মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কর্মীরা, কাজহীন হাসানাত

কাটছে এক সময়ের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর। দল ক্ষমতায় থাকলেও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য হাসানাত এখন একাকিত্ব জীবন-যাপন করছেন। রাজনীতির মাঠে তার সরব উপস্থিতি নেই। বসবাস করেন গ্রামের বাড়িতে। এক সময়ের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর যেন অভিমানে এখন নির্বাক।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পিতা কৃষক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, আদরের সন্তান সুকান্ত বাবু ও ভাই শহীদ সেরনিয়াবাত সহ পরিবারের অনেক সদস্যকে হারিয়েছেন তিনি। এরপর দেশান্তর হওয়া আবার দেশে ফিরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাজনীতির হাল ধরেন। কথা ছিলো যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার। পারিবারিক অনুরোধে পদটি ছেড়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের অপর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমকে। ভালো কোনো পদ-পদবী কখনো পাননি হাসানাত। তবুও আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে ছিলেন লড়াকু সৈনিক। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামী লীগকে তিনি দিয়েছিলেন গতিশীল নেতৃত্ব। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন জাতীয় সংসদের চীফ হুইপের পদ। এই পদে থাকার পাশাপাশি পাহাড়ী-বাঙ্গালী বিরোধ নিরসন করে পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন মাইলফলক স্থাপন করেন। তবে দল ক্ষমতায় থাকাবস্থায় বরিশালে ব্যাপক সন্ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগে হাসানাত ও তার দল আওয়ামী লীগ চরম সমালোচনার মুখে পড়ে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে পরাজয়ের রাতেই বরিশাল ছাড়েন হাসানাত। ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি মাত্র দু’বার বরিশাল এসেছিলেন। এরমধ্যে সর্বশেষ সফর ছিলো ২২ জানুয়ারীর নির্বাচনে অংশ নিতে নির্বাচনী এলাকা গৌরনদীতে আসা। দেশে ওয়ান-ইলেভেন আসার পর অনেক রাজনৈতিক নেতার মতো বাধ্য হয়েই দেশান্তরিত হন হাসানাত। বিদেশের মাটিতে থাকা অবস্থায় একাধিক মামলায় তাকে কারাদন্ড দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় আসার পর দেশে ফিরে আত্মসর্পন করে জামিন লাভ করেন। তার সাজা অবৈধ ঘোষণা করে আদালত। এরপর থেকেই তিনি উপদেষ্টা হচ্ছেন বলে গুঞ্জন রটে যায় পুরো দক্ষিণাঞ্চলে। হাসানাত বরিশাল ফিরে ধরেন রাজনীতির হাল। সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গত উপজেলা পরিষদ,  পৌরসভা ও  ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিনি সার্বক্ষণিক ছিলেন মাঠে। চষে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন উপজেলা থেকে গ্রাম পর্যন্ত। বিএনপি’র ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত দক্ষিণাঞ্চলে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ। ২৩টি পৌরসভার মধ্যে ২২টি পৌরসভায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা। বিশেষ করে বরিশাল জেলার ৫টি পৌরসভায় প্রার্থী দিয়েছিলেন হাসানাত তার নিজের পছন্দ অনুযায়ী। ৫টিতেই বিজয়ী হওয়ার পর আশাবাদী হয়ে উঠেন আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও দলের কৌশলী ভূমিকায় বিএনপিকে পরাজিত করে ব্যাপক সাফল্য আসে। গত বছর প্রধানমন্ত্রীর বরগুনা সফরের এক সপ্তাহ আগে হাসানাত সেখানে গিয়ে বিভিন্ন উপজেলা সফর করেন। রাতভর পরিশ্রম করে বরগুনার সমাবেশ জন সমুদ্রে পরিনত করতে তিনি অবদান রাখেন। এসব সাফল্য হাসানাতের মুখে হাসি ফোটাতে পারেনি। পদ-পদবী বঞ্চিত হাসানাত এখন বসবাস করেন তার পৈত্রিক নিবাস আগৈলঝাড়া উপজেলার অজোপাড়া গায়ের সেরাল গ্রামে। নিজ বাড়িতে যাওয়ার সড়কটি পর্যন্ত গত আড়াই বছরে মেরামত করা হয়নি। তবুও জেলা-উপজেলার কর্মীরা ঐ ভাঙ্গাচোড়া সড়ক দিয়ে হাসানাতের সাথে সাক্ষাত করতে তার সেরালের বাড়িতে যান। আবেগঘন কথা বলে তাদের বিদায় দেয়া ছাড়া হাসানাত আর কিছুই দিতে পারেন না। না পাওয়ার বেদনা নিয়ে ধীরে ধীরে তার অনুগতকর্মীরা মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। তারা ভীড়ছেন দলের অন্য শিবিরে। তাই নেতা-কর্মীদের যাতায়াত কমে গেছে সেরালের বাড়িতে। এখন তার সময় কাটে প্রতিবেশী শিশু-কিশোরদের সাথে গল্প-গুজব করে। রাজনীতির মাঠ চষে বেড়ানো কর্মযজ্ঞ এ নেতা এখন ফুল বেকার। কোনো কাজ নেই। তাই চরম হতাশায় বাড়িতেই সারাদিন শুয়ে-বসে দিন পার করে দেন। গত ক্ষমতার আমলে নগরীর কালিবাড়ি রোডে তার যে পৈত্রিক বাড়িটি ছিলো জমজমাট, দিনভর যেখানে ছিলো দিন-রাত হাজারো মানুষের ভীড়। সেখানে এখন একেবারেই শূন্যতা। দিন-রাত পুলিশ প্রহরা উপেক্ষা করে যেখানে হাজারো মানুষ ভীড় করতো সেখানে এখন কারো পা পড়ে না। এমনকি হাসানাত নিজেও এবার দেশে ফিরে এ বাড়িতে একটি রাত কাটাননি। তার ঘনিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য হিসেবে তাকে কখনোই শেখ হাসিনার বাইরে গিয়ে রাজনীতি করা সম্ভব হয় না। দেশে মাইনাস-টু ফর্মূলা বা সংস্কারে গা ভাসিয়ে হাসানাতের রেহাই পাওয়া সম্ভব না। চাওয়া-পাওয়া সবটুকুই ক্ষমতার আমলের মাঝে সীমাবদ্ধ। সেই স্বাদের ক্ষমতার আড়াই বছর কেটে গেলেও কোনো স্বাদ উপভোগ করতে পারেননি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। মেঘে মেঘে বেলা হয়েছে অনেক, জীবনের অনেক পথ পাড়ি দিয়ে বয়স প্রায় শেষ হতে চলছে। আর কখন কি পাবেন? নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের ভবিষ্যত নিয়ে তিনি চরম হতাশায় ভূগছেন। তার অনুপস্থিতিতে শক্ত হাতে কে ধরবে দলের হাল তাও তাকে ভাবিয়ে তুলছে। কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না। ক্ষমতার আমলে কর্মীদের জন্য কোনো কিছু করতে না পারার বেদনা তাকে আরো হতাশ করে তুলছে।