ছবি যে মনের কথা বলে

ফজলুল বারী, সিডনিঃ দূর থেকে আর কিছু করার নেই তো! সারাক্ষণ দেশটারে ফিল করি। নিউজ-ছবিগুলো দেখি। মুক্তিযুদ্ধের নেতা শেখ হাসিনা আব্দুর রাজ্জাকের মরদেহে দোয়া করছেনআব্দুর রাজ্জাকের মরদেহ ঢাকায় পৌঁছানোর পর এয়ারপোর্টে হুমড়ি খাওয়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কান্নাকাটির ছবি সব খুঁটিয়ে দেখছিলাম।

এভাবে বিমান থেকে মরদেহ নামানোর ছবি আমরা আর কী আগে কখনো দেখেছি? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। ছবির চেহারাগুলো দেখছিলাম। আওয়ামী লীগের খুব পরিচিত প্রায় সবক`টি মুখ! আগের রাজপথের পোড় খাওয়া মুখগুলোর কিছু ক্ষমতার কারণে একটু ভিন্ন, নাদুস-নুদুস!

রাজ্জাক ভাই’রও খুব পরিচিত, ঘনিষ্ঠ, প্রিয় সব মুখ! কিন্তু এতদিন চাকরির ডরে  মুখগুলোর প্রায় সব একটু অন্যদিকে ঘুরিয়ে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আর কি! চাকরি হারানোর ভয়ে একটু উফ-আহ করার চান্সও পাননি! সে কারণে এয়ারপোর্টের ছবির মানুষগুলোর চেহারাতেও যেন এক ধরনের অপরাধবোধ! কেউ যদি আবার জিজ্ঞেস করে বসেন, এতো দিন কোথায় ছিলেন? কেউ না হোক, বিবেক যদি জিজ্ঞেস করে বসে? বিবেকের দায় থেকে তো মুক্তি নেই কারো!

বলাবাহুল্য, তাদের এই ভয়টি স্বরচিত নয়। আরোপিত। ভয় ধরিয়ে  দিয়েছিল আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। অর্থাৎ শেখ হাসিনা! কোনো প্রেস রিলিজ বা দলীয় ফরমানের মাধ্যমে নয়। ইঙ্গিতে। গত নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ ভোটে নির্বাচিত শেখ হাসিনা তার ভাষায় ` বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর` আটবারের নির্বাচিত আব্দুর রাজ্জাককে মন্ত্রিসভায় জায়গা দেননি। জায়গা দিয়েছেন পদ্মাসেতু আটকে দেওয়া আবুলদের!Freedom Fighter Abdur Razzak

এরপর আর কী আর কাউকে আলাদা করে আজান দিয়ে কিছু বলে দেওয়া লাগে? বাংলানিউজে বিলাতপ্রবাসী সৈয়দ শাহ সেলিম আহমদের লেখাটি পড়ে চোখ ভিজে আসে। বিলাতে চিকিৎসার জন্যে কতো আশা নিয়ে গিয়েছিলেন আব্দুর রাজ্জাক! মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি বিলাত। সেখানেও প্রবাসী নেতারা তাকে কেমন নিষ্ঠুরভাবে এড়িয়ে চলছিলেন! কারণ, তিনি যে সংস্কারবাদী!

একই ভয়ে তাকে এড়িয়ে চলেছে হাই-কমিশন! সৈয়দ শাহ সেলিম আহমদ আক্ষেপ করে লিখেছেন, অথচ বিলাতে বা বিদেশে যারা আওয়ামী লীগ বা অন্যান্য রাজনৈতিক দল করেন, তারাতো কিছু পাবার আশায় করেন না। উল্টো তারা দলকে দেন। নানা ইস্যুতে মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড চ্যারিটির ফান্ড জোগাড় করে বিলাতের সব বাংলা টিভি চ্যানেল।

সেখানকার আওয়ামী লীগ চাইলে আব্দুর রাজ্জাকের চিকি‍‍ৎসার টাকা জোগাড় করাও ছিল কয়েক ঘণ্টার  ব্যাপার। কিন্তু উল্টো ‘তিনি সংস্কারবাদী’–এই চিন্তায় তারা তাকে নিষ্ঠুরভাবে এড়িয়ে চলেছে। মূলত ঢাকা থেকে সবুজ সংকেত পাবার পরেই আব্দুর রাজ্জাকের ব্যাপারে বিলাতের বাংলাদেশ হাই-কমিশন ও সেখানকার আওয়ামী লীগের নেতারা সক্রিয় হন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ! প্রায় অস্তমিত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম তারকা!  

