আবারো লঞ্চডুবি! প্রাণ হারালেন শতাধিক যাত্রী

মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিন ॥ আবারো লঞ্চডুবিতে প্রাণ হারালেন শতাধিক যাত্রী। ডুবন্ত লঞ্চের ভেতর থেকে কেউ কেউ বেরিয়ে আসতে পেরেছেন আর যারা বেরুতে পারেন নি তাদের সলিল সমাধি হয়েছে গভীর নদীর ভেতর। দেশে একের পর এক এমন নৌদুর্ঘটনা কিংবা লঞ্চডুবি ঘটনা ঘটেই চলেছে। আর এসব দুর্ঘটনার পর যথারীতি তদন্ত কমিটির নামের এক ধরনের কমিটি করা হয়।  তদন্ত কমিটি তদন্ত কাজ শেষে দুর্ঘটনার কারণ ও এর প্রতিকারের সুপারিশ দেয়া হলেও সেসব তদন্ত প্রবিদেন হিমাগারেই পড়ে থাকে। বাস্তবায়িত হয় না কোন সুপারিশ। ফাইলের ভেতর ঢাকা পড়ে থাকে তদন্ত প্রতিবেদন। খুব কম ঘটনারই প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার পরপই প্রশাসন কিংবা সংশ্লিষ্ট বিভাগের দৌড়ঝাঁপ সবার নজর কাড়ে। কিন্তু পূর্ব থেকেই এমন দৌড়ঝাঁপের সিকিভাগও থাকলে হয়তো এমন দুর্ঘটনা কিছুটা কমে আসত এমনই মতামত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। দেশের একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে কোন ঘটনার পরেই সবার টনক নড়ে। সচেতন হওয়ার চেষ্টা থাকে সবার। কিন্তু কয়েকদিন পেরিয়ে গেলে আবার সেই পুরনো চিত্রই রয়ে যায়।  

জানা যায়, ১২ মার্চ শরীয়তপুর-১ নামের লঞ্চটি শরীয়তপুরের সুরেশ্বর ঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে আসছিল। মধ্যরাতে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় পৌঁছলে মালবাহী একটি কার্গো লঞ্চটিকে ধাক্কা দেয়। ফলে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল থাকায় খুব কম সময়ের ব্যবধানেই লঞ্চটি মেঘনা নদীতে ডুবে যায়। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়েই ওই লঞ্চটি ঢাকার দিকে আসছিল। এতে প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক যাত্রী।

বেসরকারি টিভি চ্যানেল বাংলাভিশনের ক্যামেরাম্যান মো. মাসুদ চৌধুরী, তার স্ত্রী ও শিশুপুত্রসহ এ ঘটনায় প্রাণ হারায়। শুধু স্বজন হারানোরাই নয় দেশের মানুষ আজ শোকে আচ্ছন্ন মুন্সিগঞ্জের লঞ্চ ডুবির ঘটনায়। নৌ মন্ত্রী শাজাহান খান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নিহত পরিবারকে ত্রিশ হাজার টাকা এবং দাফনের জন্য তিন হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দেন। এ ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করার কথাও তিনি সাংবাদিকদের জানান।

দেশের নানা লঞ্চ দুর্ঘটনা এবং এর কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেছে, কিছু সুনির্দিষ্ট কারণই মূলত লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। তন্মধ্যে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই অন্যতম। কিন্তু কারণগুলো চিহ্নিত হওয়ার পরও কেন বারবার ঘটছে এমন দুর্ঘটনা? এমন প্রশ্ন দেশের সবার।  গত বছরের ২১ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিপাশা নামের লঞ্চ ডুবির ঘটনায় প্রাণ হারায় অর্ধশতাধিকেরও বেশি মানুষ।  একটি ডুবন্ত কার্গোর সাথে ধাক্কা লেগে বিপাশা নামের লঞ্চটি ডুবে যায়।

