কম্পিউটার ভাইরাস বৃত্যান্ত

মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেনঃ কম্পিউটারের পরিভাষায় ভাইটাল ইনফরমেশন রিসোর্সেস আন্ডার সিজ (Vital Information Resources Under Seize) এর সংক্ষিপ্ত রুপ হলো ভাইরাস (VIRUS)। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ উৎসগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। প্রখ্যাত গবেষক ‘ফ্রেড কোহেন’ ভাইরাসের নামকরণ করেন। যারা কম্পিউটার ব্যবহার করেন সকলেই ভাইরাসের ব্যাপারে আতঙ্কিত থাকেন। কম্পিউটার ব্যবহার করেছেন কিন্তু ভাইরাসের সম্মূখীন হননি এমন কাউকে পাওয়া সত্যিই ভার। প্রায় সব কম্পিউটার ব্যবহারকারীই ভাইরাসের দ্বারা কম বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। ভাইরাস নিয়ে রয়েছে অনেক জল্পনা-কল্পনা। কম্পিউটারের ভাইরাস জীবন্ত কোন অর্গানিজম (Organism) নয়, কিন্তু এটি এমন এক ধরনের প্রোগ্রাম (কম্পিউটারের মাধ্যমে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় নিদের্শমালার সমষ্টিকে প্রোগ্রাম বলা হয়, কিন্তু সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে যদি সমস্যা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নিদের্শমালা প্রদান পূর্বক প্রোগ্রাম তৈরী করা হয় তখন তাকেই আমরা ভাইরাস বলি) যা কম্পিউটারে জীবন্ত প্রাণীর মতই আচরণ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভাইরাসের কারণে যেমন জীবের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে, ঠিক তেমনি কম্পিউটারটি ভাইরাসের আক্রমনে অকেজো হয়ে যেতে পারে। তবে কম্পিউটারের এই ভাইরাস মানুষের দ্বারাই তৈরি প্রোগ্রাম যা ব্যবহারকারীর অনুমতি বা ধারণা ছাড়াই স্বংয়ক্রিয়ভাবে এক্সিকিউট (Self Executed/Auto Run) হয়, সংক্রমন (Self Extracted) ও বংশবৃদ্ধি (Self Replicated) করে। কম্পিউটার হ্যাকার তথা ক্রিমিনালরা প্রতিনিয়ত নতূন-নতূন ভাইরাস তৈরী করছে। ভাইরাসের প্রথম ভয়ংকর দিকটি হচ্ছে এরা কম্পিউটার ব্যবহারকারীর অগোচরে নিজেরা নিজেদের কপি তৈরি করতে পারে। শুধু তাই নয়, এরা অন্য একটি প্রোগ্রামের সাথে সংযুক্ত হয়ে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারে। কম্পিউটারে বিভিন্ন মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াতে পারে। সাধারণতঃ পেড্রাইভ, সিডি, লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক বা লেন, ইন্টারনেটে ফাইল/ডাটা সেয়ারিং করার সময়ে বা কোন একটি সফ্টওয়্যারের অংশ হিসেবে কম্পিউটারে প্রবেশ করে তথ্য মুছে ফেলা থেকে শুরু করে, অপারেটিং সিস্টেম অকেজো করে দেওয়া বা মুছে ফেলা এবং অন্যান্য সিস্টেমে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। নির্দিষ্ট কোন লক্ষণ দ্বারা কম্পিউটার ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব নয়। লক্ষণসমূহ ভাইরাস প্রোগ্রাম ডিজাইনার (হ্যাকার তথা ক্রিমিনাল) যে ভাবে চেয়ে থাকে সে ভাবেই প্রকাশ পায়। অনেক ভাইরাস কোন লক্ষণ প্রকাশ করা ছাড়াই ব্যাকগ্রাউন্ডে থেকে কম্পিউটারের ক্ষতি সাধন করে অথবা তথ্য পাচার করে। তবে কম্পিউটার অস্বাভাবিক আচরণ করলেই ভাইরাস আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা যায়। বিভিন্ন রকমের ভাইরাস আছে। একেকটা ভাইরাসের আক্রমণ কৌশল একেক রকমের। লক্ষণসমূহের মধ্যে কয়েকটি হলো- কম্পিউটার স্লো হয়ে যাওয়া তথা কোন প্রোগ্রাম লোড/রান হতে অস্বাভাবিক সময় নেয়া; স্টোরেজ ডিক্সের ভলিউমের নাম পরিবর্তন হতে পারে; হার্ডডিক্সে ব্যাড সেক্টর দেখা দিতে পারে; ডট ইএক্সই (.exe) ফাইলের আকার পরিবর্তন হতে পারে; সিস্টেম এর সময় ও তারিখ এর অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন হতে পারে; কোন কারণ ছাড়াই মেমোরী থেকে ফাইল ডিলিট হয়ে যেতে পারে; সিস্টেম এর সেটিং স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তন হতে পারে; ডিসপ্লে রেজুলেশন তথা সেটিং পরিবর্তন হতে পারে; ফোল্ডার অপশন হাইড হয়ে যেতে পারে; ফ্রি মেমোরী স্পেস পরিমানে কম দেখাতে পারে; হার্ডডিক্সের পার্টিশন নষ্ট হয়ে ডাটা হারিয়ে যেতে পারে; কম্পিউটারের বায়োস (BIOS) এর ডেটা মুছে ফেলে কম্পিউটার অচল করে দিতে পারে; হঠাৎ বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত ইরর মেসেজ দিতে পারে; প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সফ্‌টওয়্যার ইন্সটল হতে সময় নেবে অথবা হবেনা; যে কোন সময় কম্পিউটারকে হ্যাং (Hang) করে দেয় অথবা হঠাৎ রিস্টার্ট (Restart) করে দেয়, ফলে আনসেভ যে কোন ডকোমেন্ট হারিয়ে যায়। এছাড়া ও বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে। এসব লক্ষণ প্রকাশ পেলে ধরে নেয়া যায় কম্পিউটারটি ভাইরাসে আক্রান্ত।

যদি এমন হয়, আপনার সন্তান আপনার পিসিতে নূতন একটি গেইম ইনস্টল করেছে যার সাথে একটি ভাইরাসও ইনস্টল হয়ে গেছে এবং এই ভাইরাসটির কাজ হচ্ছে ফাইল মুছে দেওয়া। এক সকালে পিসি চালু করে আবিষ্কার করলেন যে, আপনার পিসিতে রক্ষিত সকল ফাইল গায়েব। মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে তখন? অন্যদিকে, ই-মেইলও হয়ে উঠতে পারে আপনার পিসির জন্য ভয়ানক একটা কিছু। এমনও হতে পারে যে, আপনি পরিচিত কারো একটি ই-মেইল পেলেন এবং ই-মেইলটি খোলার সাথে সাথেই হয়তবা ই-মেইলে সংযুক্ত একটি ভাইরাস আপনার অগোচরে কাজ করা শুরু করে দিল। এটি এমন একটি ভাইরাস হতে পারে যার কাজ হল আপনার পিসিতে রক্ষিত সব ফোল্ডারের ব্যক্তিগত তথ্য আপনার অ্যাড্রেস বুকে সংরক্ষিত সব ই-মেইল অ্যাড্রেসে পাঠানো শুরু করে দেয়া। সুতরাং বুঝকেই পারছেন, ভাইরাসের কর্মকান্ড কতধরনের হতে পারে।

বিখ্যাত গণিতবিদ জন ভন নিউম্যান (John Von Neumann) সর্বপ্রথম ১৯৪৯ সালে একটি প্রোগ্রাম কীভাবে নিজে নিজের আরেকটি কপি তৈরি করতে পারে (Self-replicating) তা সম্পর্কে বলেন যদিও তখনো কম্পিউটার ভাইরাস শব্দটির সাথে কেউই পরিচিত হননি। তারপর সত্তর দশকের প্রথম দিকে আরপানেট-এ (ARPANET) প্রথমে ক্রিপার ভাইরাস (Creeper VIRUS) ধরা পড়ে। এটাও ছিল একটি সেলফ-রেপ্লিকেটিং প্রোগ্রাম এবং এটা লিখেন বব থমাস (Bob Thomas) ১৯৭১ সালে। তখন অপারেটিং সিস্টেম ছিল টেনেক্স (TENEX) আর ক্রিপারের কাজ ছিল অন্য একটি সিস্টেমে গিয়ে নিজের একটি কপি তৈরি করা ও একটি মেসেজ দেখানো, "I'M THE CREEPER: CATCH ME IF YOU CAN."। এটিকে প্রতিহত করার জন্য তৈরি হয় রিপার )Reaper) যার কাজ ছিল ক্রিপার-কে মুছে ফেলা। পিসির প্রথম ভাইরাস তৈরি হয় পাকিস্তানের লাহোরের ফারুক ভ্রাতৃদ্বয়ের হাতে। বাসিত ফারুক আলভি )Basit Farooq Alvi) ও আমজাদ ফারুক আলভি) Amjad Farooq Alvi) নামে দুই ভাই মিলে বুটসেক্টর (Boot Sector) ভাইরাস ‘ব্রেন’ (Brain) লিখেন ১৯৮৬ সালে। অবশ্য তাদের মতানুযায়ী তারা এটা লিখেছিলেন সফটওয়্যার পাইরেসি রোধ করার জন্য। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আর থেমে থাকেনি, তৈরি হচ্ছে নূতন-নূতন ভাইরাস।

