টিপাইমুখ নিয়ে কারও নীরবতা কারও রাজনীতি

কাজী সিরাজঃ টিপাইমুখ বাঁধ প্রশ্নে সরকারের ভূমিকা শুধু রহস্যময়ই নয়, দেশের জনগণের আকাক্সক্ষারও পরিপন্থী। বিএনপিসহ (রাজনৈতিক কারণে হলেও) দেশের প্রায় সব বিরোধী দল, সুশীলসমাজ এবং সর্বশ্রেণীর দেশপ্রেমিক মানুষ ভারতীয় এ সর্বনাশা পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে। সিলেটে পালিত হচ্ছে আন্দোলনের অবিরাম কর্মসূচি। এহেন পরিস্থিতিতে দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার দেশপ্রেমিক ভূমিকা ও জাতীয় উদ্বেগে বিচলিত লীগ সরকার গণরোষ প্রশমন ও আত্মরক্ষার জন্য ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে দুজন দূত পাঠিয়েছিল। দুজনই ভীষণ বিতর্কিত। একজন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী। তিনি একজন অবাঙালি। জানা গেছে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ প্রদানকারী ঢাকার তৎকালীন অবাঙালি ডিসি মি. কোরাইশী তার মামা। বাংলাদেশে থেকেছেন খুবই কম। দীর্ঘদিন ইউএনডিপি'র প্রতিনিধি হিসেবে তিনি অবস্থান করেছেন ভারতে। অপরজনও প্রধানমন্ত্রীর আরেক উপদেষ্টা মশিউর রহমান। আমলা বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। যে ক'জন সচিব ওই সময় (বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের শেষ সময়) প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বঙ্গবভনে সাক্ষাৎ করে একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের সহযোগিতা করবেন না বলে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিলেন তিনি তাদের অন্যতম। এদের বিরুদ্ধে শাসক দল এবং জোটেও কঠোরভাবে সমালোচনা হচ্ছে।

বলা হচ্ছে, এসব উপদেষ্টা (এইচটি ইমামের কথাও বলা হয়) অনির্বাচিত হয়েও প্রধানমন্ত্রীকে নাকে রশি দিয়ে ঘোরাচ্ছেন, নির্বাচিত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরও কোনো ভূমিকা রাখতে দিচ্ছেন না। ফলে একদিকে সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নানা বিতর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে এবং দিন দিন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। দিলি্ল থেকে ফিরে গত ৪ ডিসেম্বর গওহর রিজভী বলেছেন, 'বরাক নদীতে এমন কোনো স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে না, যার ফলে বাংলাদেশের ক্ষতি হতে পারে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, টিপাইমুখে কোনো বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে না। সেখানে স্থাপন করা হচ্ছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ভারত সরকার এ বিষয়ে সব তথ্য বাংলাদেশকে দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এমন কোনো অ্যাকশন নেবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। যেদিন বাঙালির প্রতিনিধি(?) অবাঙালি গওহর রিজভীর এ বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, সেদিনই খবরের কাগজে পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের একটি বক্তব্যও প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, 'টিপাইমুখ বাঁধ হবেই।' এর অর্থ কি? ভারত থেকে আশ্বাসের ললিপপ চুষতে চুষতে বাংলাদেশে এসে গওহর রিজভী আমাদের যে সান্ত্বনার বাণী শোনালেন মনমোহন সিংয়ের জোরালো বক্তব্যের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের জন্য মরণফাঁদ ফারাক্কা বাঁধ নিয়েও ভারত একই রকম আশ্বাস দিয়েছিল। বলেছিল, পরীক্ষামূলকভাবে ৪০ দিনের জন্য এ বাঁধ চালু থাকবে। বাংলাদেশের ক্ষতি হলে তা চালু রাখা হবে না। আর কিছুদিন পর এ বাঁধের ৪০ বছর হয়ে যাবে, কিন্তু ভারত সরকারের ৪০ দিন আর শেষ হলো না। এদিকে ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল প্রায় মরুভূমি।

নদ-নদীতে যেখানে নৌকা-লঞ্চ-স্টিমার চলার কথা, সেখানে এখন ধু ধু বালুচর। জলযানের স্থলে চলে স্থলযান। ফারাক্কার 'ছোবলে' দক্ষিণাঞ্চলেও লবণাক্ততা বাড়ছে নদীর পানিতে। আমাদের ঐতিহ্যমণ্ডিত সুন্দরবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলও চরমভাবে আক্রান্ত। ফারাক্কায় পানি প্রত্যাহারের ফলে মিঠাপানির আকাল দেখা দিয়েছে। এই তো আমাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ! এর বিরুদ্ধে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিল করেছিলেন ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে উঠেছিল ফারাক্কার বিষয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে তখন ফারাক্কার পানিবণ্টন চুক্তি হয়েছিল ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে। ৪৪ হাজার কিউসেক পানি দিতে সম্মত হয়েছিল ভারত। চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ ছিল। চুক্তি ভঙ্গ করলে আবার আন্তর্জাতিক ফোরামে যেতে পারত বাংলাদেশ। এরশাদের আমলে সেই চুক্তি নবায়নে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। ফলে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। শেখ হাসিনার প্রথম আমলে (১৯৯৬-২০০১) ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা নিয়ে একটি পানি চুক্তি হয়েছে বটে, কিন্তু সেই চুক্তির পানি জাতীয় সংসদে শাসক দলের মন্ত্রী-মিনিস্টার আর সংসদ সদস্যদের বক্তৃতাতেই কলকল করে প্রবাহিত হয়, নদীতে বোধ হয় পাওয়া যায় না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও ভারতের প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশ কি করে আশ্বস্ত হবে? ভারত এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে এ পর্যন্ত কোনো তথ্যই সরবরাহ করেনি। অথচ ইতোমধ্যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে ভারতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও রাজ্যের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।