২০০৯ সালের ২৯ নভেম্বর ঈদের আগের রাতে দুই হাজার যাত্রী নিয়ে ভোলার নাজিরপুরের তেতুলিয়ায় ডুবে যায় কোকো-৪ নামের লঞ্চটি। এতে শতাধিক যাত্রী প্রাণ হারান। গঠিত হয়েছিল যথারীতি তদন্ত কমিটি। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট আজও পাওয়া যায়নি বলে পত্রিকায় প্রকাশ। ওই বছরেরই ১৯ ফেব্র“য়ারি বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে ডুবে যায় এমএল হ্যাপি নামের একটি লঞ্চ। ২০০৩ সালে মেঘনায় ডুবে যায় নাসরিন। প্রাণ হারান অর্ধশতাধিক লোক।

জানা গেছে, স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শতাধিক নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। সুশাসনের জন্য প্রচার অভিযান নামের একটি সংগঠন লঞ্চ দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করছে। এই সংগঠন দুর্ঘটনার জন্য ১০টি কারণ চিহ্নিত করেছে। লঞ্চের নকশাজনিত ত্র“টি, চালকের অদক্ষতা, মাস্টার সুকানির গাফিলতি, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামালবহন, নিরাপত্তা আইন অমান্য করা, বাতি বা সার্চ লাইট না থাকা, চলার পথে দুই লঞ্চের মধ্যে প্রতিযোগিতা, বেপরোয়া চালানো, আবহাওয়ার পূর্বাভাস অবহিত না হওয়া, সতর্কতামূলক চিহ্ন ছাড়া নদী পথে মাছ ধরার জাল রাখা-এসবই নৌ-দুর্ঘটনার কারণ।

১৯৯৪ সালে প্রায় তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় দিনার-২ নামের লঞ্চ। ২০০২ সালের ৩ মে মেঘনার ষাটনলের কাছে পাঁচ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় সালাউদ্দিন-২ নামের লঞ্চটি। হিসাব অনুযায়ী এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছে ১৫ হাজারেরও অধিক মানুষ। পরিবারের প্রধানকে হারিয়ে পথে বসেছে অগণিত মানুষ। নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন জোট জাতীয় কমিটির হিসাব মতে, লঞ্চডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ২০ হাজারের মতো। তদন্ত কমিটির ভিত্তি করে মামলা হয়েছে ১৪১টি। অথচ অভিযুক্ত দায়ীদের কাউকেই একদিনও জেল খাটতে হয়নি। এ সংবাদ জেনে সবারই কষ্ট অনুভব হয়। নৌপথে বৈধ রেজিস্ট্রেশন নিয়ে নৌযান চলছে ৭ হাজার আর অবৈধ রয়েছে ১২ হাজার।

জানা গেছে ১৯৭৬ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ৪৯৬টি নৌ-দুর্ঘটনার কারণ লঞ্চের নকশাজনিত ত্র“টির কারণে। ৯ বছর আগে ভোলার নাসরিন ট্রাজেডিতে ২৪ জন স্বজনকে হারিয়ে শেষ সদস্য হিসেবে বেঁচে গিয়েছিলেন পারভেজ নামের এক ব্যক্তি। কিন্তু ৬ বছর পর আবার কোকো-৪ ট্র্যাজেডিতেই তাকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! লঞ্চ দুর্ঘটনার কারণে অনেক পরিবারের প্রধান হয়েছেন নারীরা। এভাবেই অনেক দুর্ঘটনার বহু মানুষ স্বজন হারিয়ে পথে বসেছে। আর কত এমন দুর্ঘটনা ঘটতে থাকবে? এমন প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন দুর্ঘটনা কী ঘটতেই থাকবে? অবৈধ নৌযানগুলো কী সনাক্ত করে আইনি পদক্ষেপ নেয়া যায় না? এরকম আরো কিছু প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে জাগাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দেশের নৌ পথের অবৈধ নৌযানগুলোকে সনাক্ত করে সেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারলে হয়তো কিছুটা রোধ করা যাবে এমন অনাকাক্ষিত দুর্ঘটনা। আর কোন দুর্ঘটনায় নদীর ভেতর কারোর সলিল সমাধি হোক এমনটি কেউই দেখতে চায় না। পাশাপাশি কোন যাত্রীকেই যেন এমন দুর্ঘটনায় জীবন দিতে না হয় এমন কামনা সবার।

রিয়াজ উদ্দিন, সংবাদকর্মী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।