নির্বাচন কমিশন গঠনের পূর্বে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুর্নবহালের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যাবশ্যক -খালেদা জিয়া

খোন্দকার কাওছার হোসেন ॥ নির্বাচন কমিশন গঠনের পূর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুর্নবহালের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যাবশ্যক বলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে লিখিতভাবে জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বুধবার বেলা ১১টায় দলের ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এক ঘণ্টা সংলাপে অংশ নেয়। সংলাপে বিএনপি চেয়ারপারসন রাষ্ট্রপতির কাছে দলের বক্তব্য লিখিতভাবে উপস্থাপন করেন।

বিএনপি প্রতিনিধি দলে ছিলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গণি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, লেফটেনেন্ট জেনারেল (অব.) মাহাবুবুর রহমান, আ স ম হান্নান শাহ, এম কে আনোয়ার, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক।
রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপিত লিখিত বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন সংক্রান্ত আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিএনপি মনে করে, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। আপনি এবং প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৫ ও ৯৬ সালে একই মতামত ব্যক্ত করেছিলেন।
খালেদা জিয়া বলেন, সংশোধিত সংবিধানের অধীনে এবং বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচন গঠন প্রক্রিয়া  মূল ইস্যু বলে দেশবাসী মনে করে না। জাতীর কাছে মূল ইস্যু হলো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে হবে। তাই নির্বাচন কমিশন গঠনের পূর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুর্নবহালের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যাবশ্যক।

খালেদা জিয়া আরো বলেন, সংবিধান সংশোধনের সুপারিশ প্রদানের জন্য একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। কমিটি বছরব্যাপি দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, প্রবীণ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে। তাদের প্রায় সবাই মত প্রকাশ করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার মতো পরিস্থিতি এখনো দেশে সৃষ্টি হয়নি। এতদস্বত্ত্বেও সকল মতকে উপেক্ষা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেশে এক সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনবর্হাল করা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এ জাতীয় কোনো আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে বিএনপি সে আলোচনায় অংশ নিয়ে সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে যে সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছে তা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন বার বার দাবি করে আসছে যে তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছে। সরকার তাদের দায়িত্ব পালনে কোনো বাধা সৃষ্টি করছে না। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সরকারের ইচ্ছার বাইরে কমিশন কোনো কাজ করতে পারে না তার অনেক দৃষ্টান্ত তাদের কর্মকা-ে রয়ে গেছে। সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে কমিশন দল হিসেবে বিএনপিকে বিলুপ্ত করার জন্য তৎকালীন সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলো। ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়াদ অতিক্রান্ত হবার পর ৪ বছরের অধিক সময় অতিবাহিত হলেও শুধু নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার ভয়ে সরকারের অনাগ্রহের কারণে আজও নির্বাচন হয়নি। একাধিকবার কমিশন কতৃক নির্বাচন অনুষ্ঠানেরর ঘোষণা ও সাম্ভাব্য সময় নির্দেশ করা স্বত্ত্বেও সরকারের বাধার মুখে কমিশনকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছে। সরকারের অসহযোগিতার কারণে ভোলা উপ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন সম্ভব হয়নি। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন সুষ্টুভাবে পরিচালনার জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি করেছিলো সরকারী দল ছাড়া অন্য সকল মেয়র প্রার্থী। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে কমিশন সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে এবং সে অনুযায়ী সরকারকে চিঠি প্রদান করে ও পরিপত্র জারি করে কিন্তু সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করে সেনা মোতায়েনতো করেই নাই এমনকি কমিশনের চিঠির কোনো জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করে নাই। বিগত দিনগুলোতে আরো এমন অনেক উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে যা থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়নি এবং ভবিষ্যতে ও হবেনা।

লিখিত বক্তব্যে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতিকে আরো বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে কারচুপির নির্বাচন করেও বিজয়ী হওয়ার বিষয়ে সরকার নিশ্চিত হতে পারছে না বলেই ডিজিটাল কারচুপির লক্ষ্যে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারের সেই ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্যই আগামি নির্বাচনের বহু আগে যে নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে তারাই বলছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইভিএম পদ্ধতিতে হবে।

খালেদা জিয়া বলেন, যদিও এই মেশিনের দ্বারা নির্বাচনের প্রকৃত ফলাফল বদলে দেয়ার এবং ভোটগ্রহনকারী কর্মকর্তাদের যোগসাজসে একই ব্যক্তির অসংখ্য ভোট প্রদানের সুযোগ থাকায় পৃথিবীর বহু দেশে এই মেশিনের ব্যবহার সম্পূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া দেশের সকল বিরোধীদল ইভিএম প্রচলনের বিরুদ্ধে যুক্তিগ্রাহ্য বক্তব্য দিয়েছে এবং ক্ষমতাশীন মহাজোটের কয়েকটি শরিকদল ও এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে ধীরে চলার পরামর্শ দিয়েছে। আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি ইভিএম এখনো ত্রুটিমুক্ত নয় এবং নির্বাচনী কর্মকর্তাদের যোগসাজসে এমনকি পোলিং এজন্টদের অজান্তে এই প্রক্রিয়ায় ব্যাপক কারচুপির সুযোগ থাকায় আগামী সংসদ নির্বাচনে অপরিচিত এই যন্ত্রের ব্যবহার জনগণের কাছে গ্রহনযোগ্য হবেনা।

তিনি বলেন, যন্ত্রের মাধ্যমে ভোটিং তিনটি কারণে গ্রহণযোগ্য নয়, প্রথমত এ মেশিনে ভোট পুন:গণনা ও নিরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। দ্বিতীয়ত এই মেশিনে কাকে ভোট দেয়া হচ্ছে ও কার একাউন্টে ভোট যাচ্ছে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তৃতীয়ত ভোটার যেখানে ভাট দিচ্ছেন সেস্থানটি গোপনীয় নয়। বরং ভোটারদের ইলেকশন কমিশনের কর্মকর্তাদের সামনেই ভোট দিতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে এখন মেশিনের মাধ্যমে ভোটিং প্রক্রিয়া একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
উদাহরন দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মান সুপ্রিম কোর্ট ইভিএমকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দিয়েছে। ২০০৯ সালে ফিনল্যান্ড এর সুপ্রিমকোর্ট তিনটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ঘোষণা করে, সেগুলো ইভিএম এ পরিচালিত হয়েছিলো।

২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যর দ্যা ওপেন রাইটস গ্রুপ ঘোষণা দেয় যে তাদের ইভিএম দ্বারা গৃহীত ভোটের ওপর কোনো আস্থা নেই। কারণ ইভিএম এর পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও প্রয়োগে বহু সমস্যা আছে। এরপর যুক্তরাজ্যের ইলেকশন কমিশন ইভিএম পদ্ধতি বাতিল করতে বাধ্য হয়।

২০০৬ সালে নেদারল্যন্ডসে বেশ কিছু ইভিএমের লাইসেন্স তুলে নেয়া হয়, যখন উই ডু নট ট্রাষ্ট ভোটিং মেশিন নামে একটি নাগরিক সংগঠন প্রমান করে যে, ৫মিনিটের মধ্যেই ৪০মিটার দুর থেকে যেকোনো ইভিএম হ্যাক করা সম্ভব। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ইভিএম ভোটিং পরিকল্পনা পরিত্যাগ করা হয়।

২০০০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্লোরিডা স্টেট এ ইভিএম এর ব্যবহার ও কারচুপি তথা যন্ত্রের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির ভোট দেয়ার তথ্য ধরা পড়ার পর এ পদ্ধতি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। এই পরিস্থিতিতে ইভিএম ব্যবহার আমাদের দেশেও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

খালেদা জিয়া আরো বলেন, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং যোগ্য ও সাহসী নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু বর্তমান সরকার বিরোধী দলের ওপর যেভাবে দমন পীড়ন চালাচ্ছে, মামলা হামলা দিয়ে হয়রানি করছে, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা সৃষ্টি করার মাধ্যমে দেশে বাস্তবে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছে। তাতে নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় শান্তিপূর্ণ ও উপযোগী পরিবেশ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে স্বার্থেই এই দুঃসহ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান প্রয়োজন।

তিনি বলেন, এসব বক্তব্যে অতিরিক্ত যে প্রশ্নটি জনগণকে উদ্বিগ্ন করেছে তা হচ্ছে, সংবিধানের বিধান মোতাবেক নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত হলেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ ছাড়া এককভাবে তা করতে পারবেন না। মহাজোটের শরীক অনেক দলসহ সব প্রধান বিরোধীদল, দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মতামত ও জনমতকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর আপনার সঙ্গে চলমান সংলাপের ফলাফলের ভাগ্যে কি ঘটবে সে সম্পর্কে অনেকেই আশান্বিত নয়।

খালেদা জিয়া বলেন, একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ এবং সবার অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন তাই করার জন্য আপনার কাছে এ বক্তব্য উপস্থাপন করছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পূর্বে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া শুরু করা হলে তা জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।