একটা কথা বললে খুব বেশি বলা হবে না যে, পুরো বিষয়টিতে নিজের শক্তিমত্তাই দেখালো আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড! অমুক অমুককে ধরে মন্ত্রী-উপদেষ্টা করে ফেললেও আব্দুর রাজ্জাকদের উপেক্ষা করে বাদ দিয়ে যে কেবিনেট গঠন করে ফেলা যায় তা আগে দেখানো হয়েছে! এরপর এখন দেখানো হলো কেবিনেটে না রেখে দলীয় রাজনীতিতে গৌণ করে দিয়ে রাখা হলেও মৃত্যুর পর একজনকে কী করে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া যায়!

একেবারে বিশেষ ফ্লাইটে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় লাশ আনার ব্যবস্থা! যা আগে কখনো বাংলাদেশে ঘটেনি! এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে তার শক্তিমত্তার প্রমাণ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সায়, বিলাতে বিশেষ বিমান পাঠিয়ে লাশ আনার ঘটনা এসব দেখে তাই এয়ারপোর্টে নেতা-কর্মীদেরও অভাব হয়নি!

বিষয়টি নিয়ে জাতীয় এই শোকের মুহূর্তে আর ঘাটাঘাটিতে না যাওয়াই ভালো। কারণ, দুনিয়ার কোনো ক্ষমতাই চিরস্থায়ী না। আল্লাহপাক সবাইকে হেদায়েত করুন। চির শান্তি লাভ করুন মুক্তিযুদ্ধের নেতা আব্দুর রাজ্জাকের আত্মা।

বাংলানিউজের হেড অব দ্য নিউজ অপারেশনস মাহমুদ মেননের লেখাটি পড়ছিলাম। আব্দুর রাজ্জাকের আগাম মৃত্যু সংবাদ লেখা-প্রচার করা নিয়ে বিবেকের দংশনে তার আত্মসমালোচনামূলক লেখা। বাংলাদেশের মিডিয়ার ইতিহাসে এটি একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ঘটনাটি কী করে ঘটলো তার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাহমুদ মেনন।

কিন্তু রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলের মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কী করে আব্দুর রাজ্জাকের মতো নেতার মৃত্যুর আগে শোকবাণী দিয়ে ফেলেছিলেন, এর ব্যাখ্যাটা কী? বা তারা এর কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছেন না দেবার চেষ্টা করেছেন?  আজব আমার দেশ!

রোববারের বাংলাদেশ প্রতিদিনে সাবেক ছাত্রনেতা বাহালুল মজনুন চুন্নুর একটি লেখা ছাপা হয়েছে। আব্দুর রাজ্জাকের হাতে গড়া যে সব নেতা, চুন্নু তাদের একজন। অনেক বঞ্চনা আর হতাশার মধ্য দিয়ে আব্দুর রাজ্জাকের মতো একজন নেতাকে কী করে চলে যেতে হলো সে বর্ণনা দিয়ে তিনি শুধু তার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ বিদায় চেয়েছেন।

আর কিছু না হোক সেটিতো হচ্ছে প্রিয় রাজ্জাক ভাই। তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশে আমরা তোমার মতো নিঃস্বার্থ, সৎ হতে পারিনি বলে সব কিছু একটু অগোছালো তালগোল পাকানো, এই যা! কিন্তু দিন এমনিতো শুধু যাবে না। বদলাবেই।

প্রতিষ্ঠিত হবে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকদের স্বপ্নের রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ। সামনে সে দিন।

ফজলুল বারী: সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক।


জাতীয় ঈদগাহে দ্বিতীয় জানাজার পর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখানে সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ তাকে শেষবারের মতো দেখতে ও শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হয়েছে।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন, আওয়ামী লীগের উপিদেষ্টামণ্ডলী সদস্য তোফায়েল আহমেদ, বিশ্ববিদ্যায়লয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান একে আজাদ, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, আইনপ্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রমুখ।

এছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিষদ, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ল শিক্ষক সমিতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে।

বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, শিক্ষবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবির খোকন, জাসদের হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির ‍রাশেদ খান মেনন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত আছেন।

শহীদ মিনারে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু তাকে ডাকতেন “আমার রাজ্জাক” বলে। বঙ্গবন্ধুর পর তাকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একনামে চিনত।’

তিনি বলেন, ‘আমি লন্ডনের হাসপাতালে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম, তিনি আমাকে আমার শরীরের যত্ন নিতে বলেছিলেন।’ কথা বলতে তোফায়েল আহমেদ কেঁদে ফেলেন।

এর আগে রোববার বিকেল চারটায় জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে আব্দুর রাজ্জাকের দ্বিতীয় জানাজার নামাজ হয়। একই দিন বিকেল তিনটার পরপরই জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

শহীদ মিনারে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত আছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, চিকিৎসক, কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ।