মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন প্রতিবাদী সাংবাদিক মনির

হাতে নির্মমভাবে খুন হলেন বরিশাল মুলাদী উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ী। এ ঘটনায় নামধারী পাঁচ জন এবং অজ্ঞাত আরো ৫/৬ জনকে আসামি করে মুলাদী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। বুধবার দুপুরে নিহতের বড় ভাই জসিমউদ্দিন খোকান রাঢ়ী বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেছেন (যার নং- ২২)। মামলার নামধারী আসামিরা হচ্ছে-অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবল আলাউদ্দিন রাঢ়ী, আলেয়া বেগম, সোহাগ, রাসেল ও মোতালেব রাঢ়ী।

সাংবাদিক মনির হোসেনের মৃত্যুতে পুরো বরিশালে শোকের ছায়া নেমে আসে। বুধবার দুপুরে নিহত মনিরের লাশ নিয়ে বরিশালের সহকর্মী কলমযোদ্ধারা নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার পূর্বক ফাঁসির দাবিতে সমাবেশও করেছেন। অপরদিকে নিহত সাংবাদিক মনিরের নিজ এলাকায় চলছে শোকের মাতম। এ হত্যাকান্ডকে পরিকল্পিত হত্যা বলে মন্তব্য করেছে স্থানীয় অনেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মনির হোসেনের এক আত্মীয় জানান, মনির হোসেন রাঢ়ী ছিলেন খুবই জনপ্রিয় একজন ব্যাক্তি। সাধারন মানুষের কাছে মনির হোসেনের গ্রহনযোগ্য ছিলো অনেক বেশি। মানুষের বিপদে মনির হোসেন সব সময় পাশে থাকতেন। তিনি আরো জানান, কয়েক মাস পূর্বে মুলাদী পৌর এলাকার বেইলি ব্রীজ সংলগ্ন বাংলালিংক টাওয়ারের সম্মুখে যাত্রাগানের আয়োজন করে স্থানীয় আওয়ামীলীগের কতিপয় প্রভাবশালীরা। ওইসময় মনির হোসেন পুলিশের সহায়তায় সেই যাত্রাপালা বন্ধ করে দিয়ে সেখানে দোয়া-মাহফিলের আয়োজন করেছিলেন।

নিহত মনিরের ছোট ভাই ফিরোজ রাঢ়ী জানান, আগামি ১৩ জানুয়ারির পৌর নির্বাচনে ৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন তার ভাই মনির হোসেন। পুরো এলাকা জুড়ে ছিলো তার (মনিরের) জনপ্রিয়তা। আগামি পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচন করে সাধারন মানুষের সেবা করা স্বপ্ন দেখতেন মনির। মুলাদী উপজেলা নির্বাচন অফিসার রাজিব আহমেদ জানান, ৪নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীর সংখ্যা তিনজন। এরা হলেন-মনির হোসেন রাঢ়ী, মোঃ বজলুল হক মোল্লা ও জান্নু হাওলাদার। কাউন্সিলর প্রার্থী মোঃ বজলুল হক মোল্লা বলেন, মনির হোসেন ছিলেন একজন মাটির মানুষ। তার আচার-ব্যবহার ছিলো অতুলনীয়। তারা একসাথে মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। এসময় মনির হোসেন তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চুমু খেয়ে বলেছিলেন আল্লাহ’র ইচ্ছার যদি আমি (বজলু মোল্লা) নির্বাচিত হতে পারি তাহলে মনির আমার পাশে থেকে সকল ধরনের সহায়তা করবেন। মনির হোসেনকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের বিচার দাবি করেছেন কাউন্সিলর প্রার্থী মোঃ বজলু মোল্লা। জনপ্রতিনিধিত্বর পাশাপাশি একজন সত্য সাংবাদিক হিসেবেও তার সুনাম ছিলো মুলাদীসহ বরিশালের সর্বত্র।
স্থানীয় সাংবাদিক কবির খান জানান, পর পর দু’বার মুলাদী প্রেসক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হন মনির হোসেন। সে বরিশাল থেকে প্রকাশিত দৈনিক মতবাদ পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দৈনিক মতবাদের ষ্টাফ রির্পোটার সাইদ মেমন বলেন, মনির হোসেন ছিলেন পেশাদার সাংবাদিক। উপজেলার এমন কোন ঘটনা নেই যা তিনি জানতে না।

এদিকে পুলিশের সহায়তায় হত্যাকারীরা পালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহত মনিরের পরিবারের সদস্যরা। মনিরের ছোট ভাই ফিরোজ রাঢ়ী অভিযোগ করেন, ঘটনাস্থল মুলাদী থানা থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরত্বে। তিনি তার ভাইয়ের ওপর হামলার খবর পেয়ে দৌঁড়ে থানায় যান এবং পুলিশের কাছে সাহায্য চান। এসময় থানার এ.এস.আই গাফ্ফার উল্টো তাকে হাজতে ঢুকিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। এমনকি মঙ্গলবার রাতে তার মা পেয়ারা বেগম মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি বলেও ফিরোজ উল্লেখ করেন। এ ব্যাপারে মুলাদী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আমিরুজ্জামান আমির বলেন, থানার বাইরে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। নিহতের ভাই একটি মামলা দায়ের করেছেন। আসামিদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান চলছে।

আমার জানা মতে, ওসি আমিরুজ্জামান আমির একজন চৌকস পুলিশ অফিসার। এরপূর্বে সে গৌরনদী থানার ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সে সময় তিনি ছিলেন নীতিরসাথে আপোষহীন। ফলশ্রতিতে গৌরনদীবাসী আজো তাকে স্মরনে রেখেছেন।

বরিশালের পুলিশ সুপার দেবদাস ভট্টাচার্য্য বলেন, যত দ্রুত সম্ভব হত্যাকরীদের গ্রেফতার করা হবে। ইতিমধ্যে আসামিদের গ্রেফতারের জন্য সম্ভ্রাব্য সকলস্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। খুব শীঘ্রই আসামিরা গ্রেফতার হবে। এ.এস.আই গাফ্ফারের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। আশংকাজনক অবস্থায় ঢাকা নেয়ার পথে মঙ্গবার দিবাগত রাত সোয়া ১ টায় ফেরীঘাটে সাংবাদিক মনির হোসেন মৃত্যুরকোলে ঢলে পরেন। ভোর রাতে তার লাশ মুলাদীতে পৌছায়। সেখানে সুরতহাল রিপোর্ট শেষে ময়না তদন্তের জন্য বুধবার সকাল সাড়ে ১১ টায় তার লাশ বরিশাল মর্গে আনা হয়। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আকতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। আগামি রবিবারের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেয়া যাবে। তবে এর আগে কোন মন্তব্য করতে রাজি হন নি ডা. আকতারুজ্জামান তালুকদার। এদিকে ময়না তদন্ত শেষে সাংবাদিক মনির হোসেনের মরদেহ বরিশাল প্রেসক্লাবের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রেসক্লাবসহ কর্মরত সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে নিহত সাংবাদিক মনির হোসেনের মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে মনির হোসেনের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে নগরীতে বিক্ষাভ মিছিল করে সাংবাদিকরা। বিকেল ৪ টায় নগরীর সদর রোডস্থ অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে অনুষ্ঠিত হয় মানববন্ধন। এছাড়াও সাংবাদিক মনির হোসেনের মৃত্যুর খবরে বরিশালসহ মুলাদী, গৌরনদী, বাবুগঞ্জ, উজিরপুর, আগৈলঝাড়া, বানারীপাড়া, বাকেরগঞ্জ, মেহেন্দীগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলার কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। পৃথক ভাবে ওইসব উপজেলায় ও বাংলাদেশ গ্রামীণ সাংবাদিক সংগঠন বরিশাল বিভাগীয় কমিটি এবং গৌরনদী ডট কমের উদ্যোগে সাংবাদিক মনির হোসেনের হত্যাকারীদের অনতিবিলম্বে গ্রেফতারপূর্বক ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাদ আসর মুলাদী মাহমুদজান মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে মরহুমের জানাজার নামাজ শেষে পারিবারিক কবরস্থানে সাংবাদিক মনির হোসেনের লাশ দাফন করা হয়। মনির হোসেনের মৃত্যুতে তিনদিনের শোক কর্মসূচি গ্রহন করেছে মুলাদী বন্দর বণিক সমিতি। সমিতির সভাপতি এস.এম মাইনুল ইসলাম জানান, মনির হোসেন ছিলেন বণিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা। তিনদিনের কর্মসূচির মধ্যে বুধবার দুপুরে দু’ঘন্টা সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন। বৃহস্পতিবার শোক র‌্যালী ও উপজেলা প্রশাসনের নিকট হত্যাকরীদের বিচারের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান এবং শুক্রবার মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করা হয়। নিহতের মা পেয়ারা বেগম জানান, পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে মনির হচ্ছেন চতুর্থ। তার স্ত্রী ও চার বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। স্ত্রী হামিদা বেগম ঢাকার বারডেম হাসপাতালের সেবিকা।

উল্লেখ্য, বিরোধপূর্ণ জমিতে দেয়াল নির্মানের প্রতিবাদ করায় মঙ্গলবার বিকেলে মনির হোসেন রাঢ়ীকে লোহার শাবল ও ইট ভাঙ্গা হাতুরি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে আলাউদ্দিন রাঢ়ী, আলেয়া বেগম, সোহাগ রাঢ়ী, রাসেল রাঢ়ী ও মোতালেব রাঢ়ী। হামলার একপর্যায়ে মনির হোসেন জ্ঞান হারিয়ে ফেললে সে অভিনয় করছে বলে তাকে ২য় দফা পেটায় সন্ত্রাসীরা। পরে স্থানীয়রা মনির হোসেনকে উদ্ধার করে প্রথমে মুলাদী ও তাৎক্ষনিক বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে ভর্তি করে। শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হলে চিকিৎসকের পরামর্শে রাত সাড়ে ৯ টার দিকে তাকে এ্যাম্বুলেন্স যোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে নিয়ে রওয়ানা হয়ে মাওয়া ফেরিঘাটে পৌঁছলে তার মৃত্যু হয়। -খোকন আহম্মেদ হীরা, সম্পাদক।