ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও খালেদাকে ক্ষমতায় চায়!

ফজলুল বারী, সিডনি: আসামের চরমপন্থী সংগঠন উলফা বাংলাদেশে খালেদা জিয়াকে আবার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতায় চায়। ভারতীয় সূত্রে এমন একটি খবর জানাগেছে। উলফার এই প্রত্যাশার কারণ খালেদা তাদের সামরিক প্রধান পরেশ বড়ুয়া বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে আশ্রয় দিয়েছেন। ভারতীয় রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথাবার্তায় মনে হয়েছে সেদেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরাও খালেদাকে ক্ষমতায় চান। কারণ তারা মনে করেন খালেদা মতো একজন চিহ্নিত ভারত বিরোধী দলের নেত্রী ক্ষমতায় থাকলে তাদের ব্যবসায় সুবিধা হয়। তারা শান্তিতে ব্যবসা করতে পারেন। এ দলটি ক্ষমতার বাইরে রাস্তায় থাকলে তাদের উল্টো অসুবিধা হয়!

এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হবার পর ১৯৯১ সালে নির্বাচনের আগ মুহুর্তে ত্রিপুরার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী ঢাকায় আসেন। তোপখানা সড়কের ওয়ার্কার্স পার্টির অফিসে এক সাংবাদিক বৈঠকে তিনি ভবিষ্যতবাণী করে বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় আসছে। উপস্থিত সাংবাদিকদের অনেকে তার কথা বিশ্বাস করেননি। কারণ বিএনপির ছাত্রসংগঠন শক্তিশালী থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠন তখন দূর্বল। তৃণমূল সংগঠনের বেশিরভাগ নেতাকর্মী এরশাদের জাতীয় পার্টিতে চলে গিয়েছিল।

কিন্তু সেই নির্বাচনে সত্যি সত্যি বিএনপি ক্ষমতায় গেলে নৃপেন চক্রবর্তির কথা মনে পড়ে। পরে একবার আগরতলা গিয়ে এমন নিখুঁত ভবিষ্যতবাণী কিভাবে করতে পেরেছিলেন জানতে চাইলে নৃপেন বাবু বলেন, আমি সেবার ঢাকা গিয়ে শুনলাম ভারতীয় মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের টাকা এ্যামবেসির মাধ্যমে বিএনপির ইলেকশন ফান্ডে দেওয়া হচ্ছে। ব্যস, তাতেই বুঝে গেলাম, কে কি চাচ্ছে! ২০০৫ সালে ভারতীয় জাতীয় নির্বাচন কভার করতে গিয়ে সেদেশের রাজনীতিক-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করেও একই  ধারণা হয়েছে।

বাংলাদেশে ভারতীয় ভোগ্যপণ্য রফতানির সঙ্গে জড়িত একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বলেন, আপনাদের বাংলাদেশে একদল মনে করেন ভারত সুযোগমতো বাংলাদেশে সৈন্য পাঠাবে বা বাংলাদেশ দখল করবে! এ ধারণা ভুল। আজকাল দুনিয়ার হিসাব পালটে গেছে। কেউ কোন দেশ দখল করে না। বাজার দখল করে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’ও এখন প্রতিবেশী দেশগুলোর বাজার দখলে থাকা নিয়ে চিন্তা করে বেশি। কে ক্ষমতায় থাকল কি না তা মুখ্যু বিষয় না। ভারতীয় ব্যবসা, ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ঠিকমতো রক্ষা হচ্ছে কি না সে চিন্তাই মুখ্য।

বাংলাদেশের বাজার পরিস্থিতি দিকে চোখ বুলালে এসব বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যাবে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় গন্ধযুক্ত আওয়ামী লীগ দেশের ক্ষমতায় তুলনামূলক কম সময় ছিল। বেশি সময় ছিল বিএনপি-জাতীয়পার্টি এসব চিহ্নিত ভারত বিরোধদল। কিন্তু তাদের সময়েই বাংলাদেশের বাজার ভারতের দখলে চলে গেছে। যা এখনও অব্যাহত আছে। এখন ঢাকায় এয়ারপোর্টে নামার পর থেকে সিএনজি অটো, ট্যাক্সিক্যাব থেকে শুরু করে ঘরে যাওয়া পর্যন্ত প্রায় সবকিছুই ভারতীয়। এসব লক্কড়ঝক্কড় গাড়ির একচেটিয়া বাজার করে দিতে গত বিএনপি আমলে জাপানি গাড়ির আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন চাল-পিঁয়াজ থেকে শুরু করে সবধরনের ভোগ্যপণ্যের স্থিতিশীল বাজার ভারত থেকে আমদানির ওপর নির্ভরশীল। দু’দেশের বাণিজ্য ঘাটতি শুধুই বেড়ে চলেছে।

সাবেক বিএনপি আমলেই হিসাবের গরমিলের ভুলে উলফার জন্য আনা দশ ট্রাক অস্ত্রের চালান ধরা পড়ে যায়। অনেকের ধারণা ওই ঘটনাটি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটায়। তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে র’র সখ্যের বিষয়টি প্রশ্নের মুখে পড়ে। এ বিষয়টি নিয়ে জোড়াতালির চেষ্টাগুলো আর কাজে লাগেনি।

ঢাকার ব্যবসায়ী সূত্রগুলো জানে ভারতীয় পণ্যে বাংলাদেশের বাজার সয়লাবের বড় একটি কারণ তাদের ইন্ডাস্ট্রিগুলো বড়। বিদ্যুৎসহ নানা অবকাঠামো তুলনামূলক ভালো হওয়াতে তাদের উৎপাদন ব্যয় কম পড়ে। বেশি বিক্রির স্বার্থে তারা প্রফিট মার্জিনও কম রাখে। এসব কারণে তাদের পণ্যের দামও এখানে তুলনামূলক কম। আর বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সহ নানান অবকাঠামোগত সমস্যা, আমলাতন্ত্র, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হানাহানি এসব নানা কারণে শুরুতেই পণ্যের উৎপাদন ব্যয়, বিক্রয়মূল্যও তুলনামূক বেশি পড়ে যায়। এই সূত্রগুলো মনে করে বাজারে গিয়ে সবাই সস্তার জিনিস কিনতে চান। দেশি পণ্য সস্তায় মিললে তারা তাই কিনবেন। গরিবকে দেশপ্রেমের মুলো দেখিয়ে লাভ নেই। সস্তায় মিললে দেশি পণ্যই তারা কিনবেন।

টাটার বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা বিএনপির সময়েই শুরু হয়েছিল। উইকিলিকসের নথিতে এ নিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান, শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর আগ্রহের খবর বেরিয়েছে। নিজামী শুরুতে এর বিরোধী থাকলেও টাটাওয়ালারা বিনিয়োগের কিছুটা তার নির্বাচনী এলাকায় খরচ করার টোপ দিলে তিনি টোপ গিলেন! কিন্তু পরে গ্যাসের দাম নিয়ে বনিবনা আর হয়নি।

বিএনপিসহ চিহ্নিত ভারত বিরোধী দলগুলোর আমলে উলফাসহ ভারতীয় উগ্রপন্থীদের বাংলাদেশে নিরাপদ অবস্থান একরকম ওপেন সিক্রেটই ছিল। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মনিপুরী, খাসিয়া সম্প্রদায়ের অনেকের সঙ্গে তারা মিলেমিশে থাকত। একই মঙ্গোলিয়ান আদিধারাভুক্ত হওয়াতে তারা দেখতে এই রকম। সাবেক বিএনপি আমলে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে একাধিকবার তাদের জনপ্রতিনিধিদের অপহরন করে নিয়ে আসা হয়। তখন সরকারি উদ্যোগে উলফার সঙ্গে আলোচনা করেই তাদের মুক্তি ও রাষ্ট্রীয় অতিথিভবনে অফিসিয়ালি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের ঘটনা ঘটেছে। এসব থেকে বরাবর মিডিয়ার লোকজনকে দূরে রাখা হয়েছে। মিডিয়ার লোকজন এসব বিষয়ে বেশি ঘাটাঘাটিতে গেলে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে তাদের দেশপ্রেম।

এর আগে এরশাদ ভারতীয় তরফের আস্থা অর্জনের জন্য কক্সবাজার হয়ে আনা একটি অস্ত্রের চালান ভারতীয়দের হাতে ধরিয়ে দেন। কিন্তু দশ ট্রাক অস্ত্রের চালানটি নিয়ে বিএনপি উল্টো ধামাচাপার চেষ্টা করাতে তাদের কী সর্বনাশ হয়েছে তা তারা জানে। বিএনপির নেতারা বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে আটককৃত সালাহউদ্দিন চৌধুরী উলফাসহ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থনে প্রকাশ্যে কথা বলতেন। উলফার নেতাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি হতো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তাদের মানবাধিকার দেখত বিএনপি নেতা নাজমুল হুদার সংগঠন বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থা। এসব নানা কারণে কৃতজ্ঞ উলফা স্বাভাবিক কারণেই খালেদা জিয়াকে আবার আসা করছে ঢাকার ক্ষমতায়।


ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
কন্ট্রিবিউটিং এডিটর
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম