ক্রসফায়ার ও কিছু কথা

মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিন, শাবি ॥ ঝালকাঠির লিমনের গুলিবিদ্ধ এবং পরে পঙ্গত্ববরণের ঘটনা সবার জানা। র‌্যাব গঠনের পর যেমন প্রশংসা পেয়েছে তেমনি কিছু কিছু কার্যক্রমও  আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। কলেজ পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে তার পায়ে গুলি করা হয়। নিরপরাধ কিশোর লিমনকে হারাতে হয়েছে একটি সবল পা কে। কী অপরাধ ছিল তাঁর? এমন প্রশ্নের উত্তর আজও কেউ পায়নি। পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের দিনমজুর তোফাজ্জল হোসেনের ছোট ছেলে লিমন। কাঠালিয়া পিজিএস কারিগরি কলেজের ইন্টারমিডিয়েটে অধ্যয়নরত। এ বছর ২৩ মার্চ বিকেলে লিমন বাড়ির পাশ্ববর্তী মাঠ থেকে গরু আনতে যায়। পথে স্থানীয় শহীদ জমাদ্দরের বাড়ির সামনে র‌্যাবের একটি দল তাকে সামনে পেয়ে শার্টের কলার ধরে নাম জিজ্ঞেস করে। লিমন নিজেকে ছাত্র এবং এবছর পরীক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দেয়। র‌্যাবের এক সদস্য কথাবার্তা ছাড়াই লিমনের বাঁ পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেন। লিমনকে প্রথমে বরিশাল শেরে-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এবং পরবর্তীতে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। চিকিৎসকেরা তাকে বাঁচাতে তাঁর পা কেটে ফেলেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সময়মতো চিকিৎসা পেলে হয়তো লিমনের পা কেটে ফেলতে হতো না। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করলে এই পায়ের ওপর ভর করে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত লিমন। কিন্তু তা আর হলো লিমনের। বাঁচার তাগিদে অনাগত দিনগুলোয় অন্যের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে লিমন। এ প্রসঙ্গে র‌্যাবের আইন ও জনসংযোগ শাখার পরিচালক কমান্ডার এম সোয়াহেল সাংবাদিকদের বলেছেন, এ রকম একটি পরিস্থিতিতে যেকোন পক্ষের কেউ আহত বা নিহত হতে পারে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে কেউ নিহত হয়নি, একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। অতীতে লিমনের মতো অনেকে কোনো অপরাধ না করেও র‌্যাবের হাতে নিগৃহীত হয়েছে। অনেকে কথিত ‘ক্রসফায়ারে’ প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু কোনো বিচার হয়নি। আর এবার প্রাণ হারালেন সাবেক ফুটবল খেলোয়াড় ও ব্যবসায়ী নিরপরাধী দু’ব্যক্তি। লিমনের মতো পঙ্গত্ববরণ করতে হয়নি তাদের। হাসপাতালে চিকিৎসাও নিতে হয়নি। খবরে প্রকাশ, ২২ অক্টোবর রাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন মিলন ও জিয়া নামের দুজন। নিহতদের পরিবার ও এলাকাবাসী জানিয়েছেন র‌্যাব যাদের ছিনতাইকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে গুলি করে হত্যা করেছে তারা এলাকায় নিরপরাধ ও ভালো হিসেবে পরিচিত। আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী কোনো কাজের সাথে তারা কখনোই জড়িত ছিলেন না। পুলিশের খাতায়ও তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। তারপরও র‌্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ প্রাণ হারালেন। স্ত্রীদের বিধবা আর সন্তানদের এতিম করার অপরাধে কাদের শাস্তি হওয়ার কথা? নিষ্পাপ শিশুদের কান্না আজ কী তারা শুনতে পাচ্ছেন?তাদের আর্তনাদের এলাকার পরিবেশ ভারি হয়েছে সেটাও কী জানতে পারবে? পরিবার দাবি করেছে, র‌্যাব একটি মহলের প্ররোচনায় ও অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ হয়ে গুলি করে হত্যা করে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বা ‘ক্রসফায়ারে’র নাটক মঞ্চস্থ করেছে। কুষ্টিয়া জেলার পুলিশ সুপার জানিয়েছেন নিহত দুই যুবকের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ ছিল না। নিহতরা হলেন কুষ্টিয়া জেলা ফুটবল দলের সাবেক খেলোয়াড় আব্দুস সালাম মিলন(৩২) এবং অপরজন সিএ ডিগ্রিধারী ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান জিয়া(৩৪)। উভয়ের বাড়ি কুষ্টিয়া শহরতলী চৌড়হাঁস মোড় এলাকায়। হত্যাকাণ্ডের পর র‌্যাব-১২ কুষ্টিয়া ইউনিট এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ২২ অক্টোবর শনিবার রাত ২টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা জানতে পারেন, একটি সিএনজি ছিনতাইকারী চক্র সিএনজি ছিনতাই করে আসছে। এ সময় ডিএডি লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বে র‌্যাব সদস্যরা সদর উপজেলার সস্তিপুর গ্রামের কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের পাশে চেক পোস্ট বসান। একটি সিএনজি থামানোর জন্য সিগন্যাল দেয়া হলে সিএনজি না থামিয়ে দ্রুত পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় ওই সিএনজির পিছু নিলে সিএনজিতে অবস্থানকারীরা র‌্যাবকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় র‌্যাব সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালান। গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে সিএনজিতে থাকা কয়েকজন ছিনতাইকারী পিছু হটে পালিয়ে যাওয়ার সময় সিএনজি উল্টে যায়। এ সময় গোলাগুলির শব্দ পেয়ে সদর থানার পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পান দুজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে রয়েছেন। সকালে খবর পেয়ে নিহতদের স্বজনরা হাসপাতালে এসে লাশ শনাক্ত করেন। নিহত যুবক মিলনের বড় ভাই আলম জানান, মিলন কুষ্টিয়া জেলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় ছিলেন। তার সাথে কারো কোনো শত্র“তা ছিল না। নিহতদের দুই পরিবারই দাবি করেছে, জিয়া ও মিলন কোনো অপরাধের সাথে জড়িত ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলাও নেই। জিয়ার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মুসলিমা খাতুন এবং জিয়ার মা ও ভাই মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বন্ধু প্রিন্স ও আশরাফুজ্জামানের সাথে জিয়ার ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল। জিয়া তাদের কাছে ৩০ লক্ষ টাকা পেতেন। এ ব্যাপারে একটি মামলাও বিচারাধীন ছিল। কেউ অপরাধ করলে তাঁর বিরুদ্ধে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু তাই বলে বিচারের আগে কাউকে শাস্তি দিতে পারে না। লিমনের মতো অনেকেই আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন সব ঘটনাগুলো মিডিয়ায় প্রচার হয় না। আর সাধারণ জনগণও জানতে পারে না। র‌্যাবের মহা পরিচালকের কথা অনুযায়ী লিমন সন্ত্রাসী নয়। তাহলে কেন পুলিশ লিমনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে? র‌্যাবের ‘ক্রসফায়ার’ এর পরে যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় তার সবগুলোর কাহিনী একই রকম এটা আর বলার প্রয়োজন নেই। যখন চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা এ ঘটনায় শিকার হন তখন সাধারণ জনগণের কোন অভিযোগ থাকার কথা নয় কিন্তু যখন এই ‘ক্রসফায়ারে’ নিরপরাধ ব্যক্তিরা নিহত হন তখন নানা প্রশ্নই জন্ম দেয়। যাদের বিরুদ্ধে থানায় একটি সাধারণ ডায়রি পর্যন্তও নেই তাদের বুকে গুলি চালাতে র‌্যাব সদস্যদের বুক কী একটু কাঁপে না। যে বুলেট সাধারণ জনগণের করের টাকায় কেনা সেই বুলেট ওইসব সাধারণ জনগণের বুকে? আর কত মায়ের বুক এভাবে শূন্য হবে? কত সন্তান তাদের বাবাবে হারাবে? কুষ্টিয়ায় যাদের  হত্যা করা হলো ধরে নিই তারা ছিনতাইকারী। কিন্তু তাদের কী থানায় সোপর্দ করা যেত না? বিচারের অধীনে কী তাদের শাস্তি দেয়া যেত না? পরিশেষে আর কোন নিরপরাধ ব্যক্তিই যাতে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হাতে শাস্তি না পায় সে ব্যাপারে সবার দৃষ্টি কামনা করি। বিচার বিশ্লেষণ করে এবং আইন মোতাবেক অপরাধী শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা করা হোক। মিলন ও জিয়ার মতো কিংবা লিমনের মতো আর কাউকেই যেন এমন ভাগ্যবরণ না করতে হয় সে ব্যাপারে সবাই সতর্ক থাকবে এমনটি প্রত্যাশা সাধারণ জনগণের।