স্টাফ রিপোর্টার ॥ “মোর শোয়ামীর (স্বামীর) গোয়াল ভরা গরু আর মোড়া ভরা ধান সবই আছিলো, পাঁচটা মাইয়া ও একটা পোলা লইয়া মোরা সুখেই আছিলাম। আল্লায় মোগো কপালে হেই সুখ বেশিদিন রাখলোনা, সর্বনাশা নদী মোগো সব কিছুই কাইরা নেছে। এই বুড়া বয়সেও আইজ মুই ভিক্ষা কইরা সোংসার চালাই”। বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন ছলেমান বিবি (৭৫)। এ কথাশুধু ছলেমান বিবির একারই নয়, একইভাবে জানালেন গৃহহারা নিলুফা বেগম (৪৫), শাহানুর বেগম (৬৫) সহ অনেকেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নদী বেষ্টিত বরিশালের মুলাদী উপজেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চল চরকালেখা ইউনিয়নের উত্তর গাছুয়া গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ভয়ঙ্কর জয়ন্তী নদী। এ গ্রামটি গত ১৫ বছর পূর্বে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে জয়ন্তী নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনে। ফলে নিঃস্ব হয়ে যায় ওই গ্রামের সহস্রাধীক পরিবার। যারমধ্যে আজো মাথা গোজার ঠাঁই খুঁজে পায়নি ওই গ্রামের প্রায় তিন শতাধিক পরিবার। নদী ভাঙ্গনের ফলে সর্বস্ত্র খুঁইয়ে গ্রামের পাশ্ববর্তী এলাকায় খোলা আকাশের নিচে আজো বসবাস করছেন প্রায় আড়াই’শ পরিবারের সদস্যরা। দীর্ঘদিন পর সেই নিশ্চিহ্ন গ্রামে গত তিন বছর পূর্বে জেগে উঠেছে চর। এযেন অসহায়, নিঃস্ব মানুষদের জন্য এক আলোর বার্তা। কিন্তু এখানেই দেখা দিয়েছে বিপত্তি; জেগে ওঠা চরের ওপর লোলুপ দৃষ্টি পরে পাশ্ববর্তী গ্রামের প্রভাবশালী কতিপয় ভূমিদস্যুদের। তারা চর দখল করে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালুর ব্যবসা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওইসব প্রভাবশালীদের বাঁধা দিতে গিয়ে মিথ্যে মামলার আসামি হয়ে গ্রেফতার আতংকে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রামের শিক্ষক, সমাজ সেবক সহ আ’লীগ নেতারা। ফলে পুরুষ শুন্য হয়ে পরেছে গোটা গ্রামটি। বর্তমানে ওই গ্রামের বাসিন্দাদের একটাই কথা “জীবন দিয়ে হলেও গ্রামকে রক্ষা করবো-তবু ড্রেজিং করতে দেবো না”।
চরকালেখা ইউনিয়নের পূর্বের উত্তর গাছুয়া ও বর্তমানের ষোলঘর গ্রামের মৃত নাজেম আলী সরদারের পুত্র আমির হোসেন সরদার (৫৫) জানান, ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী উত্তর গাছুয়া গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জয়ন্তী নদী ১৯৯৮ সনের ভয়াবহ ভাঙ্গনে সহস্রাধীক পরিবারকে করে দিয়েছে সম্পূর্ণ নিঃস্ব। যারমধ্যে জব্বার দেওয়ান, গণি সিকদার, আফছের হাওলাদার, আয়নাল মাতুব্বরসহ প্রায় আড়াই’শ পরিবার সবকিছু হারিয়ে পাশ্ববর্তী হিজলা, ছবিপুর ও গৌরনদী উপজেলার বিভিন্ন এলাকার রাস্তার পাশে খুঁপরি ঘর বানিয়ে কোন একমতে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। এছাড়াও সর্বস্ত্র খুঁইয়ে অন্যত্র চলে গেছেন নদী ভাঙ্গন কবলিত গ্রামের সেন্টু আকন, জয়নাল আকন, জংশেদ দেওয়ান, ইনু ঢালী, সোহরাব আকন, বাকিউল আকন, দিলু আকন, মস্তফা আকন, রমিও আকন, রশিদ আকন, জলিল বেপারী, সেকান্দার বেপারীসহ প্রায় তিন’শ পরিবার। তিনি আরো জানান, গত তিন বছর পূর্বে ভাঙ্গন কবলিত গ্রামে চর জেগে ওঠায় নিঃস্ব পরিবারগুলো পূর্ণরায় বাঁচার স্বপ্ন দেখেন।
