ভারত-পাকিস্তানের সামরিক নিরাপত্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা – মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান

উষ্ণতাই এ মেরুকরণের সূচনা ঘটাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এত দিন তাদের বিশস্ত মিত্র পাকিস্তানের ওপর ভর করে এ অঞ্চলে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেও সম্প্রতি তারা ভারতের সাথেও কার্যকর একটা ঐক্যে পৌঁছানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারত তার জন্মলগ্ন থেকেই মার্কিনবিরোধী ব্লকের অংশ। কিন্তু  ৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিনের সাথে মিত্রতার একটা প্রচ্ছন্ন নীতি তারা গ্রহণ করে। যা গত কয়েক বছরে চরমভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এটা বেশ দ্রুততার সাথে পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। এ দিকে চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক অগ্রগতি এ অঞ্চলের রাজনীতিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। দক্ষিণ এশিয়ার পৌঁনে ২০০ কোটি জনসংখ্যা চীনের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করছে। ইতোমধ্যে তারা এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে কার্যকর অগ্রগতিও ঘটিয়েছে। চীনা পণ্যে ছেয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ বাজার। চীন তার পুঁজির নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এটা খুবই স্বাভাবিক। আবার এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতও তার আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সবকিছু কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছে চীন ও ভারত উভয়েই। বিশ্ব পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অবস্থায় বসে থাকতে পারে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চীন ও ভারতের মধ্যে ভারতকেই সে বন্ধু হিসেবে কাছে পেতে চাইছে। দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অপরিসীম। সে তার ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের এক তোলাও ছেড়ে দিতে চাইছে না। নতুন কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-পাকিস্তান সংযোগ
যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় বিশেষত এ অঞ্চলে ভারতকে কেন্দ্র ধরেই কাজ করছে দীর্ঘদিন। যুক্তরাষ্ট্র এখন ইরানের বিরুদ্ধে ভারতকে দেখতে চায়। চীনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চায় ভারতকে। ভারতকে তাই সামরিক আর অর্থনৈতিক সব দিক থেকে তার বলীয়ান করা দরকার। আবার অন্য দিকে প্রয়োজনে ভারতকে সামাল দেয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপর নানাভাবে আছর করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর দেশ ভারতের শাসক শ্রেণীর মধ্যে এখন সুপারপাওয়ার হওয়ার সাধ তৈরি হয়েছে। ৪০ শতাংশেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে ভারতে। অথচ সেই দেশের অবস্থান বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সেনাবাহিনীর স্থানে। সেই দেশ পারমাণবিক শক্তি ধারণ করে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ করে সেই দেশ প্রবেশ করেছে ‘পারমাণবিক ক্লাবে’র মধ্যে। পাকিস্তানও এ দিক থেকে পিছিয়ে নেই। দারিদ্র্য আর সঙ্ঘাতক্লিষ্ট এই আরেক দেশ যেখানে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম সেনাবাহিনীর বাস। এই চতুর্থ ও ষষ্ঠ বৃহত্তম সেনাবাহিনী কী করে? তারা বছরের পর বছর নতুন নতুন অস্ত্র কিনে বিশ্বের অস্ত্র বাণিজ্য চাঙ্গা রাখে।

ভারতের অস্ত্রশস্ত্র অর্ধেকই সেকেলে
ভারতের প্রতিরক্ষার অস্ত্র ও সাজসরঞ্জামের অর্ধেকই সেকেলে ও মেয়াদোত্তীর্ণ। মাত্র ১৫ শতাংশ যুগোপযোগী। ভারতের প্রতিরক্ষা বিভাগের কনসালটেন্সি ফার্ম কেপিএমজি এবং ‘কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি’র এক প্রতিবেদনে অতিসম্প্রতি এ কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, এ চিত্র জঙ্গি তৎপরতা ও সহিংসতাপূর্ণ এ অঞ্চলে ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির ঘাটতিকেই স্পষ্ট করে তুলেছে। মুম্বাই ২০০৮ সালে সন্ত্রাসী হামলায় ১৬৬ জন নিহতের পর গত বছর নয়াদিল্লি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহসংক্রান্ত নীতি পরিবর্তন করে। মুম্বাই হামলা ভারতের নিরাপত্তাব্যবস্থায় বড় ধরনের ফাঁকফোকর স্পষ্ট করে তুলেছিল। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি মুম্বাই হামলার পর দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নতির দিকে জোর মনোযোগ দেয়ার কথা বলেন। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুগোপযোগী সরঞ্জাম তৈরি করার জন্য সরকারের সাহায্য করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। সরকার জানিয়েছে, তারা পাকিস্তান এবং চীনের সম্ভাব্য হুমকি থেকে সুরক্ষায় সোভিয়েত আমলের অস্ত্রগুলোর আধুনিকায়ন করবে। ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ায় ১৯৯০ সাল থেকে ভারত প্রায় ২০০টি রাশিয়ার নির্মিত মিগ জঙ্গিবিমান ব্যবহার করতে পারছে না। ভারত চাইছে তাদের বিমান বাহিনীর শক্তি আরো বাড়াতে। ২০২০ সালের মধ্যে তারা বিমান বাহিনীকে ৩৪ স্কোয়াড্রন (৬১২টি জঙ্গি বিমান) থেকে ৪২ স্কোয়াড্রনে (৭৫৬টি জঙ্গি বিমান) উন্নীত করতে চাইছে। সেই সাথে সামরিক বাহিনীরও জরুরি কিছু নতুন অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। ১৯৮৬ সালে হাউইৎজার কামান কেনার পর সামরিক বাহিনীর জন্য আর কোনো বড় অস্ত্র কেনেনি ভারত। প্রতিবেদনে বলা হয়,  ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধে সাজসরঞ্জামের অপ্রতুলতা ভালোভাবেই টের পাওয়া যায়। তখনই অস্ত্রশস্ত্র আধুনিকীকরণের তাগিদ দেখা দেয়। ২০০০ সাল থেকে ভারত রাশিয়ার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের কাছ থেকে অস্ত্র কেনা শুরু করে।

যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিকীকরণকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল
ভারত বিভাগের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পুরো অঞ্চলে সমাজতন্ত্রী আন্দোলনবিরোধী ব্যূহ রচনার জন্য পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্ক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অবলম্বন। একাধিক সামরিক চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিকীকরণকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল। ভারত-পাকিস্তান বিরোধ, কাশ্মীর সমস্যা এ জন্য ছিল খুব ভালো উপলক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রের বশ্য রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের সেই অবস্থানের কোনো পরিবর্তন এখনো হয়নি।

২০১৫ সাল পর্যন্ত ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সমন্বিত সামরিকব্যবস্থা গ্রহণ করবে
সামরিক ক্ষেত্রে মার্কিন-ভারত সম্পর্ক নতুন মোড় নেয় এই ৯০-এর দশকেই। যা আরো পরিণত রূপ পেয়েছে বর্তমান দশকে বিশেষত ২০০৫ সালে। এই বছর ২৮ জুন দু’দেশের মধ্যে ‘নিউ ফ্রেমওয়ার্ক ফর দ্য ইউএস-ইন্ডিয়া ডিফেন্স রিলেশনস’ নামে নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বলা হয় এই চুক্তি করা হয়েছে ১৯৯৫ সালের বোঝাপড়ার সূত্র ধরে। ২০১৫ পর্যন্ত এই চুক্তি অনুযায়ী দু’দেশ সামরিক ক্ষেত্রে সমন্বিতব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বস্তুত সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর থেকেই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন সম্পর্ক বিকাশে উদ্যোগী হয়। পারমাণবিক শক্তি বিকাশেও পরস্পর যোগাযোগ ছিল। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান দু’দেশই পারমাণবিক বিস্ফোরণ চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর ‘তথাকথিত’ অবরোধ আরোপ করে। ‘তথাকথিত’ বলছি এই কারণে যে, কোনো অবরোধ যুক্তরাষ্ট্র এলেই আরোপ করে এবং কোনটি তার লোকদেখানো সেটা খেয়াল করলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আসল অবরোধ বা বৈরিতা কাকে বলে তা ইরান, ইরাক, উত্তর কোরিয়া, কিউবার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মার মার কাট কাট ভূমিকা দেখলে সহজেই বোঝা যায়।
তবে ভারত ও পাকিস্তানের এই পারমাণবিক বিস্ফোরণকে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ব্ল্যাকমেইল করে এই দু’টি দেশের সাথে অধিকতর ধ্বংসাত্মক বন্ধন তৈরি করতে। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে পুরোমাত্রায় ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর বিনিময়ে পাকিস্তানের ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়। আর ভারতের সাথে চলে অধিকতর সামরিক নৈকট্য স্থাপনের কথাবার্তা এবং ‘যৌথ স্বার্থে’ নানা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য তৎ। এসবেরই ফল ২০০৫ সালের চুক্তি। এই চুক্তির মধ্যে প্রকাশ্যেই যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে তার মধ্যে আছে :

>    সামরিক ক্ষেত্রে পরস্পর অব্যাহত যোগাযোগ ও উন্নয়ন
>    গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান বৃদ্ধি
>    সমরাস্ত্র বাণিজ্য সম্প্রসারণ
>    প্রযুক্তি স্থানান্তর, সহযোগিতা, যৌথ উৎদন, গবেষণা ও উন্নয়ন
>    মিসাইল প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সম্প্রসারণ
>    সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে উপযোগী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণ
>    নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় যৌথ তৎপরতা ও সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি
>    যৌথ ও সমন্বিত মহড়া
