একটি বাড়ি একটি খামারের তালিকায় বিত্তবান লীগ নেতাদের নাম

খামার প্রকল্পে হত দরিদ্রের তালিকায় বিত্তবান ও সম্পদশালী আওয়ামীলীগ নেতাদের অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে। দলীয় নেতা কর্মীদের তালিকাভূক্ত ছাড়াও ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের ক্ষমতাসীন নেতারা স্বজন প্রীতি করে একই ঘরে ভাই বোন আত্মীয় স্বজনের নাম অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সরজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজন ,তালিকাভূক্ত ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর, মাহিলাড়া, বাটাজোর, নলচিড়াসহ চারটি ইউনিয়কে এ প্রকল্পে নির্বাচন করা হয়। প্রতিটি গ্রাম থেকে ৬০ জন করে চারটি ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের এক হাজার দুইশত উপকারভোগী পরিবারকে তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে গৌরনদী উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা জানান। এ প্রকল্পের নীতিমালা অনুযায়ী গ্রামের হতদরিদ্র বিধবা মহিলা, শুধু বসত ভিটা আছে যার, ভূমিহীন হতদরিদ্র ও ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষকরা এ তালিকায় অর্ন্তভূক্ত হবেন। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পভূক্ত গ্রামের লোকজন অভিযোগ করেন, একটি বাড়ি একটি খামার নামেই হত দরিদ্রদের প্রকল্প। দরিদ্রের তালিকায় বৃত্তশালীরা অর্ন্তভূক্ত হয়েছেন। এ তালিকায় রয়েছে আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মী ও সম্পদশালী বৃত্তবানদের নাম। তালিকা তৈরী কাজের সাথে যুক্ত জনৈক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করার শর্তে জানান, তালিকা তৈরী কাজে আমাদের যে নীতিমালা অনুসরন করতে বলা হয়, আমরা সে অনুযায়ী তালিকা প্রণয়ন শুরু করলে আওয়ামীলীগ নেতারা কাজে বাঁধার সৃষ্টি করেন এবং তালিকা তৈরীর কাজ বন্ধ করে দেন। পরে তারা (আওয়ামীলীগ নেতারা) নিজেরাই তালিকা তৈরী করে আমাদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসে জমা দেন। চূড়ান্ততালিকা অনুযায়ী গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া ইউনিয়নে  গিয়ে দেখা যায়, পিংলাকাঠী গ্রামের তালিকার প্রথমার্ধে রয়েছে মৃত তুজামব্বর আলী হাওলাদারের পুত্র মোঃ শাহজাহান কবির। তিনি নলচিড়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ও উন্নয়ন প্রচস্টা নামে প্রতিষ্ঠিত একটি এন.জি.ও’র নির্বাহী পরিচালক। স্থানীয় লোকজন জানান, শুধু তিনিই নন, এ তালিকায় তার (শাহজাহান কবিরের) ভাই হাবিব হাওলাদার, জালাল হাওলাদারসহ আত্মীয় স্বজনের নাম অর্ন্তভূক্ত করেছেন। হত দরিদ্রদের তালিকায় নিজের নাম থাকা প্রসংঙ্গে শাহজাহান কবির বলেন, রাজনৈতিক সামাজিকভাবে আমার অবস্থান আছে কিন্তু আর্থিকভাবে স্বচ্ছল না। তিনি স্বজনপ্রীতি ও বৃত্তবান দলীয় নেতা-কর্মীদের তালিকাভূক্ত করার অভিযোগ অস্বীকার করেন। পিঙ্গলাকাঠী গ্রামের মোঃ ফারুক হোসেন, মোঃ জামাল হোসেনসহ অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে  বলেন, মোগো নেতাই যহন গরীব, তহন তালিকায় মোগো নাম না থাহাই ভাল। নিজেরা আগে খাইয়া পায় না দিশা, তারা আবার মোগো সেবা করার কতা কয়। এ ছাড়াও এ তালিকায় রয়েছেন নলচিড়া ইউনিয়নের আওয়ামীলীগের সহসভাপতি ও নলচিড়া বন্দরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোঃ বাদশা ফকির, নলচিড়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এলাকায় ধর্নাঢ্য ব্যক্তি ও ল্যান্ড লট হিসেবে পরিচিত অভিজিৎ ভট্টচার্য্য, ৯ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি মোঃ কালাম খান, আওয়ামীলীগ নেতা ধর্নাঢ্য ব্যক্তি ইব্রাহিম হাওলাদার, ২ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি গ্রাম্য মাতবর সেলিম মল্লিক, পিঙ্গলাকাঠী বন্দরের ইজারাদার হাসান মল্লিক, নলচিড়া গ্রামের শান্তি রঞ্জন অধিকারী (যিনি একটি পাকা ভবনের বসবাস করেন), নলচিড়া বন্দর বনিক সমিতির সভাপতি ও  আওয়ামীলীগ নেতা মোঃ দুলাল খান। তালিকাভূক্ত নলচিড়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ নেতাদের কাছে তালিকায় নাম থাকা প্রসংঙ্গে জানতে চাইলে তারা বলেন, এ প্রকল্পটি দলীয় নেতা-কর্মীদের স্বাবলম্বী করার জন্য কিন্তু হত দরিদ্রের প্রকল্প কিনা তা জানা নাই। তালিকা অনুযায়ী বাটাজোর ইউনিয়নে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বাটাজোরের চন্দ্রহার গ্রামের নিতাই দাসের পুত্র কালা চাঁদ দাসকে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে উপকারভোগী হিসেবে চূড়ান্ত তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। কালা চাঁদ দাস স্থানীয় আওয়ামীলীগের সহসভাপতি ও একজন সস্পদশালী ব্যাক্তি। লক্ষনকাঠী গ্রামের তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করা হয় কোটিপতি ব্যাবসায়ী ও আওয়ামীলীগ নেতা মোঃ বাদল তালুকদারকে। হত দরিদ্রের তালিকায় অর্ন্তভূক্ত হওয়া প্রসংঙ্গে বাদল তালুকদারকে জিজ্ঞাসা করা হেেল তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। শুধু তাই নয় স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেন, বাদল তালুকদার স্বজনপ্রীতি করে তার চাচা  সামছুল হক তালুকদার, ভাই কালাম তালুকদার, গিয়াস তালুকদারকে তালিকাভূক্ত করেছেন।

