প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং সীমান্তে হত্যা

মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিন, শাবি ॥ বর্তমান নানাভাবেই সীমান্তবর্তী এলাকার হত্যাকাণ্ডগুলো পত্র-পত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়। সীমান্তবর্তী এলকার কোথাও না কোথাও সংঘটিত হয় গুলির ঘটনা। আর এসব গুলিতে প্রাণ হারায় বাংলাদেশের নিরপরাধ, নিরীহ, নিরস্ত্র ব্যক্তিরা। যাদের পরিচয় সাধারণ কৃষক, দিনমজুর কিংবা ব্যবসায়ী। এসব হত্যাকাণ্ডের পরপরই দুদেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা দায়সারা কোনো রকম একটি বিবৃতি দিয়েই ঘটনাকে চাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সবগুলো সরকারই ভারতের এমন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানাতে পারেনি যা ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়। যার ফলে ভারতের অন্যান্য সীমান্তে নির্বিচারে গুলি চালাতে না পারলেও ঠিকই বাংলাদেশের নাগরিকদের উপর গুলি চালায়। পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি সীমান্তে বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানিকে নির্মমভাবে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখে। ফেলানির ঝুলন্ত লাশের ছবি বিশ্বব্যাপী বিবেকবান মানুষের বিবেককে দংশিত করেছে। আর প্রতিনিয়তই এখন সংবাদ শিরোনাম হয়ে আসছে সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের খবর। বিএসএফ এর হাতে যারা নিহত হচ্ছেন তারা বাংলাদেশের খেটে খাওয়া নিরস্ত্র লোক। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় ওই সব স্বাভাবিক কাজকর্মের জন্যই চলাফেরা করতে হয়। বন্ধুদেশের আচরণ কেন জানি অবন্ধুসুলভ আচরণের মতো হচ্ছে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত নানাভাবেই বাংলাদেশকে তাদের সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। দুদেশের যৌথ সহযোগিতায় বাংলাদেশ লাল সবুজ পতাকা পেয়েছে। এর পেছনে ভারতের সহযোগিতার কথা কেউ-ই অস্বীকার করছে না। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় সংঘটিত হচ্ছে বাংলাদেশি নিধন। এসব হত্যাযজ্ঞে নিহতরা নিরীহ সাধারণ বাংলাদেশি নাগরিক। তাই এসব হত্যাকাণ্ড নিয়েই চলছে চুল চেরা বিশ্লেষণ। আর কত কাল চলবে এমন বাংলাদেশি হত্যা। আর কত ফেলানিকে এমন নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার উপর ঝুলে বিশ্ববাসীকে জানান দিতে হবে কেমন আছে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ? না।

প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র কর্তৃক এমন বিমাতাসুলভ আচরণ কারোই কাম্য হতে পারে না। নিরস্ত্র আর একজন বাংলাদেশিই এমন নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে চায় না। যারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে এ মাটিকে শত্র“ মুক্ত করেছে তাদেরকে নির্বিচারে এমনভাবে হত্যা করা যায় না। সীমান্তে কিছু হত্যাকাণ্ডের চিত্রের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে কত নিপীড়ন চালাচ্ছে ভারতী সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফ। পত্রিকায় প্রকাশ, ২০০০ সালের পর গত এক যুগে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এক হাজার ছয়জন নিরীহ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। অথচ ভারতের সঙ্গে অন্য পাঁচটি সীমান্তে একটি হত্যার ঘটনাও ঘটেনি। ২০০০ সালে ৩৯ জন, ২০০১ সালে ৯৪ জন, ২০০২ সালে ১০৫ জন, ২০০৩ সালে ৪৩ জন, ২০০৪ সালে ৭৬ জন, ২০০৫ সালে ১০৪ জন, ২০০৬ সালে ১৪৬ জন, ২০০৭ সালে ১২০ জন, ২০০৮ সালে ৬২ জন, ২০০৯ সালে ৯৬ জন, ২০১০ সালে ৭৪ জন এবং ২০১১ সালে ৩৪ জন নিরীহ বাংলাদেশি বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছে।  ২০১২ সালেও সীমান্তে সংঘটিত হয়েছে একাধিক হত্যাকাণ্ড।

গতবছরের  ৯ ডিসেম্বর রাজশাহীর পবা উপজেলার খানপুর সীমান্ত দিয়ে গরু আনার সময় হাবিবুর রহমান নামের এক যুবক বিএসএফের নির্যাতনের শিকার হন। হাবিবের ভাষ্যমতে ৫ ঘণ্টা ধরে চলে অমানুষিক নির্যাতন। তাকে উলঙ্গ করে যে কায়দায় তার উপর নিষ্ঠুরতা চালানো তা মধ্যযুগীয় পাশবিকতারকেও হার মানিয়েছে। ভারতীয় স্যাটেলাইট গণমাধ্যম এনডিটিভি সম্প্রতি ওই নৃশংসতার ফুটেজ সম্প্রচার করায় বিশ্ববাসীর বিবেককে আবারো নাড়া দিয়েছে। বিএসএফের বর্বরতার সচিত্র ফুটেজ এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে মোবাইলে মোবাইলে। প্রতিবেশী ভারতের সীমান্তরক্ষীরা যেভাবে বর্বরতা হাবিবের উপর চালিয়েছে তাতে কে কোন ব্যক্তিরই আতঙ্কিত হওয়ারই কথা। একজন নিরীহ মানুষকে একদল প্রশিক্ষিত বাহিনী যেভাবে উলঙ্গ করে তার সামনে বসে তার পরনের কাপড় ছিড়ে হাত-পা বেঁধে যে ধরনের বর্বরোচিত অত্যাচার করেছে তা দেখে যে কোনো সভ্য মানুষ সহ্য করতে পারে না। ভারতীয় বিএসএফ বাহিনী প্রতিনিয়তই যেভাবে বাংলাদেশিদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করছে, তা পৃথিবীর আর কোনো সীমান্তে দেখা যায় না। সীমান্তে ফেলানীদের মতো অসহায় নিরীহ বাংলাদেশিদের লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। পুরো বিশ্ববাসীর বিবেক নাড়া দিলেও বিএসএফ বাহিনীর বিবেক নাড়া দেয়নি। আর বিবেক নাড়া না দেওয়ায় প্রতিদিনই প্রাণ হারাতে হচ্ছে বাংলাদেশিদের। এ নিষ্ঠুরতা পৃথিবীর কোন বৈরি রাষ্ট্রগুলো সীমান্তে দেখা যায় না। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সীমান্তেও এরকম নির্বিচারে গুলি চলে না।

এবার সীমান্ত থেকে অন্য দিকে তাকালে ভারতের আচরণগুলো আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমা ও চ্যানেলগুলো অবাধে প্রবেশ করতে পারলেও বাংলাদেশের একটি টিভি চ্যানেলও এখন পর্যন্ত ভারতে প্রবেশ করার সুযোগ পায়নি। এসব বিষয়কে সব সময়ই আড়ালে রাখা হচ্ছে। ভারতকে করিডোর দিতে গিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিতাশ নদীসহ ১৮টি নদীতে বাঁধ দিয়েছে। বাংলাদেশ বরাবরই ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার চেষ্টা চালিয়েছে কিন্তু অপরদিকে ভারত কখনও বাংলাদেশের স্বার্থের দিকে বিন্দু পরিমাণও চেষ্টা করেনি। তাহলে কেনইবা বাংলাদেশি চ্যানেল ভারতে প্রবেশের সুযোগ পেল না? এ প্রশ্ন আজ বাংলাদেশি সব নাগরিকের। ভারত বাংলাদেশকে বন্ধুরাষ্ট্র ভাবলে কেনইবা প্রতিদিন বিএসএফ বাহিনী নির্বিচারে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকে বুকে গুলি চালাচ্ছে? বারবার ভারত কর্তৃক সীমান্তে আর গুলি চলবে না এমন আশ্বাসের পরও কেন বিএসএফ বাহিনী গুলি চালাচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলেই বুঝা যাবে ভারত বাংলাদেশের কেমন বন্ধু রাষ্ট্র। ভারতের সাথে কখনই আমাদের শত্রুতা ছিল না তাহলেই কেনইবা এসব প্রশ্ন বারবার সামনে আসবে? পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের মতোই ভারত বাংলাদেশের বন্ধু। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে দেশ স্বাধীনের সময়ে তারা যে সহযোগিতা করেছে তার জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ। তাই বলে তাদের এমন নিষ্ঠুরতাকে কোনভঅবেই সহ্য করার মতো নয়। আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছ থেকে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ কামনা করি। সীমান্তে আর যেন একজন নিরীহ বাংলাদেশিকে হত্যা করা না হয়― সে ব্যাপারে দুদেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষ দৃষ্টি রাখবেন এমনটি প্রত্যাশা সচেতন বাংলাদেশি নাগরিকদের।