স্থানীয়দের অভিযোগে জানা গেছে, এরইমধ্যে চরকালেখা গ্রামের প্রভাবশালী ভূমিদস্যু প্রকৌশলী আজহারুল ইসলাম সরদারের কু-দৃষ্টি পরে ওই চরের ওপর। সে কৌশলে নৌ-পরিবহন মন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে আবুপুর থেকে মৃধারহাট পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ঘুরে ফেরি ঘাট নির্মানের নাম করে চর কাটার চেষ্টা চালায়। ফলে পূর্ণরায় নদী ভাঙ্গনের আশংকা দেখা দেয় আশ্রয়হীন পরিবারদের গ্রাম ষোলঘরে। ভুক্তভোগী নুরুল ইসলাম হাওলাদার (৭৮), মতিউর রহমান হাওলাদার (৬০) সহ অনেকেই জানান, নদী ড্রেজিং না করার জন্য প্রভাবশালী আজহারুল ইসলাম সরদারকে অতিসম্প্রতি অনুরোধ করেন উত্তর গাছুয়া গ্রামের বাসিন্দা ও চরকালেখা ইউনিয়ন আ’লীগের সিনিয়র সহসভাপতি নুরুল হক খান, সমাজ সেবক আমির হোসেন সরদারসহ অনেকেই। এসময় আজহারুলের সাথে তাদের বাকবিতন্ডা হয়। এ ঘটনার জেরধরে গত ২৫ ফেব্র“য়ারি রাতে আজহারুলের শ্যালক চরকালেখা গ্রামের বাসিন্দা স্বপন তালুকদার বাদি হয়ে মুলাদী থানায় একটি সাজানো মিথ্যে হামলা ও লুটপাটের মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয় আ’লীগ নেতা নুরুল হক খান, প্রধান শিক্ষক মোশারফ হোসেন সরদার, শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন খান, দিন ইসলাম সরদার, নুরুউদ্দিন সরদার গংকে।
স্থানীয় বাচ্চু খান (৪৮), খলিল বেপারী (৫৫) সহ অনেকেই অভিযোগ করেন, মুলাদী থানা পুলিশ রহস্যজনক কারনে অভিযোগের তদন্ত না করেই মামলাটি সরাসরি এজাহারভুক্ত করে আসামিদের গ্রেফতারের জন্য ওই রাতেই অভিযান পরিচালনা করে। এছাড়াও মামলা দায়েরের পূর্বেই (২৫ ফেব্র“য়ারি দুপুরে) থানার কতিপয় অতিউৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তারা সমাজ সেবক আমির হোসেন সরদারকে আটক করে দিনভর থানা হাজতে রেখে রাতে ছেড়ে দেয়। বর্তমানে পুলিশের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত থাকায় ষোলঘরের পুরো গ্রামটি পুরুষ শুন্য হয়ে পরেছে। ওই গ্রামের বাসিন্দা শাহে আলম দপ্তরি (৮০), শামচুল হক বেপারী (৭০) সহ অনেকেই জানান, নৌ-মন্ত্রীর দেয়া প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী আবুপুর থেকে মৃধারহাট পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ঘুরে ফেরি ঘাট নির্মানের পরিবর্তে চর ভেদুরিয়া থেকে ষোলঘর পর্যন্ত এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে (নদীর এপার-ওপার) ফেরি ঘাট নির্মান করা হলে সরকারের যেমন ব্যয়ভার অনেকাংশে কমে যাবে। তেমনি নিশ্চিহ্ন গাছুয়া ও ষোলঘর গ্রামবাসীকে আর নদী ভাঙ্গনের কবলেও পরতে হবে না। ভুক্তভোগীরা সহস্রাধীক গ্রামবাসীর কল্যানে ও ভূমিদস্যুদের কবল থেকে রক্ষা পেতে এবং মিথ্যে মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী, নৌ-মন্ত্রী সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু বলেন, উত্তর গাছুয়া গ্রামটি অনেক আগেই নদীতে গ্রাস করে নিয়েছে। বর্তমানে ওই নিশ্চিহ্ন গ্রামে জেগে ওঠা চর ড্রেজিং করা হলে নদীর পাশ্ববর্তী ষোলঘর গ্রামটি নদীতে গ্রাস করে নেয়ার আশংকা রয়েছে। আর এতে হাজার-হাজার গ্রামবাসী গৃহহীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।