১৯৯৯ এর ২৬শে এপ্রিল বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে লক্ষ লক্ষ কম্পিউটার CIH বা চেননোবিল নামক ভাইরাসের আক্রমণে বিপর্যয়ের সম্মূখীন হয়। টাইম বোমার মতো নির্দিষ্ট সময়ে এ ভাইরাসটি কম্পিউটারকে আক্রমণ করে। একই সময়ে সারাবিশ্বে  ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার এটাই সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। কম্পিউটার সিস্টেমে সময় ও তারিখের জন্য ঘড়ি সেট করা আছে। ঘড়ির কাটায় ২৬শে এপ্রিল, ১৯৯৯ হওয়ার সাথে সাথে কম্পিউটারে লুকায়িত সিআইএইচ ভাইরাস বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশসহ বিশ্বে লক্ষ লক্ষ কম্পিউটার অচল হয়ে পড়ে। পশ্চিমাদেশগুলোর তুলনায় এশিয়ার বিপর্যয়ের মাত্রা ছিল অনেক ভয়াবহ।

ভাইরাসকে প্রতিরোধ করা ও ধ্বংস করার জন্য কোম্পানিগুলোও বসে নেই। তারা বের করে চলছে একের পর এক অ্যান্টিভাইরাস, সেগুলির আবার আপডেটেড ভার্সন। তারপরেও রক্ষা হয় না, কম্পিউটার ধীরগতির হয়ে যাওয়া, হ্যাং বা ফ্রিজ হওয়া, হার্ডড্রাইভ ক্রাশ – এগুলোতো লেগেই আছে। তাই বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ভাইরাস সম্পর্কে জানাটা খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। কথায় আছে, সমস্যা সমাধাণের আগে সমস্যাটা ভালো করে বুঝতে হবে, তারপরেই শুধুমাত্র চমৎকার একটি সমাধান পাওয়া যাবে। সচেতন থাকলে ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব। ভাইরাস নিরসনের জন্য দরকার শক্তিশালী, আপডেটেড ও ভালো মানের এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার। মনে রাখতে হবে প্রতিকার করা থেকে প্রতিরোধ করাই উত্তম। ভাইরাস এর হাত থেকে রক্ষা পেতে যে সব সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার তার কয়েকটি হল- যতদূর সম্ভব বাহিরের কোন পেনড্রাইভ ব্যাবহার না করা; অন্যথায়, পেনড্রাইভ ব্যাবহারের পূর্বে ভাইরাস স্ক্যান করে নেয়া; পেনড্রাইভ মাউসে ডাবল ক্লিক করে ওপেন না করে বরং এক্সপ্লোর করে বা ফোল্ডার থেকে ওপেন করা; ইন্টারনেট  থেকে অপরিচিত কোন ফাইল অথবা ডট ইএক্সই (.exe) এক্সটেনসন যুক্ত অপরিচিত কোন  ফাইল ডাউনলোড  করা থেকে বিরত থাকা; ভালো মানের ও আপডেটেড ভাইরাস স্ক্যানার (এন্টিভাইরাস) ব্যাবহার করা; ইন্টারনেট থেকে প্রতিদিন ভাইরাস স্ক্যানার আপডেট করা; ভাইরাস সংক্রমিত সফট্ওয়ার ব্যাবহার করা থেকে এবং ইনইস্টল করা থেকে বিরত থাকা।

কম্পিউটার ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে শক্তিশালী, আপডেটেড ও ভালো মানের ভাইরাস স্ক্যানার (এন্টিভাইরাস) ব্যাবহার করে স্ক্যান করতে হবে। তবে প্রচলিত প্রোগ্রাম দ্বারা ভাইরাস মুক্ত করা না গেলে ফাইল ডিলিট করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। অনেক সময় ডিক্স ফরমেট করা প্রোয়োজন হতে পারে এমন কি নতূন করে অপারেটিং সিস্টেম ইনস্টল করা লাগতে পারে।  

লেখকঃ প্রোগ্রামার, আইএমইডি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।