দ্বিতীয় খবর

পেট থেকে গলা পর্যন্ত ধূলোর মতো লাগছে, ভিতর থেকে একটা কাঠবমি ঠেলা মারছে, বড়ো এক জগ ভর্তি পানি যদি থাকত এ ঘরে কিন্তু এ ঘরটা মনসুরের বইপত্রের ঘর। এ ঘরে পানির কোনো জগ বা গ্লাস থাকে না। উঠতে উঠতে সিঁড়ির মাঝামাঝি নিচু ছাদের এই ঘরটাতে ঢুকে পড়েছিল মনসুর, দোতলা পর্যন্ত আর ওঠেননি।
কী করে উঠবেন? দোতলায় লীনা নেই? উঠলেই লীনার মুখোমুখি হতে হবে না?
আশ্চর্য, মনসুরের কাছে কেউ আসছে না? কেন আসছে না? ভয়ে? যেমন ভয়ে মনসুর দোতলায় উঠছে না?
কিন্তু ফটিকটাতো আসতে পারত? ওর এত ভয় কিসের? বাড়ির একটা ছোঁড়া চাকর। ওর এত কি বুদ্ধি চিন্তা হবে যে, ভাববে- সাহেবের ঘরে এখন ঢুকবে না, সাহেবের মন খারাপ। এত বুদ্ধিমান না হয়ে ফটিক যদি একটু বোকার মতো এ ঘরে এসে ঢুকতো, মনসুর ওর কাছ থেকে এক গ্লাস পানি চাইতে পারত। কিন্তু আজ ও বোকার মতো কাজ করছে না।
অথচ মনসুরের পেটের মধ্যে পাক দিচ্ছে। ভীষণ পাক। মনসুর হয়ত অজ্ঞান হয়ে যাবেন। আহা অজ্ঞান হয়ে শুয়ে থাকবার আগে যদি এক গ্লাস পানি পেত মনুসর এক জগও চাইছেন না মনসুর শুধু এক গ্লাস, ঠাণ্ডা কনকনে এক গ্লাস পানি।
মনুসরের থেকে সামান্য তফাতেই রয়েছে সে বস্তু; মনসুরের নিজের উপার্জনের টাকায় কেনা ফিন্সজের মধ্যে। এক্ষুণি এক্ষুণি উঠে গিয়ে ফিন্সজের মধ্যে রাখা পানির বোতলগুলো টেনে টেনে চার বোতল পানি খেয়ে নিতে পারেন তিনি। কিন্তু সেটা কি ভালো দেখাবে?
মনসুর ভাবলেন একথা। যদিও তিনি মনে করতে পারছেন না সারাদিন কার সঙ্গে ঘুরেছেন? কার কার সঙ্গে কথা বলেছেন; তবুও এ কথা মনে এলো তার ‘ভালো দেখাবে সেটা গতকাল রাতে যার ছেলে খুন হয়েছে, আর সারাদিন সেই খুনের তদারকি করেই কেটেছে যার, নিজের চোখে শনাক্ত করে লিখে আসতে হয়েছে যাকে’ আমার পুত্র পার্থ, বয়স বাইশ, পোস্ট গ্রাজুয়েট ছাত্র, কাল রাত্রে যখন খেতে বসতে যাচ্ছিল, কেবা কারা বাইরে থেকে ডেকে নিয়ে যায়, আর ফেরেনি, সেই লোক নিজে গট গট করে উপরে উঠে গিয়ে ফিন্সজ খুলে ঠাণ্ডা পানি খাবে ছি: ছি:। …তাছাড়া সেই অন্য কথাটা? যেটা এখনো কেউ জানে না, সেটা প্রকাশ পেয়ে গেলে? কি বলবে তখন লোকে মনসুরকে?
তবে কি কাউকে ডেকে তার কাছে এক গ্লাস পানি চাইবেন তিনি? সেটা ভালো দেখাবে? আশ্চর্য, পার্থর সেই বড় বড় চোখ, এলোমেলো চুল, বুদ্ধি উজ্জ্বল মুখ, ছেলেটা খুন হয়ে গেল, তবু মনসুর নামের লোকটা বসে বসে ভাবছে কিসে ভালো দেখাবে, কিসে ভালো দেখাবে না। কিন্তু পানি যে চাই।
মনসুর মনে জোর আনতে চেষ্টা করলেন। তিনি ফটিককে ডাকতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কই গলা দিয়ে কোন শব্দ বার হচ্ছে না কেন? কেউ কি তার গলায় বাণ মেরেছে, যন্ত্রবাণ, তাই বোবায় ধরেছে মনসুরকে?