>    বহুজাতিক কর্মসূচিতে সহযোগিতা বৃদ্ধি

ভারত এনটিপিতে স্বাক্ষর না করলেও যুক্তরাষ্ট্র তার সাথে চুক্তি করেছে
ভারত এখন পর্যন্ত পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি বা এনপিটিতে স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে দুই কোটি ৭০ লাখ ডলার মূল্যের সর্ববৃহৎ পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মজার ব্যাপার হলো, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থাসহ (আইএইএ) আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানই এই চুক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়নি। ভারত ও ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর নীতি ও আচরণের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো পরমাণু প্রযুক্তি এখন পাশ্চাত্যের আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই বিভিন্ন দেশ এখন পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।
এক শ’ কোটিরও বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ ভারতেও বিদ্যুৎ চাহিদা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারত সরকার ২০২০ সালের মধ্যে ২৫ হাজার মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কিন্তু বিদেশী সহযোগিতা ছাড়া এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ভারতের সাথে আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি বড় লক্ষ্য হলো, ভারতকে নিজের সম্প্রসারণকামী নীতির বাস্তবায়নকারীতে পরিণত করা। ভারত সরকার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে এ পর্যন্ত মার্কিন নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে অথবা এ ধরনের নীতির বিরোধিতা করা থেকে বিরত থেকেছে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ’র নির্বাহী পরিষদে ইরানের পরমাণু ইস্যুতে ভারত, মার্কিন নীতিকেই সমর্থন করেছে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং দক্ষিণ এশিয়ার আর্থ-রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজের আধিপত্যকামী নীতির বাস্তবায়ন আরো সুনিশ্চিত করতে হোয়াইট হাউজ পরমাণু চুক্তিতে স্বাক্ষর ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে ভারতের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে একতরফা হামলার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের মতো এনপিটি লঙ্ঘনকারী দেশ ভারতের সাথে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো আইনকানুনের তোয়াক্কা করেনি। পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি বা এনপিটি’র একটি ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এনপিটিতে স্বাক্ষর করেনি এমন কোনো দেশকে এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো পরমাণু ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সহযোগিতা দিতে পারবে না।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত-মার্কিন চুক্তির জোড়ালো বিরোধিতা ছিল না
ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে পরমাণু চুক্তির পক্ষে নিজ নিজ দেশে জনমত তৈরি করতে তিন বছর ব্যয় করতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এই চুক্তির কিছুটা বিরোধিতা হয়েছে। কিন্তু বিরোধিতার মাত্রা এমন পর্যায়ে ছিল না যে, তা ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তিকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করতে পারে। কিন্তু খোদ ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই চুক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। এই ইস্যুতে ভারতের সংসদে আস্থা ভোটের সম্মুখীন হতে হয়েছে সরকারকে। ভারতের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, পরমাণু চুক্তির কারণে ভারতের ওপর মার্কিন আধিপত্যের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং ভারত তার রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারাবে। মার্কিন কংগ্রেসে এই চুক্তির বিরোধিতা হয়েছে এ কারণে যে, ভারত এনপিটিতে স্বাক্ষর করেনি এবং এ কারণে পরমাণু ক্ষেত্রে মার্কিন সহযোগিতা ভারত সামরিক খাতে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু অবশেষে উভয় দেশের সংসদই পরমাণু চুক্তি অনুমোদন করেছে এবং দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাতে স্বাক্ষর করে চুক্তিটিকে চূড়ান্ত রূপ দিয়েছেন। দুই কোটি ৭০ লাখ ডলারের এই চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগামী ২০২০ সালের মধ্যে ভারতে ১৮ থেকে ২০টি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে। কিন্তু এই চুক্তির পরও আইএইএ’র পরিদর্শকরা ভারতের সামরিক পরমাণু কেন্দ্রগুলোতে প্রবেশের সুযোগ পাবে না।

ভারতের চেয়ে পাকিস্তানের কাছে বেশি পরমাণু অস্ত্রের মজুদ রয়েছে!