এছাড়াও এ তালিকায় রয়েছে কলেজ ছাত্র ও বাটাজোর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক মোঃ রিয়াজ তালুকদার, ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি ও প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী মোঃ মোনায়েম খান, বাটাজোর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহসভাপতি আবুল কালাম মৃধা, কার্যকরী কমিটির সদস্য মানিক বাঘল, ৮নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি ব্যবসায়ী আশ্রাব আলী সিকদার। এ প্রসংঙ্গে বাটাজোর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের নেতা মানিক বাঘলকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, কোন কোন নেতা দলীয় প্রভাব বিস্তার করে বৃত্তশালীদের তালিকাভূক্ত  করেছে  এ কথা সত্য কিন্তু এরসাথে আমি দ্বিমত পোষন করি। মোনায়েম খানসহ তালিকাভূক্ত বাটাজোর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের নেতাদের কাছে এ প্রসংঙ্গে জানতে চাইলে তারা বলেন, এটি ধনী গরীবের কিনা তা জানিনা । আমরা যতদুর জানি তালিকাভূক্ত করে দলীয় নেতা কর্মীদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। মাহিলাড়া ইউনিয়নের মোঃ জাফর হোসেন, করম আলী, আঃ রবসহ অনেকেই অভিযোগ করেন, এ প্রকল্পটি হত দরিদ্রের জন্য, আওয়ামীলীগ নেতারা এ কথাটি ভুলে গিয়ে বৃত্তবান দলীয় নেতা কর্মীদের নিয়ে এ তালিকা চূড়ান্ত করেছেন। এ তালিকায় আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মী ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি ও বৃত্তবান ও সম্পদশালী ব্যক্তিরা রয়েছেন। খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা গৌরনদী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ মিজানুর রহমান অভিযোগ করেন, তিনি তার গ্রামের হত দরিদ্রদের একটি তালিকা সংশ্লিস্ট অফিসে জমা দেন কিন্তু চূড়ান্ত তালিকায় সে নাম অর্ন্তভূক্ত হয়নি। সেখানে এ প্রকল্পের নীতিমালা লংঘন করে বৃত্তবান ধনী শ্রেণীর লোকজনকে অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে। খাঞ্জাপুর গ্রামের ভ্যানচালক তৈয়ব আলী (৪০), দিনমজুর আইয়ুব আলী (৪৫), দেলোয়ার হোসেন (৪২) বলেন, মোগো নাম থাকবে ক্যান, মোরা কি দলের নেতা। হগোল নেতারা মোগো গরীরের নাম কইয়া আইন্না হেরা নিজেরাই আগে নিয়া লয়। অভিযোগের ব্যাপারে গৌরনদী উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা মোঃ কামরুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন , সীমাবদ্ধতা থাকায় এ ব্যাপারে আমার কোন বক্তব্য দেয়া সম্ভব নয়।

এ প্রকল্পের গৌরনদী উপজেলা কমিটির সহসভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেনের কাছে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। সু-নিদৃষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেয়া হবে। এ প্রকল্পে বৃত্তবান দলীয় নেতা-কর্মীদের তালিকাভূক্ত করার অভিযোগ সম্পর্কে গৌরনদী উপজেলা আওয়ামীলীগের আহবায়ক কালিয়া দমন গুহের কাছে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগের সত্যতা স্বীকার বলেন, এ জন্য সংশ্লিস্ট সরকারী কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যানরা দায়ী।