মনসুর তবে কী করবেন? তিনি প্রার্থনা করতে লাগলেন একজন কেউ আসুক এঘরে। হয়ত এমন একান্তভাবে চাইলে, তার ফল ফলে। তাই ফটিকই এলো। চোরের মতো দরজায় এসে দাঁড়ালো। মনসুর সঙ্গে সঙ্গে বললেন- এক গ্লাস পানি যে, ফটিক সঙ্কোচে বলল- বড় মা বলেছেন হাতমুখ ধুতে, কাপড় চোপড় ছাড়তে…
যা বলছি কর-
ফটিক, তাড়াতাড়ি চলে গেল, একটু পরে ফিন্সজ খোলার শব্দ পেল মনসুর সাহেব। তার মনে হলো এই শব্দটা যে এত মধুর তা তো কই কোনদিন জানতেন না। ফটিক একটি বোতল হাতে করে নিয়ে এসে আবার চোরের মতো দাঁড়ালো বলল-গ্লাস খুঁজে পাচ্ছি না- পাচ্ছিস না? ভালো হয়েছে।
প্রায় ওর হাত থেকে মনসুর ছিনিয়ে নিলেন ঠাণ্ডা কনকনে পানির বোতলটা। পানিটা নামতে লাগলো একটা মরুভূমির সড়ক দিয়ে- সব ঠাণ্ডা করতে করতে। মনসুর সাহেব ভাবলেন, মন প্রাণ আত্মা, স্নেহ ভালোবাসা এ সমস্তই মিথ্যে, ভুয়া, যা সত্য তা হচ্ছে শরীর। শরীরই প্রভু ওরা দাস মাত্র। তা না হলে পানির ধারাটা গলায় ঢালার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো সব কষ্টের শান্তিত্ম হয়ে গেল। বোতলটা ফটিকের হাতে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে হঠাৎ ছেলেটাকে খুব শুকনো আর মলিন লাগল, বললেন এখনো খাসনি বুঝি? ফটিক চমকে উঠল। সে অবশ্য এই মমতা প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। চমকে উঠার পর ফটিক আস্তে মাথা নাড়ল।
মনসুর সাহেব আবার বললেন- রান্না হয়নি বুঝি। সকলের ওপর শরীর বৈকি, নচেৎ পানি খাবার সঙ্গে সঙ্গেই মনসুর এমন একটা অতি সাধারণ প্রশ্ন করতে পারেন?
ফটিক কান্না চাপা গলায় বলল, ও বেলাও হয় নাই।
ও! তোরা তাহলে আজ কেউই খাসনি?
আমি আর দাঁরোয়ান মুড়ি খেয়ে ছিলাম
মনসুর ফট করে বলে বসলেন, আর তোদের মা?
মা?
ফটিক উদ্দীপ্ত গলায় বলে উঠল, মা তো পানির ফোঁটাটিও পর্যন্ত মুখে নেয়নি। মনসুর সাহেবের নিজেকে খুব ক্ষুদ্র অধম দীনহীন মনে হলো। এরপর আর লীনার কাছে মুখ দেখাবার মুখ কী রইল তার? মনসুর কি ফটিককে নিষেধ করে দেবেন- আমি তোর কাছে পানি চেয়ে খেয়েছি বলিস না কাউকে। তার মানে আরো ছোট হয়ে যাবেন মনসুর, আরো অধম? তবে কী একটু ঘুরিয়ে বলবেন­ গোসলের আগে পানি খেয়েছি শুনলে হয়ত তোদের মা রাগ করবে বুঝলি? পানির কথা কাউকে বলবি না!
এটা বলা যায়। ফটিকও ধরতে পারবে না মূল কথাটা কী। অথবা যদি এভাবে বলা যায়- গতকাল রাতে মনসুর সাহেবের বড় ছেলে খুন হয়েছে, আর সেই খুনের আসামি হিসেবে তারই ছোট ছেলে ধরা পড়েছে। তবু মনসুর সাহেব মনে মনে প্যাঁচ কষছেন মিথ্যে কথাটা কিভাবে বললে ভালো দেখায়।
মনসুর সাহেবের বড় ছেলের কথা অনেকে জেনে ফেলেছে, এবার সবাই জানবে। হয়ত কাল ভোরে কাগজে নামটা দিয়েই ছেপে দিবে; কিন্তু তার ছোট ছেলের কথা কেউ জানে না- তার সঙ্গের লোকজন ছাড়া।
কে যেন তারা? তার ভাগ্নে, শালা আর বু; তাই না? তারা কি রাষ্ট্র করে বেড়াবে কথাটা? বলবে পুলিশ আজকাল খুব করিৎকর্মা হয়েছে, খুনের সঙ্গে সঙ্গেই খুনিকে ধরে ফেলেছে। আমার কথা তিন চারটে ছেলে ছিল সবকয়টাকেই ধরেছে। তাদের মধ্যে মনসুরের ছোট ছেলেও রয়েছে…
মনসুরের বড় ছেলের খবরটা কিছুই অবিশ্বাস্য নয়, শহরের নিত্য ঘটনা, কিন্তু ছোট ছেলের খবরটা? এর চাইতে অবিশ্বাস্য খবর জগতে আর কি আছে? অতএব সেইটা নিয়ে আন্দোলন উঠবে শহর জুড়ে, লীনার কান পর্যন্ত পৌঁছবে।
মনসুর সাহেবের শালা তার ভাগ্নের জন্য জামিন দিতে চেয়েছিল, অনেক ধরাধরি করেছিল, পুলিশ রাজি হয়নি। রাজি হলে খবরটা আপাতত লীনার কছে লুকানো যেত এখন কিভাবে কথা সাজিয়ে- আবার সেই কথা সাজানোর কথাই ভাবলেন মনুসর-
ওরা অবিশ্বাস্য বলছে, কোথাও একটা কিছু গোলমাল ঘটেছে। এ হতেই পারে না বলেছে মনসুরের সঙ্গের লোকেরা কিন্তু মনসুরের সে কথা মনে হচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে কোনখানে কিছু গোলমাল হয়নি। অথচ তার ছোট ছেলে প্রতীমের কাল রংপুরে থাকার কথা নয়, পরশু সকালে ছোট একটা সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে গেছে প্রতীম- দিন চারেকের জন্য রংপুরের বাইরে যাচ্ছি বলে।
পরশু থেকে কাল, এটা কি চারদিন হয়ে যায়? তাই মনে করতে হবে, ফিরে আসার পথে পুলিশ শুধু শুধু ওকে যদিও মনসুর সাহেবের শালা তাই বলছিল। খামোখা চারদিনের জন্য বাইরে যাওয়ার কথা শুনে মনসুর অবশ্য খুব প্রীত হননি। ভেবেছিলেন মাস্তানিটা বড্ড বেড়েছে। খরচতো করবি বাপের পকেট ভেঙে, অথচ কি তালেবর ভাব। মুখ ফুটে বলেননি সেকালের বাপের মতো। তবু তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন হঠাৎ রংপুরের বাইরে জায়গাটা কোথায়? প্রতীম বেড়াতে যাবার মতো কোনো জায়গা নাম করেনি, বেশ জোরালো গলায় বলেছিল ঢাকায়, ঢাকার নাম শুনেছেন তো?
ঢাকার নাম শুনিনি? অবাক হয়ে উচ্চারণ করেছিলেন মনসুর সাহেব। ‘তবে আর কি’? বলে টকটক করে নেমে গিয়েছিলেন প্রতীম সরু সরু দুটো লগবগে পায়ে।
হলো তো? লীনা বলেছিল, হলো গাল বাড়িয়ে চড় খাওয়া?
মনসুর সাহেব সেই সময় চেচিয়ে উঠেছিলেন, তার মানে? ছেলে কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করতে পারব না?