দুই মার্কিন পরমাণু বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি বলেছেন, ভারতের চেয়ে পাকিস্তানের কাছে বেশি পরমাণু অস্ত্র মজুদ রয়েছে। চীনসহ এই দু’টি প্রতিবেশী দেশ নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ এবং নতুন নতুন জায়গায় অস্ত্র মোতায়েন করে চলেছে। রবার্ট এস নরিস ও হান্স এম ক্রিস্টেনসেন ‘নিউক্লিয়ার নোটবুক : ওয়ার্ল্ডওয়াইড ডেপ্লয়মেন্ট অব নিউক্লিয়ার উইপনস-২০০৯’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বলেন, পাকিস্তানের কাছে আনুমানিক ৭০ থেকে ৯০টি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। অন্য দিকে ভারতের কাছে রয়েছে ৬০ থেকে ৮০টি। বুলেটিন অব দি অ্যাটমিক সায়েন্স-এর একটি সংখ্যায় নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, বেইজিং, ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লি সংখ্যাগত ও গুণগতভাবে নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে চলেছে এবং আরো নতুন নতুন জায়গায় এসব অস্ত্র মোতায়েন করছে।

পাকিস্তানের পরমাণু স্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে
পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এক দিকে দেশে চলছে তালেবান জঙ্গিদের তৎপরতা এবং অন্য দিকে প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে চলছে যুদ্ধ এ দু’য়ে মিলে পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডারকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের শাসনামলের এক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ স্টিফেন হ্যাডলি সম্প্রতি এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। হ্যাডলি এখন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিসের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। কানাডার হ্যালিফেক্সে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্মেলনে দেয়া বক্তৃতায় হ্যাডলি আরো বলেন, বিভিন্ন সমস্যা পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। বুশ শাসনামলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে বুশ প্রশাসনের সবাই তখন উদ্বিগ্ন ছিল। বিশেষ করে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী আফগানিস্তানে হামলা চালানোর কারণে পাকিস্তানও যে অস্থির হয়ে উঠবেÑ এটা বুশ প্রশাসন অনুমান করতে পেরেছিল। তারা এ কারণে উদ্বিগ্নও ছিল। এমনকি ওই পরিস্থিতি দেশটিকে তালেবান শাসনের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলেও মার্কিন প্রশাসন আশঙ্কা করেছিল। হ্যাডলি স্বস্তি প্রকাশ করে বলেন, এখনো পাকিস্তানে সেসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেনি। পরমাণু অস্ত্রও বেসামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে সেই শঙ্কা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে।

পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র রক্ষায় মার্কিন প্রস্তুতি
পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র যাতে জঙ্গিদের হাতে না যায়, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দলকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এলিট এ বাহিনী পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র পাহারা দেবে, একই সাথে পরমাণু অস্ত্র বা উপাদান কোনোভাবে জঙ্গিদের হাতে গেলে তা পুনরুদ্ধার করবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মার্কিনবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি এবং গত দুই বছরে স্পর্শকাতর কিছু স্থাপনায় জঙ্গি হামলার ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র এ উদ্যোগ নেয়। এক মাস ধরে মার্কিন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে পাকিস্তানের কাছে তাদের উদ্বেগের কথাও জানায়। ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম টাইমস অনলাইন  গত মসের প্রথম দিকে এক প্রতিবেদনে এ কথা জানায়। মার্কিন অ্যানার্জি ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান ও সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা রলফ মোয়াট-লারসেন বলেন, ‘পাকিস্তান হলো এমন একটি দেশ যার পরমাণু অস্ত্রও রয়েছে, একই সাথে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জঙ্গিও আছে। এ কারণে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার অধিকার রয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, পাকিস্তানে এমন কিছু সেনাঘাঁটিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে পরমাণু অস্ত্র সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীতে জঙ্গি অনুপ্রবেশের ঘটনাও দেখা গেছে। ব্রাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকিস্তানের নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষক দলের পরিচালক অধ্যাপক শন গ্রেগরি ২০০৭ সাল থেকে পাকিস্তানে হওয়া সব হামলা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, জঙ্গিরা এখন দরজায় কড়া নাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট পয়েন্ট মিলিটারি একাডেমি থেকে প্রকাশিত একটি সাময়িকীতে গ্রেগরি পাকিস্তানের তিনটি হামলার তথ্য প্রকাশ করেছেন। প্রথমটি ২০০৭ সালের নভেম্বরে পাঞ্জাবের সারগোধায়, পরের মাসে আত্তক জেলার কারমায় এবং ২০০৮ সালের আগস্টে পাঞ্জাবের ওয়াহ সেনানিবাসে। এ তিনটি জায়গায়ই পরমাণু অস্ত্র মজুদ ছিল। এরপর গত অক্টোবরে কারমায় আরেক দফা হামলা হয়। এ ছাড়া গত আগস্টে সারগোধা থেকে ছয়জন আত্মঘাতী হামলাকারীকে গ্রেফতার করা হয়। তবে এসব জায়গায় পরমাণু অস্ত্রের অস্তিত্বের কথা পাকিস্তান অস্বীকার করেছে। গ্রেগরি বলেন, আট থেকে ১২ হাজার মানুষ পাকিস্তানি পরমাণু প্রকল্পের সাথে নানাভাবে জড়িত। তাদের অনেকেরই জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওসামা বিন লাদেনের সাথে যোগাযোগ থাকার অভিযোগে ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর পাকিস্তানের প্লুটোনিয়াম চুল্লির সাবেক প্রধান বশির মাহমুদকে সহযোগীসহ গ্রেফতার করা হয়। টাইমস অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত অক্টোবরে রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতরে হামলার পর ভয় আরো বেড়ে গেছে। গত মাসে ইসলামাবাদের নৌবাহিনীর কমান্ড সেন্টারেও হামলা হয়েছে। এ ছাড়া গত মাসে পাঁচ মার্কিন নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাঞ্জাবের পরমাণু স্থাপনা চশমা ব্যারেজের নকশা পাওয়া গেছে। মোয়াট লারসেন বলেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, জঙ্গিরা পরমাণু অস্ত্র হাতে পাওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা পেশাদারির সাথে এগোচ্ছে।

ইরানের পরমাণু প্রযুক্তি অর্জনে সহায়তা করেছে পাকিস্তান
ইরানের পরমাণু প্রযুক্তি অর্জনে পাকিস্তান সাহায্য করেছে। আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলা করা এবং ইসরাইলের ক্ষমতা খর্ব করে এ অঞ্চলে একটি ‘শক্তিশালী জোট’ গড়ে তোলার লক্ষ্যেই ইসলামাবাদ পরমাণু অস্ত্রের ব্যাপারে তেহরানকে সহায়তা করেছে। পাকিস্তানের একটি উর্দু টেলিভিশন চ্যানেলের সাথে এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী আবদুল কাদির খান এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটির একটি ইংরেজি ভাষ্য সংগ্রহ করেছে ‘সিক্রেসি নিউজ অব দ্য ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্ট’। কাদির খান বলেছেন, ‘পরমাণু প্রযুক্তির ব্যাপারে ইরানের কর্মকর্তারা দুবাইয়ে পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আমরা ইরানের কর্মকর্তাদের বলেছিলাম, পাকিস্তানের পরমাণু প্রযুক্তি সরবরাহকারীরা খুবই বিশ্বস্ত।’ পরমাণু প্রযুক্তির ব্যাপারে তেহরানের আগ্রহের কথা উল্লেখ করে কাদির খান বলেন, ‘ইরান যেহেতু একটি মুসলিম দেশ, তাই আমরা চেয়েছি তারা পরমাণু প্রযুক্তির মালিক হোক। পশ্চিমা বিশ্ব এ ব্যাপারে অন্যায়ভাবে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। ইরান যদি পরমাণু প্রযুক্তি অর্জন করতে পারে, তবে আমরা এ অঞ্চলে আন্তর্জাতিক চাপের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী জোটে পরিণত হতে পারব।’ কাদির খান আরো বলেন, ‘ইরানের পরমাণু শক্তি ইসরাইলের শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করতে সাহায্য করবে। আমরা ইরানকে পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে পরমাণু প্রযুক্তি কেনার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিলাম।’ পাকিস্তানের এই পরমাণু বিজ্ঞানী আরো বলেন, ‘দুবাইয়ে শ্রীলঙ্কান মুসলমানরাই পাকিস্তান, ইরান ও লিবিয়ায় পরমাণু প্রযুক্তি ও এর সরঞ্জাম সরবরাহ করে।’