বলা হচ্ছে, সেখানে কোনো বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করা হবে না। নির্মিত হবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। কিন্তু পানির গতি স্বাভাবিক রেখে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প কীভাবে হবে? তাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না তা ভারত কি করে বলছে? এ ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে কোনো সমীক্ষা হয়নি। এর আগে আবার যখন টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে কথা উঠেছিল তখন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ভারত গিয়েছিল সবকিছু জানতে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই প্রতিনিধি দল টিপাইমুখ অঞ্চল পরিদর্শনই করেনি। বলা হয়েছে, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তারা সেখানে যেতে পারেননি। ফলে তারা এসে যে রিপোর্ট দিয়েছেন তাতে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা দূর হওয়া তো দূরের কথা টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণাই পাওয়া যায়নি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে চিঠি দিয়েছিলেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী যথারীতি তার জবাবও দিয়েছেন। এ চিঠি চালাচালি নিয়ে বিএনপি অযথা নাটক না করলেও পারত। বিরোধীদলীয় নেতা রোডমার্চ শেষ করে যখন খুলনার জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন মনমোহন সিংয়ের চিঠি বিএনপির হাতে। 'চিঠির মুখ' খোলা না হওয়ার অজুহাতে জনসভায় উপস্থিত বিশাল জনতাকে কিছু জানাতে পারেননি বেগম খালেদা জিয়া। এটা কোনো বিশ্বাসযোগ্য কথা? ঢাকায় এমন কোনো লোকই কি ছিল না চিঠিটি খুলে বিষয়বস্তু তার দলনেত্রীকে জানানোর মতো। সন্দেহ এখানেই যে, বিষয়টি সমাধান করার ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে তারা রাজনীতি করছেন। কেউ রহস্যময় ভূমিকা পালন করবেন আর কেউ স্বার্থের খেলা খেলবেন, তাহলে দেশ ও জাতির দিকটা দেখবে কে?

টিপাইমুখ বাঁধ হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম একটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায়। এতে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভূমিকম্পে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। আর পানি যদি আটকে দেওয়া হয় তাহলে বাংলাদেশের যে ফসলহানি ঘটবে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রায় তিন কোটি বাংলাদেশি। এ ভয়াবহ ক্ষতির দিক বিবেচনা করে সরকার ও বিরোধী দলের কার্যকর এবং সাহসী ভূমিকা পালন করা জরুরি। হাসি পায় যখন বিরোধী দল সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করে বলে, 'এ কারণেই ভারত আমাদের জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ করে যাচ্ছে একের পর এক। প্রশ্ন হলো, তারা কি করেছেন এবং করছেন। টিপাইমুখ ইস্যু এই সরকারের আমলে সৃষ্ট নয় অনেক আগের, তখন বেগম জিয়ার সরকার ক্ষমতায় ছিল। তারা এ কাজ থেকে ভারতকে বিরত রাখার জন্য কি করেছেন? এখনইবা কি করছেন? জনমনে তাই এ সন্দেহ থেকে যায় যে, প্রধান দুই দল কি পানি সমস্যাসহ বিরোধীয় ইস্যুগুলো সমাধানে ভারতের সঙ্গে আলোচনা এবং একটা সমঝোতায় পেঁৗছতে আন্তরিক ও সক্ষম? তা হলে? পথ একটাই। দেশপ্রেমিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করা, প্রতিরোধ গড়া। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের ওপর এমন প্রবল চাপ সৃষ্টি করা এবং বলা যে, অনেক হয়েছে। জাতির জীবন-মরণ সমস্যাকে নিজেদের গদি রক্ষার বা দখলের রাজনীতির বিষয় বানাবেন না। প্রধান দুই দল টিপাইমুখ সম্পর্কে ভালো করে জানুন; কি জানলেন, কি বুঝলেন জাতিকে স্পষ্ট করে জানান এবং করণীয় নির্দেশ করুন। তা না হলে দেশ ও জাতিকে মাফ করে দেন, মানুষ তৃতীয় বিকল্প খুঁজুক।