না পারবে না, সে আইন নেই আর আজকাল।
আইন নেই। অতএব চুপ করে যেতে হয়েছিল মনসুর সাহেবকে। অথচ অন্য আইনগুলো এখনো ঠিক আগের মতোই আছে। বড় ছেলে পার্থ বেরিয়ে গিয়ে আর ফিরল না দেখে সেকেলে বাপের মতোই রাত বারোটায় রংপুর শহর চষতে হলো মনসুরকেই, খোঁজ নিতে হলো থানায় থানায়, হাসপাতালে, ক্লিনিকে। তারপর চরম খবর জেনে ফেলার পর বহু যন্ত্রণার ভেলায় চড়ে অগাধ সমুদ্রের মতো একটা দিনকে পার করে একখানা মরুভূমি সঙ্গে নিয়ে ফিরতে হলো।
এসবের বদল নেই একালে। সমস্ত ঘটনা ছবির মতো সাজাতে চেষ্টা করল মনসুর। সেই গতকালের রাত ন’টা থেকে।
পড়তে পড়তে উঠে এসছিল পার্থ, বলেছিল- ‘মা আমায় খেতে দাও। বরাবরই এরকম পার্থ। ছেলেবেলা থেকেই খিদে পেলেই আর এক মিনিট দাঁড়াতে পারে না সে।
লীনা খেতে দিতে উঠেছিল। ঠিক সেই সময়েই পার্থকে বাইরে কে ডাকলো। ফটিক এসে বললো পার্থ ভাইয়া, আপনাকে একটি ছেলে ডাকতেছে।
ছেলে ডাকতেছে।
লীনা রেগে বলেছিল, তা হলে তো হয়ে গেল খাওয়া। ভয়ানক একটা অশুভক্ষণে হয়ত এই অশুভ কথাটা উচ্চারণ করেছিল লীনা। তুমি দাও না, আমি আসছি­ বলে নেমে গিয়েছিল পার্থ। আর উঠে আসেনি।
অনেকক্ষণ পর লীনা বলেছিল- ফটিক দেখে আয়তো পার্থ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে এত গল্প করছে।
ফটিক অম্লান কণ্ঠে বলল- রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেন হবে? বড় ভাই তো ছেলেটার সঙ্গে বেরিয়ে গেল।
বেরিয়ে গেল! খেতে দিতে বলে বেরিয়ে গেল।
লীনা দৌড়ে এসে বলল ‘ওগো তুমি একটু বেরিয়ে দেখ না। খেতে চাইলো হঠাৎ কে এসে ডাকলো, কার সঙ্গে বেরিয়ে গেল, এখনো ফিরছে না- আমার বড়ো ভাবনা হচ্ছে।
মনসুর বলেছিলেন-ভাবনা করার আইনটা তাহলে উঠে যায়নি এখনও?
লীনা ধিক্কার দিয়ে বলেছিল- ছি: ছি: এই সময় তুমি আমার সঙ্গে শোধ নেওয়া নিয়ি করছো? তুমি না বাপ?
তাও তো বটে! মনসুর সাহেব তাই বেরিয়ে গিয়েছিলেন। দোকান টোকান তো সবই ব হয়ে গিয়েছিল, রাস্তা ছমছমে হয়ে এসেছিল। মনসুর পাড়ায় যাকে যাকে পেয়েছিলেন জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেউ বলেছিল দেখিনি তো, কেউ বলেছিল হ্যাঁ একটু আগে দেখেছিলাম বটে একটা পটকামতন ছেলের সঙ্গে যেতে-
তারপর?
তারপর- বাসায় ফিরে ফোন করতে শুরু করেছিলেন মনে পড়েছে।
ফোনের পর ফোন। তারপর? না আর কিছু মনে পড়ছে না, সব গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে করতে পারছেন না পুলিশ কখন এসে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার আরও একটি ছেলে আছে না? কি নাম তার? কতো বয়স?
মনসুরের ভেতরটা আবার ধুলো হয়ে উঠেছে। তার কাছে কেউ আসছে না। হঠাৎ বেখাপ্পাভাবে মনে পড়ল ফটিক নামের খিদে কাতর ছেলেটা আজ সারাদিন মুড়ি খেয়ে আছে। তার সঙ্গে যারা এসেছিল তারা লীনাকে দ্বিতীয় খবরটা দেয়নি তো? তাই কি হতে পারে? ওরা মানুষ তো? না পাষাণ…
সাহেব বড় মা বলেছেন গোসল করে নিতে, চায়ের পানি চাপিয়েছে! হঠাৎ যেন একটা ছুতো পান মনসুর দোতলায় উঠে যাবার। যে জায়গাটা তাকে টানছে এতক্ষণ ধরে, শুধু হঠাৎ সিঁড়ির মাঝামাঝি ঘরটায় ঢুকে পড়েছেন বলে লজ্জায় আর যেতে পারছেন না। এবার তিনি বাকি সিঁড়িটা উঠে গিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় চিৎকার করে উঠলেন, কেন আমার জন্য চায়ের পানি কেন? খুব শীতল হয়ে ফিরেছি আমি? তাই আমাকে আর বরফ দেওয়া শরবৎ দেওয়ার দরকার নাই, কেমন?
নিজের গলাটা নিজের কানে কেমন বেসুরো লাগল। তবু স্বর। যাতে ভরসা ফেরে। স্তব্ধতা ভয়ঙ্কর। শব্দহীনতা যেন প্রেতের মতো গলাটিপে মারতে আসে। লীনা তার স্বামীর কণ্ঠস্বর শুনে সাহস করে এগিয়ে এলো অস্ফুটে বলল- রাত হয়ে গেছে তাই…
ও: তাই! তা সারাদিন ধরে আমার গলায় কেউ ঠাণ্ডা পানি ঢেলেছিল বলে মনে হচ্ছে?
না ওরা এসে চা খেতে চাইল কিনা!
ওরা কারা?