ভারতের পারমাণবিক ডুবোজাহাজকে হুমকি মনে করে পাকিস্তান
ভারতের নৌবাহিনীতে দেশে তৈরি পরমাণু শক্তিসম্পন্ন ডুবোজাহাজের অন্তর্ভুক্তিকে আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেছে পাকিস্তান। ‘কৌশলগত ভারসাম্য’ রক্ষার জন্য ‘যথাযথ পদক্ষেপ’ নেয়ারও ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। গত বছর ডুবোজাহাজটি উদ্বোধন করা হয়। ডুবোজাহাটির উদ্বোধনকালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ভারত যেভাবে নতুন প্রাণঘাতী অস্ত্রের অভিষেক অব্যাহত রেখেছে, সেটা আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আবদুল বাসিত বলেন, নিজেদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেবে পাকিস্তান। তবে তারা অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নামবে না। পাকিস্তান বিশ্বাস করে, এ অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। পারমাণবিক ডুবোজাহাজের উদ্বোধনকে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী একটি পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন পাকিস্তানের নৌবাহিনীর মুখপাত্র ক্যাপ্টেন আবিদ মাজেদ বাট। ডন নিউজ টেলিভিশনকে তিনি বলেন, এটা গোটা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তাকে বিপদগ্রস্ত করে তুলবে।
দেশে তৈরি এই পারমাণবিক ডুবোজাহাজ ‘আইএনএস অরিহন্ত’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। এই ডুবোজাহাজ থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া সম্ভব। এর উদ্বোধন করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, অন্য কারো প্রতি তাদের কোনো ধরনের আগ্রাসী অভিপ্রায় নেই। ভারতসহ মাত্র ছয়টি দেশের কাছে দেশে তৈরি পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ রয়েছে। অন্য দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও চীন।

যুক্তরাষ্ট্রকে স্পর্শকাতর পরমাণু তথ্য দিয়েছিলেন মোশাররফ
পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী ড. আবদুল কাদির খান আরো বলেছেন, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচি সম্পর্কিত স্পর্শকাতর বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করেছিলেন। এসংক্রান্ত প্রমাণাদি তার কাছে আছে এবং চাইলে তিনি আদালতের সামনে এসব তথ্য উপস্থাপন করতে পারবেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর একটি প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করে পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক কাদির খান এ কথা বলেন। ড. আবদুল কাদির খান দাবি করেন, ক্ষমতায় থাকাকালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জাফরুল্লাহ খান জামালি এসংক্রান্ত আদেশে সই করতে রাজি না হওয়ায় সেটা তখন সম্ভব হয়নি। কাদির খান বলেন, ওই আদেশে সই করার জন্য প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী জামালি। কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যদের আস্থা অর্জনের পর তিনি ওই আদেশে সই করতে অস্বীকৃতি জানান। মোশাররফ তার হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য একটি সি-১৩০ বিমানও প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। পারভেজ মোশাররফকে যুক্তরাষ্ট্রের ভাঁড় হিসেবে বর্ণনা করে এই পরমাণু বিজ্ঞানী বলেন, এখন সময় এসেছে, পরমাণু কর্মসূচির বিস্তারিত তথ্য হস্তান্তর সম্পর্কে অবশ্যই জনগণকে অবহিত করতে হবে। এ ব্যাপারে তদন্ত ও মোশাররফের বিচার করতে হবে। তিনি বলেন, এটা এখন সবাই জানে, ইসরাইল ও অন্যান্য দেশের সাথে সাবেক এই জেনারেলের গভীর সখ্য ছিল। কাদির খান বলেন, খোদাই জানেন, ওই দেশগুলোর কাছে কী পরিমাণ গোপন তথ্য হস্তান্তর করেছিলেন মোশাররফ। তবে তিনি স্বীকার করেন, প্রেসিডেন্ট মোশাররফের মেয়াদকালে তাকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। প্রসঙ্গত, চীন পাকিস্তানকে দু’টি পরমাণু বোমা বানানোর মতো ইউরেনিয়াম সরবরাহ করেছিলÑ এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য সবার আগে কাদির খানই প্রকাশ করেছিলেন।

পরমাণু বোমা তৈরির জন্য পাকিস্তানকে ইউরেনিয়াম দিয়েছিল চীন!
দু’টি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য পাকিস্তানকে ৫০ কেজি ইউরেনিয়াম সরবরাহ করেছিল চীন। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের মধ্যকার সমঝোতার ভিত্তিতে ১৯৮২ সালে ওই ইউরেনিয়াম সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি পাকিস্তানকে পরমাণু বোমা তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় নকশা ও সরঞ্জাম দিয়েও সহায়তা করেছে সমাজতান্ত্রিক দেশটি। গত বছরের ১৩ নভেম্বর পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী আবদুল কাদির খানের একটি চিঠির বরাত দিয়ে প্রভাবশালী মার্কিন পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট এ কথা জানায়। তবে পাকিস্তান সরকার এ তথ্যকে ‘ভিত্তিহীন’ উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। ওই চিঠির বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানায়, ১৯৭৬ সালে ভুট্টো চেয়ারম্যান মাওয়ের কাছে পরমাণু বোমা তৈরি করার ব্যাপারে সাহায্য চান। সে অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে এই লেনদেন হয়। চিঠিতে কাদির খান লিখেছেন, ‘আমার ব্যক্তিগত অনুরোধে চীনের মন্ত্রী আমাদের ৫০ কেজি বোমা বানানোর উপযোগী ইউরেনিয়াম দেন।’ তিনি জানান, মূলত ভারত ও ইসরাইলের ঘনিষ্ঠতা এবং পাকিস্তানের পরমাণু স্থাপনার ওপর এই দুই দেশের হামলার আশঙ্কা থেকে পাকিস্তান চীনের কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য চেয়েছিল। চিঠিতে কাদির খান লেখেন, ‘আমাদের কাজের গতি ও সাফল্য দেখে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শত্রু ও তাদের পরামর্শদাতারাও বিস্মিত হবে এবং পশ্চিমা বিশ্ব অসহায়ভাবে দেখবে, সাইকেলের চেইন বা সুঁচ বানাতে পারে না, এমন একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশ কিভাবে স্বল্পতম সময়ে বিশ্বের সর্বাধুনিক পরমাণু প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে উঠেছে।’ পরমাণু অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তি ভঙ্গ করে চীন পাকিস্তানকে পরমাণু বোমা বানাতে সাহায্য করেছেÑ ওয়াশিংটনের এমন দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করল কাদির খানের এই চিঠি। ২০০৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আবদুল কাদির খানকে গৃহবন্দী করার পর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জন্য এসব নথি প্রস্তুত করেন তিনি। তার আগে স্ত্রীকে চিঠি লিখে এ ব্যাপারে জানান কাদির খান। ওই চিঠিই ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিকের হাতে পড়ে। এ দিকে পত্রিকাটিতে প্রকাশিত ওই তথ্য প্রত্যাখ্যান করে এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ওই প্রতিবেদনে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে কঠোরভাবে তা প্রত্যাখ্যান করছে পাকিস্তান। পাকিস্তান ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কে চিড় ধরাতেই এমন তথ্য রটানো হচ্ছে। দুই দেশই আন্তর্জাতিক রীতি ও আইন এবং অস্ত্রবিস্তার রোধসংক্রান্ত নিয়মকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়েছেন জারদারি
দেশের পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির হাতে ছেড়ে দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি। রাজনৈতিক চাপ সামাল দেয়ার উদ্দেশ্যেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ পদক্ষেপকে প্রধানমন্ত্রী ও পার্লামেন্টকে আরো শক্তিশালী করার পথে বড় ধরনের অগ্রগতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রেসিডেন্ট জারদারির একজন মুখপাত্র। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক ও সামরিক সমালোচকদের শান্ত করতেই এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে দেয়া এক ঘোষণায় বলা হয়েছে, পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটির নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গিলানি বলেন, ন্যাশনাল কমান্ডসংশ্লিষ্ট ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণমূলক কর্তৃত্ব তার হাতে হস্তান্তর করেছেন প্রেসিডেন্ট। এ বিষয়ে একটি অধ্যাদেশও জারি করেছেন তিনি। প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ফরহাতুল্লাহ বাবর বলেন, ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটির দায়িত্ব হস্তান্তর নির্বাচিত পার্লামেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে আরো শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ। তবে অন্য এক মুখপাত্র বলেন, প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি একনায়কমূলক ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন। একজন অনির্বাচিত নেতা হিসেবে নিজেকে আরো শক্তিশালী করার জন্য জারদারির এই ক্ষমতার প্রয়োজন ছিল।

শেষ কথা
ইউনাইটেড স্টেটস অব অ্যামেরিকা। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই দেশটি ব্রিটেনের শাসন থেকে মুক্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্র এক সময় সমগ্র বিশ্বের কাছে মুক্ত বিশ্ব হিসেবেই পরিচিত ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে এখানে ইউরোপিয়ান উপনিবেশ স্থাপিত হওয়ার পর থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক এসে জড়ো হয় আটলান্টিকের অপর পাড়ে। জনপ্রবাহের সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। তাই ছয়টি টাইম জোনে বিভক্ত এ বিশাল দেশটিকে বলা হয় ইমিগ্র্যান্ট বা অভিবাসীদের দেশ। একটি স্বাধীন ফেডারেশন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা বলে দিচ্ছে, বিশ্বশান্তি অনেকটাই নির্ভর করে এ দেশটির ভূমিকার ওপর। প্রতিষ্ঠাকালীন নেতাদের আদর্শ অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্র পারে মানবজাতির কল্যাণে আরো ইতিবাচক কাজ করতে। সে সামর্থ্য দেশটির রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠাকালীন সে উদ্দেশ্য থেকে দেশটি অনেক দূরে সরে এসেছে। বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করেছে একক আধিপত্য। তারই ছায়া পড়েছে ভারত ও পাকিস্তানসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়। দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে সাম্প্রতিক মার্কিন নীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের চেয়ে ভারতকে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে। একই সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আফগানিস্তানের পাশাপাশি পাকিস্তানকেও তার দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অন্যতম প্রধান হুমকি হিসেবে অভিহিত করেছে। পরমাণু ক্ষেত্রে সহযোগিতার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে চুক্তি করা থেকে বোঝা যায় ওয়াশিংটন সব ক্ষেত্রে নয়াদিল্লিকেই অগ্রাধিকার দেবে। এ কারণে পাকিস্তানও প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের পাশাপাশি তার দেশের সাথেও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য আন্তরিকতার নিদর্শনস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অনুরূপ চুক্তি স্বাক্ষরের দাবি জানিয়েছে। প্রকৃত অর্থে যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তান ও ভারতের এই সুযোগ করে দেয়া দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথকেই সহজ করে দিচ্ছে। এর থেকে শুধু ভারত আর পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ কিংবা মিয়ানমার কারোরই স্বস্তি পাওয়ার কথা নয়।