বরিশালে খালেদা জিয়ার জনসভা আজ – দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে পুরো দলটিতে বিরাজ করছে হ-য-ব-র-ল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এক সময়ের বিএনপি’র ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত পুরো দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে দলটিতে এখন বিরাজ করছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। অভ্যন্তরিন দ্বন্ধ আর কোন্দল ও সংস্কারপন্থির ধুয়া তোলার কারনেই পুরো বিভাগ জুড়ে দলটির এ অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু হওয়া এ দ্বন্ধের এখনও অবসান ঘটাতে পারেননি দলের নীতি নির্ধারকেরা। বরং দিন দিন তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নেতা-কর্মীরা দলের মজবুত অবস্থানের জন্য চায় ঐক্যবদ্ধ কর্মতৎপরতা। কিন্তু তাদের সে চাওয়ার বিপরীতে ক্রমান্বয়ে দ্বন্ধের জটিলতা বেড়েই চলেছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রাপ্তি নিয়ে এ দ্বন্ধ আরো চরম আকার ধারন করবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। সকল দ্বন্ধ নিরসনের জন্য আর সংস্কারপন্থির ধুয়া না তুলে ১৮ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজ সোমবারের জনসভায় সকলকে নিয়েই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে কাজ করার ঘোষনা করবেন এমনটাই আশা করছেন দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। নতুবা আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়ে আনবে নবম নির্বাচনের ফলাফলে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিভাগে বিএনপি’র রয়েছে ৮টি সাংগঠনিক জেলা। এগুলো হচ্ছে-বরিশাল মহানগর, বরিশাল দক্ষিন জেলা, বরিশাল উত্তর জেলা, ঝালকাঠী, বরগুনা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলা। এ ৮টি সাংগঠনিক জেলায় ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছিলো ২৩টি আসন। এরমধ্যে আওয়ামীলীগ পেয়েছিলো মাত্র দুটি আসন। কিন্তু নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ ফলাফল হয়ে যায় পুরোপুরি উল্টো। ওই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন থেকে ২৩টি আসনকে ২১টি আসনে রূপান্তরিত করা হয়। আর ২১ আসনের মধ্য থেকে বিএনপি পেয়েছিলো মাত্র দুটি আসন। পরাজয়ের জন্য দলের নেতৃবৃন্দরা সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দায়ি করলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পরাজয়ের মুল কারন ছিলো দলের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্ধ।

সূত্রমতে, ত্বত্তাবধায়ক সরকার আমলে দলের মধ্যে সৃষ্টি হয় মুলধারা এবং সংস্কারপন্থি নামের দুটি গ্রুপ। নেতৃত্বের এ কোন্দল এখনো অব্যাহত রয়েছে। বিভাগীয় সদর বরিশাল জেলায় রয়েছে ৬ টি সংসদীয় আসন। এর প্রতিটিতে ২ থেকে ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে দলীয় নেতা-কর্মীরা।

বরিশাল শহরে দলের শীর্ষ দু’নেতা কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার ও কেন্দ্রীয় মৎস্য বিষয়ক সম্পাদক আহসান হাবিব কামালের দ্বন্ধ ছড়িয়ে আছে পুরো জেলা জুড়ে। মুলদলের পাশাপাশি সকল সহযোগী সংগঠনের মাঝেও দ্বন্ধ বিরাজমান। এ দু’গ্রুপের মধ্যে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পাশাপাশি কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে ছাত্রদল নেতা রাফসান আহম্মেদ জিতুকে। এছাড়াও দলের শীর্ষ নেতাদের সামনে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয় কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান রাজনকে।

গৌরনদী-আগৈলঝাড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-১ আসনে রয়েছে একাধিক গ্রুপ। এ আসন থেকে প্রার্থী হওয়ার প্রতিযোগীতায় রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক তথ্য ও গবেষনা বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য এম. জহির উদ্দিন স্বপন, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য ও বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য ও গৌরনদী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবহান, বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির সহসভাপতি এ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল, এস.এম মনির-উজ জামান মনির, বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন খান, ড. ইঞ্জিনিয়ার শাহ আলম, জেলা উত্তর যুবদলের সাধারন সম্পাদক বদিউজ্জামান মিন্টু। ফলে এখানকার নেতা-কর্মীরাও বিভক্ত এসব নেতাদের পিছনে।