ওরা মানে কি?
ওরা, তোমার সঙ্গে সারাদিন যারা ছিল।
ও: তাহলে মনসুরকে নামিয়ে দিয়ে তারা চলে যায়নি। ওরা এসেছে, বসেছে, চা খেয়েছে, হয়ত এরপর এ বাড়িতে রাতের খাওয়াটাও হবে, রান্না-বান্না হবে। হঠাৎ আবার ফটিকটার কথাও মনে এলো তার, রান্না হলে ফটিকটাও খেতে পারবে।
আশ্চর্য, মনসুর সাহেব কি পাথরে গড়া? তার একটা ছেলে খুন হয়ে মর্গে রয়েছে আর ছোট ছেলেটা খুনের আসামি হয়ে জেলে রয়েছে, অথচ তিনি কিনা ফটিকের খাওয়ার কথা চিন্তা করছেন? যে ফটিক বাড়ির একটা চাকর ছাড়া আর কিছুই নয়।
এখনো মনসুর সাহেবের ঘর সেই আগের মতই সাজানো পরিপাটি, তেমনি বাহারি খাট, তবুও সবকিছুই তার কাছে কেমন অনিয়ম মনে হচ্ছে। অথচ আসলে সত্যি কিছু অনিয়ম নয়, সংসারে আকস্মিক একটা দুর্ঘটনা ঘটলে লোকে ঘর সংসার সবকিছু ভেঙে চুরে ফেলে ছড়িয়ে তছনছ করে দেয়? শোয়ার জায়গায় শোয় না?
বসার জায়গায় বসে না? না কী পরার জামা কাপড়গুলো ধুলো মাখিয়ে ময়লা করে নেয়? তার চোখের সামনে গত রাত থেকে আজ সারাদিনের অজস্র কদর্য কুৎসিত বীভৎস দৃশ্য ভেসে উঠল, তার পেটের ভেতর থেকে আবার কাঠবমি ঠ্যালা দিয়ে উঠল।
হঠাৎ লীনা তীব্র তীক্ষî কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, পার্থ আমার খেতে চেয়ে চলে গেল, আর এলো না, যতক্ষণ না সেই খুনি শয়তানকে খুঁজে এনে উচিত শাস্তি দিচ্ছ তোমরা ততক্ষণ আমি-
মনসুরের মধ্যে আবার সেই আগুনের শিখাটা চড়াৎ করে উঠল, তার মানে লীনা জেনে গেছে তার বড় ছেলে খুন হয়েছে; ওরা লীনাকে জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু লীনা কি জানে যে খুনের আসামি কে? তার মনে হলো এই মুহূর্তে এই শোকের বিলাসিতা ভেঙে দিতে পারেন তিনি, সে অস্ত্র তার হাতেই আছে। অথচ একটু আগে কথা সাজাচ্ছিলেন তিনি, যাতে লীনার কাছে দ্বিতীয় খবরটি না পৌঁছায়। মনসুর সাহেব হৈ চৈ করে কিছু বললেন না, শান্ত গলায় বললেন- সেই উচিত শাস্তিটা দিলে পার্থ ফিরে আসবে?
জানি জানি, আসবে না জানি। লীনা উম্মাদের চোখে চেয়ে বলল তবু তাতে আমার এই জ্বালাটা জুড়াবে। জুড়াবে বুঝি? মনসুর যেন ব্যাঙ্গের গলায় বলে উঠলেন, তাহলে তো দিতেই হয় খবরটা। খুঁজতে হবে না, পাওয়া গেছে সেই শয়তানকে।
পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে তাকে? কোথায় কোথায় সে?
হাজতে
হাজতে! তুমি দেখে এসেছো তাকে, জিজ্ঞেস করেছো পার্থ তার কি করেছিল?
জিজ্ঞেস করিনি!
জিজ্ঞেস করনি? কি পাষাণ প্রাণগো তোমার! আমায় নিয়ে চলো আমি গিয়ে তাকে দেখি।
দেখতে হবে না, অনেক দেখেছো তাকে।
অনেক দেখিছি
লীনা হঠাৎ ভয় পেয়ে যায়, খুব ভয়। লীনার কান্না থেমে যায়। গলা থেকে অস্ফূট শব্দ বেরিয়ে আসে কে? তোমার ছোট ছেলে। ….
লীনার দু’ঠোঁট জোড়া লেগে যায়। শুধু বড় হতে থাকে চোখের সাদা অংশ। পৃথিবীর সমস্ত ভাষা তখন কেঁদে ফিরে যায় লীনার চোখে।

[ তৌ ফি ক আ ক ন্দ ]