ম শ্রেনীতে বৃত্তি পেয়ে ৯৯ সালে এসএসসিতে স্টার মার্ক ও এইসএসসিতে স্টার মার্ক পেয়ে ইংরেজিতে অনার্স পড়ার সময় চাকুরিতে প্রথম আবেদন করে। মেধাবি হওয়ার কারণে ওর চাকুরি হয় ৬ বছর আগে। ২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর সোহেলের সাথে বিয়ে দেই। আমরা শহরে থাকলেও চাকুরির কারনে ওকে এখানে থাকতে হত। আবুলের উত্যক্তর ঘটনা প্রায়ই শারমিন আমাকে ফোনে জানাত। শারমিনের কবর চাপড়ে ধরে তিনি বলেন, স্বামীর বাড়িতেই কবর হওয়ার কথা ছিল, ওর বাবার আকুতিতে শেষ পর্যন্ত জামাই রাজি হওয়ায় দাদা বাড়িতে শারমিনের কবর হয়েছে। তবে সোহেলের অনুরোধ, যেখানে শারমিনকে কবর দেয়া হয়েছে তার পাশে যেন সোহেলের কবরের জায়গা রাখা হয়। এদিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আলী আহম্মেদ আজ শুক্রবার গ্রেফতারকৃত আবুলকে ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।

শারমিন হত্যায় আগৈলঝাড়া সহ বরিশাল জেলা ও বিভিন্ন উপজেলায় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়ায় শারমিনের পরিবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। শারমিনের পেশাজিবী সংগঠন আগৈলঝাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ছাড়াও মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষক সমিতি ৭ দিনের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহন করেছে। এর সাথে একাত্মতা ঘোষনা করেছে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয়পার্টি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও পেশাজীবি সংগঠন। উপজেলার সর্বত্র এখন একমাত্র আলোচনার বিষয়বস্তু শারমিন হত্যাকান্ড। এদিকে শারমিন হত্যাকারী আবুলকে নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় যুবলীগ নেতা ও কর্মী হিসেবে আখ্যায়িত করার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন আগৈলঝাড়া উপজেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক ও ভাইস চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন সরদার। শুক্রবার দুপুরে দলের কার্যালয়ে এক সংবাদ সন্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি জানান, হত্যাকারী আবুল কখনও যুবলীগের ওয়ার্ড, ইউনিয়ন বা উপজেলার কোন কমিটিতে ছিলনা, আজও নেই। তিনি শারমিন হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করে শোকার্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন, আওয়ামীলীগ আহ্বায়ক ইউসুফ মোল্লা, আওয়ামীলীগ নেতা অধ্যাপক অপূর্ব লাল হালদার, মকবুল পাইক, যুবলীগ নেতা রফিক তালুকদার, সাইদুল সরদার, ছাত্রলীগ নেতা কামরুজ্জামান সেরনিয়াবাত, লিটন সেরনিয়াবাত প্রমুখ।

উল্লেখ্য, উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের দক্ষিন গৈলা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার সরদার শাহজাহান এর মেয়ে ও রাজিহার ইউনিয়নের মাগুরা গ্রামের ইসমাইল তালুকদারের ছেলে সেনা সদস্য জসিম উদ্দিন আনোয়ার ওরফে সোহেল তালুকদারের স্ত্রী পূর্ব সুজনকাঠী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শারমীন আক্তার গত বুধবার ১২ অক্টোবর বিকেলে স্কুল থেকে পাঠদান শেষে পায়ে হেটে নিজ ফ্লাটে ফেরার পথে উপজেলার গৈলা বাজারের পশ্চিম পাশে খলিফা বাড়ির ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় পূর্বে ওৎ পেতে থাকা মধ্য শিহিপাশা গ্রামের মৃত আকু চৌকিদার ওরফে গোমস্তার যৌন নিপিড়ক বখাটে ছেলে আবুল গোমস্তা দুই বছর যাবত প্রেম নিবেদন করে ব্যার্থ হয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে শারমিনকে উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা করে।