অবৈধভাবে ব্যাংকি কার্যক্রম চালাচ্ছে বরিশালের ৩০টি প্রতিষ্ঠান

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ মাল্টি-পারপাস ব্যবসার নামে প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন যাবৎ সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যুবক ও এ্যাসেড-এর ন্যায় অধিক মুনাফার আশ্বাস দিয়ে কৌশলে এলাকার লোকজনের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই। ঘটনাটি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার।

ভুক্তভোগি, এলাকাবাসি ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাল্টি-পারপাস ব্যবসার অন্তরালে গৌরনদীতে দীর্ঘদিন থেকে চলছে ব্যাংকিং কার্যক্রম। এ কার্যক্রম বন্ধের জন্য দীর্ঘদিনেও সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় গৌরনদীর বিভিন্ন হাট-বাজারগুলোতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে জামানাত গ্রহনকারী ও অর্থ আত্মসাতকারী অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। এর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সূত্রমতে, শুধুমাত্র সমবায় অধিদপ্তর থেকে সনদপত্র নিয়ে গত দেড় বছর পূর্বে গৌরনদী বন্দরে উদ্বোধন করা হয়েছে “দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড”। তারা ব্যাংকের ন্যায় বিভিন্ন মেয়াদে আমানত গ্রহন, ঋণ প্রদান কার্যক্রম চালাচ্ছে। তারা এক শাখা থেকে অন্য শাখায় অর্থ প্রেরনও করছে। এলাকার লোকজনকে লোভনীয় মুনাফার ফাঁদে ফেলে গৌরনদী বন্দরের ইটালী মার্কেটের তৃতীয় তলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ম্যাক্সিম নামের অপর একটি প্রতিষ্ঠান। তারা ইতোমধ্যে এলাকার সহস্রাধিক আমানতকারীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা। লোকজনকে আকৃষ্ট করতে তারা গৌরনদী বন্দরে প্রতিষ্ঠিত করেছে সুরম্য টিভি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র বিক্রির শো-রুম। ২০১১ সনের ফেব্র“য়ারি মাসে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধন নিয়ে গৌরনদীতে তারা কার্যক্রম চালু করে। নিবন্ধনকালে তারা ওই সংস্থার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, সম্পাদকসহ কমিটির গুরুত্বপূর্ন ছয়জন সদস্যের আসল পরিচয় গোপন রাখে। তারা সবাই ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারি এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া সত্বেও প্রতারনার মাধ্যমে তারা গৌরনদী উপজেলার কালনা গ্রামের বাসিন্দা সেজে জাল নাগরিক সনদপত্র জমা দিয়ে নিবন্ধন লাভ করেন। ম্যাক্সিম এর গৌরনদী শাখার ব্যবস্থাপক সেকান্দার আলীর সাথে আলাপ করে জানা গেছে, তার শাখায় এফডি আর, এম.আই.এস, মাসিক আমানত, স্থায়ী আমানত, পেনশন স্কীমসহ ১১টি প্রকল্পে আমানত গ্রহন করা হয়। তবে মাসিক মুনাফা প্রতি লাখে ২ হাজার টাকা, ৪ বছরে দ্বিগুন ও ৭ বছরে ৩ গুন। এফডিআর প্রকল্পে টাকা বিনিয়োগকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ওই প্রকল্পে টাকা বিনিয়োগ করে বিপাকে পড়েছেন আমানাতকারীরা। প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পেরে জমাকৃত টাকা উত্তোলনের জন্য প্রতিষ্ঠানে বার বার ধর্না দিয়েও ব্যর্থ হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। জমাকৃত অর্থ ফেরত না পাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে। এ ব্যাপারে আমানতকারী ও সাবেক পরিসংখ্যান অফিসার বীর মুক্তিযোদ্ধা খান মোঃ শামচুল হক, আমানতকারী আলমগীর হোসেন, দেলোয়ার হোসেনসহ ২৫ জনে গৌরনদী সমবায় অফিসে ম্যাক্সিমের বিরুদ্ধে লিভিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। ম্যাক্সিমের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য অতিসম্প্রতি গোয়েন্দা বিভাগের একটি দল গৌরনদীতে আসেন। তারা ওই অফিসে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কর্মকর্তাদের প্রশ্ন করেন এবং খাতাপত্র দেখেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট অফিসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, উপজেলা ও জেলা সমবায় দপ্তর থেকে ওই প্রতিষ্ঠানটিকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে বৈধ কাগজপত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দিলেও তা অমান্য করা হয়। ইতোমধ্যে ওই প্রতারক চক্রটি গৌরনদী অফিসের সকল গ্রাহকের টাকা ব্যাংক থেকে উধাও করে (অন্যত্র সরিয়ে) নিয়েছে।

গৌরনদী সদরে কারসা ফাউন্ডেশনসহ আরো ৫টি মাল্টি-পারপাস সংস্থা রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ ব্যবসায়ীক কেন্দ্র টরকী বন্দরে গড়ে উঠেছে প্রায় ১৫টি মাল্টি-পারপাস সংস্থা। এগুলো হচ্ছে-দিশা বাংলাদেশ, আদর্শ মাল্টি-পারপাস কো-অপারেটিভ লিমিটেড, গ্রাম বাংলা মাল্টি-পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, পল্লীবন্ধু বহুমুখী সমবায় সমিতি, টিপিডিও, অভিসারনি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, দিগন্ত মল্টি-পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, উদায়ন সঞ্চয় ও ঋণ দান সোসাইটি। এছাড়া বাটাজোর বন্দরে গড়ে উঠেছে বিডিসি, পল্লী বাংলা ফাউন্ডেশন, জাগরনী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড, দি নিউ পোসড ফাউন্ডেশন। এদের অনেকেই ঋণ দান কর্মসূচীর পাশাপাশি অবৈধ ভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মাক্সিম এর ন্যায় বাটাজোর, সরিকল ও আগরপুর বন্দরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাগরন বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড এর মাল্টি-পারপাস ব্যবসা। ওইসব স্থানে তাদের নিজস্ব শো-রুম ও রয়েছে।  ওই সংস্থাটি দৈনিক সঞ্চয় প্রকল্প, মাসিক সঞ্চয় প্রকল্প, ৫ বছরে দ্বিগুন প্রকল্প, মাসিক মুনফা প্রকল্প, নগদ ও কিস্তিতে পন্য বিক্রয় প্রকল্প চালু করেছে। জনসাধারনকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটির ওয়ালে ওয়ালে ছঁক অঙ্কন করে লিখে রেখেছেন কত টাকায় মাসে কত মুনফা প্রদান করা হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি মোঃ হাবিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমরা সমবায় অধিপ্তরের অনুমোদন নিয়ে এ সব কার্যক্রম শুরু করেছি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারি নিয়ন্ত্রন না থাকার কারেনে গৌরনদীর বিভিন্নস্থানে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান মাল্টি-পারপাস ব্যাবসার পাশাপাশি শুরু করেছে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম। এদের প্রসারতা বাড়ছে দিন দিন। গৌরনদী উপজেলা সমবায় অফিসার মোঃ খোরশেদ আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সমবায় সমিতির বিধিমালা ৮৭ অনুয়ায়ী সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধন নিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্পূর্ন অবৈধ। যে সব প্রতিষ্ঠান ঋণ দান কার্যক্রমের পাশাপাশি অমানত সংগ্রহ করছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

ভুক্তভোগী এলাকাবাসির অভিযোগ, কতিপয় মুনফালোভী ব্যক্তি সমবায় ও সমাজ সেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এলাকায় প্রকাশ্যে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রতারনার ফাঁদে পরে এলাকার সহজ সরল লোকজন অধিক মুনফার আশায় ব্যাংক ও পোষ্ট অফিসে টাকা বিনিয়োগ না করে ওইসব প্রতিষ্ঠানে অর্থ বিনিয়োগ করে প্রতারিত হচ্ছেন। এ কারনে সরকার নিয়ন্ত্রিত স্থানীয় ব্যাংক গুলোতেও দেখা দিয়েছে তারল্য সংকট। এদের বিরুদ্ধে দ্রুত অইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য এলাকাবাসি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।