স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাজারে প্লাষ্টিক সামগ্রীর বিভিন্ন ব্যবহারিক জিনিসপত্রের ভিড়ে প্রায় বিলুপ্তির পথে দেশের চিরচেনা মৃৎ শিল্পের ব্যবহারিক জিনিসপত্র। বিভিন্ন স্থানের ন্যায় বরিশালের গৌরনদী, বাবুগঞ্জ, বাকেরগঞ্জ ও আগৈলঝাড়া উপজেলার মৃৎ শিল্পীদের ঘরে তাই নেমে এসেছে হাহাকার। মৃৎ শিল্পীদের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার কমে আসায় বদলে যাচ্ছে কুমারপাড়ার দৃশ্যপট। এসব উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কুমার পাড়ার বাসিন্দাদের পরিবারে নেমে এসেছে দুর্দিন। ওইসব পরিবারের সদস্যরা এখন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। বরিশালের সবচেয়ে বড় কুমার পাড়া হচ্ছে গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়নের বিল্লগ্রামে। ওই গ্রামে এ পেশার সাথে জড়িত রয়েছেন প্রায় শতাধিক পরিবার। আর কয়েকদিন পরেই হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষে গ্রামেগঞ্জে বসবে শারদীয় মেলা। ওই মেলায় বিক্রি হবে রং বেরঙের পুতুল। সেই পুতুল বানানোসহ শেষ সময়ে তুলির আচরে রংঙ্গের কাজে এখন মহাব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কুমার পাড়ার নারী ও পুরুষেরা। কুমারপাড়ার বাসিন্দারা তাদের পেশাটি টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানিয়েছেন।
সরেজমিনে ওই কুমার পাড়ায় গিয়ে জানা গেছে, কুমার-কুমারী ও তাদের পরিবার পরিজনের কষ্টের কাহিনী। অর্ধাহার আর অনাহার এখন তাদের নিত্যসঙ্গী। শুধু এতেই শেষ নয়; ওই পাড়ার শতশত শিশুরা বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। এক্ষেত্রে যত না অভিভাবকদের অসচেতনতা কাজ করে; তার চেয়ে বেশি দারিদ্রই তাদের বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনকালে ওই পাড়ায় মাটির বিভিন্ন সামগ্রী তৈরির কাজে ব্যস্ত কনা রানী পাল নামের এক গৃহবধুর সাথে আলাপকালে তিনি জানান, এখন আর আগের মত কুমার পাড়ার আয় নেই বললেই চলে। আগে আমরা চরকা দিয়ে বিভিন্ন রকম বাসন-কোসন, ব্যবহারিক জিনিসপত্র ও খেলনা সামগ্রী তৈরি করতাম। কিন্তু এখন চরকা ব্যবহার করা হয় না। কারন চরকা দিয়ে জিনিসপত্র তৈরি করে ভালো দাম পাওয়া যায় না। তাছাড়া এখন আমাদের মাটি পর্যন্ত কিনে আনতে হয়। বর্তমানে আমরা সামান্য আয়ে সংসার টিকিয়ে রেখেছি। কনা রানীসহ ওই পাড়ার একাধিক বাসিন্দারা তাদের পেশাটি টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানিয়েছেন। কেবলমাত্র পূর্ব পুরুষের পেশাকে টিকিয়ে রাখার জন্যই শত প্রতিকুলতার মাঝে এখনও বিল্লগ্রামের কুমার পাড়ার শতাধিক পরিবার এ পেশায় জড়িয়ে রয়েছেন। কুমার পাড়ার লোকজন জানায়, আগে এ শিল্পের তৈরি জিনিসপত্রের প্রচুর কদর ছিল। বিক্রির পরিমানও ছিল অনেক বেশি। বর্তমানে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যাপকতার কারনে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা দিন দিন কমে যাচ্ছে। মাটির তৈরি সামগ্রী তৈরি করার পর তা ঠিক মত বিক্রি হয় না। ফলে তাদের প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই দেশের ঐতিহ্যবাহী এ মৃৎ শিল্পটি হারিয়ে যাবে।
মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু জানান, বিল্লগ্রামের কুমারপাড়াটি প্রায় দু’শ বছরের পুরনো। বর্তমানে বাজারে মৃৎ শিল্পীদের তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় এখানকার স্বল্প আয়ের কুমার পরিবারের অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। তিনি আরো জানান, শিক্ষা দিক্ষায় কুমার পরিবারের সন্তানেরা অনেকটাই এগিয়ে থাকলেও বর্তমানে অর্থাভাবে তারা বহু কষ্টে রয়েছেন। এরইমধ্যে চলতি ৩১ তম বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে কুমার জীবন পালের কন্যা প্রিয়াংকা পাল বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ লাভ করেছেন। চেয়ারম্যান পিকলু শত বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী মৃৎ শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানিয়ে বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্পকে আবার জাগিয়ে তোলা সম্ভব হবে। নতুবা অচিরেই দেশের ঐতিহ্যবাহী এ মৃৎ শিল্পটি হারিয়ে যাবে।