একই ভাবে উজিরপুর-বানারীপাড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-২ আসনে রয়েছে অভ্যন্তরিন কোন্দল। সাবেক এমপি শহিদুল হক জামাল দল থেকে বাহিস্কৃত হন সংস্কারপন্থির অভিযোগে। গত নির্বাচিনে এ আসন থেকে বিএনপি’র প্রার্থী হন সদ্য দলে যোগ দেয়া বিশিষ্ট শিল্পপতি এস. শরফুদ্দিন আহম্মেদ সান্টু। মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে তিনি রয়েছেন দেশের বাইরে। ফলে এখানে সাংগঠনিক কর্মকান্ড খুবই দূর্বল। পাশাপাশি সৈয়দ শহিদুল হক জামাল নতুন করে দলে ফিরছেন এমন গুঞ্জনও রয়েছে। এছাড়া তার সমর্থক বড় একটি গ্রুপ রয়েছে বিরোধিতায়। সান্টুর পাশাপাশি এ আসন থেকে প্রার্থী হতে চান ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সম্পাদক মোঃ ইলিয়াস খান, মহানগর যুবদলের সভাপতি রফিকুল ইসলাম শাহিন, চলচিত্র পরিচালক এনায়েত করিম প্রমুখ।

বরিশাল-৩ আসনে গত নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান বেগম সেলিমা রহমান। বাবুগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য মোশারফ হোসেন মঙ্গু ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা এ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন প্রার্থী হওয়ার প্রচেষ্ঠায় রয়েছেন। একইসাথে এ এলাকায়ও নেতা-কর্মীদের মধ্যে রয়েছে তীব্র কোন্দল। দ্বন্ধের জেরধরে দল থেকে বহিস্কৃত হন উপজেলা সভাপতি সুলতান আহম্মেদ খান। বহিস্কৃত অবস্থায় নির্বাচন করে মহাজোট সরকারের আমলে তিনি বাবুগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

মেহেন্দিগঞ্জ ও হিজলা উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৪ আসনটি রয়েছে বিএনপি’র দখলে। গত নির্বাচনে সকলকে অবাক করে এ আসন থেকে জয়লাভ করেন মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ। তবে আগামী নির্বাচনে এ আসন থেকে মনোনয়ন পাবার চেষ্ঠা করছেন সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত গত নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ আবুল হোসাইন।

বরিশাল নগর ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৫ আসনে এ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার-এমপি একক প্রার্থী। তবে আহসান হাবিব কামালের সাথে দ্বন্ধের কারনে এখানেও নেতা-কর্মীরা দু’ভাগে বিভক্ত।

বকেরগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৬ আসনে বিএনপি’র গ্রুপিং ও প্রার্থী তালিকার শেষ নেই। গত নির্বাচনে এ আসন থেকে পরাজিত হন সাবেক এমপি আবুল হোসেন খান। জেলার অন্যতম বৃহত্তম এ উপজেলায় একাধিক ভাগে বিভক্ত বিএনপি। আবুল হোসেনের প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) আনোয়ার হোসেন চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান রাজন।

আজ সোমবার বরিশালে ১৮ দলের জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষন দেবেন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। তার সামনে নিজ নিজ সমর্থন আর প্রভাব তুলে ধরতে চলমান দ্বন্ধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যেই বাবুগঞ্জে উপজেলা চেয়ারম্যানের বানানো তোরণ দু’দফায় ভাংচুর করেছে বর্তমান সভাপতি সৈয়দ ইশরাত হোসেন কচির সমর্থকেরা। বাকেরগঞ্জে দু’গ্রুপের মধ্যে ঘটেছে অপ্রীতিকর ঘটনা। প্রতিপক্ষ গ্রুপের হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পরেছেন সাবেক এমপি সৈয়দ আবুল হোসেন। গৌরনদীতে জহির উদ্দিন স্বপনের পোষ্টার লাগাতে গেলে তা ইজ্ঞিনিয়ার সোবাহানের সমর্থকেরা ছিনিয়ে নিয়ে পাঁচ জনকে মারধর করে। এমন দ্বন্ধ বিবাদ ছড়িয়ে পরেছে অনেক স্থানে। তবে সাধারন নেতা-কর্মী আর সমর্থকেরা এ ধরনের দ্বন্ধে ক্ষুব্ধ আর হতাশ। তাদের দাবি সব দ্বন্ধের মুলে আদর্শ নয় নেতৃত্ব দখল।

সকল দ্বন্ধ নিরসনের জন্য আর সংস্কারপন্থি আখ্যা না দিয়ে ১৮ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সকলকে নিয়েই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে কাজ করার ঘোষনা করবেন এমনটাই আশা করছেন দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। নতুবা আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়ে আনবে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে।