উপজেলার ১৮টি তাজা প্রাণ। ঘরবাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছিলো অসংখ্য পরিবার। সর্বনাশা সিডর মায়ের বুক খালি করে কেড়ে নিয়েছে তার আদরের ধনকে, স্বামী হারিয়েছে তার স্ত্রীকে, স্ত্রী হারিয়েছে তার স্বামী কিংবা ভাই হারিয়েছে ভাইকে, বোন হারিয়েছে বোনকে। ঘুরে ফিরে তিনটি বছর পর আবার সেই নভেম্বর মাসকে সামনে রেখে গৌরনদীবাসীর মধ্যে ফের অজানা আতংক দেখা দিয়েছে।
সরকারি হিসেব মতে, সিডরে গৌরনদীর বিভিন্ন গ্রামের ঘরের ওপর গাছ চাঁপা পড়ে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছিলো ৯২ জন, সম্পূর্ন ক্ষতিগ্রস্থ লোকসংখ্যা ২৫ হাজার ১৬৭, আংশিক ৬২ হাজার ৫১৮, সম্পূর্ন রুপে বির্ধ্বস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা ৬ হাজার ৭৪ টি, মৃত গাবাদি পশুর সংখ্যা (হাঁস, মুরগী, গরু, ছাগল) প্রায় ১০ হাজার, সম্পূর্ন ফসলাদি বিনষ্টের পরিমান ধরা হয়েছিলো ১ হাজার ২৩৫ একর, বন বিভাগের ক্ষতির পরিমান ৬৫ লক্ষ ২৪ হাজার, ৬৬৫ টাকা, ২০ একরের চিংড়ির ক্ষতির পরিমান ধরা হয়েছিলো ২ লক্ষ ১৬ হাজার ৫’শ টাকা, ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (প্রাইমারি, মাধ্যমিক, কলেজ, রেজিষ্টারি, কমিউনিটি, মাদ্রাসা) ৪৬টি, ক্ষতিগ্রস্থ মসজিদের সংখ্যা ১৩৩টি, মন্দিরের সংখ্যা ৪৩টি, ক্ষতিগ্রস্থ পাকা রাস্তার পরিমান ৩৫ কিলোমিটার, কাঁচা ৩০ কিলোমিটারসহ ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার পরিমান ১৩১ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু বেসরকারি হিসেবে ক্ষতির সংখ্যা ছিলো প্রায় দ্বিগুন।
এ উপজেলার অধিকাংশ পরিবার কোন না কোন এনজিওর সাথে জড়িত। সিডরের পরবর্তী সময় এ উপজেলায় বড় আতংক ছিলো বিভিন্ন এনজিও’র কর্মীরা। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ঘর উত্তোলন, কিংবা ভ্যান রিক্সা ক্রয় আবার কেউবা পানের বরজ করেছিলো। সর্বনাশা সিডরের আঘাতে সব কিছু হারিয়ে ওইসব পরিবারগুলো একদিকে যেমন শোকে মুহমান ঠিক তখনি সিডরের চেয়ে ভয়ংঙ্কর রুপ নিয়ে এনজিও কর্মীরা কিস্তির টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ শুরু করেছিলো। ফলে বির্ধ্বস্ত ঘর বাড়ি মেরামতের কথা চিন্তা না করে এনজিওর কিস্তির টাকা যোগাড় করতে সর্বত্র ছোটা ছুটি করছিলো সিডর আক্রান্তরা।
দক্ষিণাঞ্চলের এ জনপদ বরাবরের ন্যায় সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে সিডরের পরবর্তী সময়েও ছিলো বঞ্চিত। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা সর্বদা দক্ষিণাঞ্চলকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় একটি বারও গৌরনদীতে কেউ আসেননি। সরকারিভাবে গৌরনদীর জন্য নামে মাত্র ত্রাণ সামগ্রী বরাদ্দ করা হলেও প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থদের হাতে ওইসব ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি। বিভিন্ন এনজিও ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরনের কথা ঘোষনা দিলেও প্রকৃতপক্ষে বিতরনকৃত ত্রাণ সামগ্রী এনজিও’র সদস্যদের মাঝেই বিতরন করা হয়েছিরো। ফলে বরাবরই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থরা ত্রাণ সামগ্রী থেকে হয়েছেন বঞ্চিত।
সরকারি সূত্র মতে, গৌরনদীর দূর্গতদের জন্য নগদ ২৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা, ৭১ মে. টন চাল, ৬০ টি তাবু, ২’শ কম্বল, হাফ মে.টন খেজুর, ৩ মে. টন ছোলা, ১৭০ বান্ডিল টিন বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। উপজেলা প্রসাশনের হিসেব অনুযায়ী গৌরনদীতে ক্ষতিগ্রস্থ লোকসংখ্যা নির্ধারন করা হয়েছিলো ৯২ হাজার ৭৩ জন, ঘর বাড়ির সংখ্যা ১৯ হাজার। সরকারি হিসেবে গৌরনদীর ক্ষতিগ্রস্থ ৪৬০ জনের জন্য ১ টি কম্বল, ৩১৬ পরিবারের জন্য ১ টি তাবু, ১১১ পরিবারের জন্য ১ বান্ডিল টিন বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো। আজো অধিকাংশ পরিবার সিডরের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেননি। ওইসব পরিবারের খোঁজ এখন আর কেউ রাখছেন না।- খোকন আহম্মেদ হীরা।