ইরি-বোরো ক্ষেতে নারী শ্রমিকদের কদর

এসব নারী শ্রমিকেরা কৃষি কাজেও রাখছেন সমান অধিকার। দিন দিন এসব উপজেলায় বাড়তে শুরু করেছে নারী শ্রমিকের সংখ্যা। তাদের নিপুন হাতের ছোঁয়ায় সাজানো গোছানো ফসলের ক্ষেতে দেখা দিয়েছে ভিন্ন চিত্র। নারী শ্রমিকের এ অবদান অনুকরন করে অনেকেই এখন কৃষি কাজে তাদের প্রাধান্য দিচ্ছেন। ফলে সবুজ বিপ্লবে এখন নতুন করে সংযোগ হয়েছে নারীদের অবদান। সমাজের সকল প্রকার বাঁধা বিঘ পেড়িয়ে অভাবের সংসারে পুরুষের পাশাপাশি ওইসব নারী শ্রমিকেরা এখন দিনভর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করছেন। অপরের জমিতে কৃষানের কাজ করে পুরুষের পাশাপাশি সংসারের হাল ধরেছেন এসব উপজেলার অসংখ্য নারী শ্রমিকেরা। সমাজের নিয়মনিতী তাদের আর পিছু ফেরাতে পারেননি।

গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের ব্রাক্ষনগাঁও গ্রামের দিনমজুর জীতেন ব্যাপারির স্ত্রী রেখা রানী ব্যাপারি (৩৬) দীর্ঘদিন থেকে অপরের জমিতে দিনমজুরের কাজ করছেন। পুরুষের সমান মজুরিও পাচ্ছেন তিনি। বলেন, একসময় অভাবের সংসারে দিনমজুর স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে মোটামুটি ভালই কাটছিল। নয় বছর পূর্বে পাশ্ববর্তী বাড়ির রহিম সরদারের প্ররোচনায় তার দিনমজুর স্বামী বিদেশ নামের সোনার হরিন ধরার জন্য তাদের একমাত্র সম্বল ৪০ শতক জমি বিক্রি করে ও বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ উত্তোলন করে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। প্রতারক রহিম তাদের সরলতার সুযোগে বিদেশ না পাঠিয়ে নানা অজুহাতে সকল টাকা আত্মসাত করে। আর এ কারনেই আজ অপরের জমিতে কৃষাণের কাজ করতে হচ্ছে রেখা রানীকে। প্রথমতো সমাজের নানা লোকের নানা কটুক্তিতে তার স্বামী কৃষানের কাজে রেখাকে বাঁধা দিলেও এখন তিনি তা মানিয়ে নিয়েছেন। এলাকার লোকজন এখন রেখা রানীকে একনামেই চেনেন। রেখা রানী আরো জানায়, ইরি-বোরো মৌসুমে অপরের জমিতে ধান লাগানো, জমির আগাছা পরিস্কারের কাজ, ধান পাকার পর তা কাটা ও মারাইর কাজ করেন তিনি। বাকি সময় স্বামীর পেশা বাঁশ ও বেঁত দিয়ে তৈরি হস্তশিল্পের কাজ করেন। অপরের জমিতে কৃষাণের কাজের পাশাপাশি সংসারের সকল প্রকার কাজই করছেন রেখা। চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে তিনি ২০ শতক জমিতে ধানের বীজের চারা রোপন করে আয় করছেন আড়াই শত টাকা। ধান ক্ষেতের আগাছা পরিস্কারের কাজে তিনি প্রতিদিন মজুরি পান দেড়’শ টাকা। রেখা রানীর উপার্জিত অর্থ দিয়ে চলে স্বামীর বিদেশ যাওয়ার জন্য ঋন করা বিভিন্ন এনজিও’র কিস্তির টাকা। প্রতি সপ্তাহে আট’শ টাকা করে কিস্তি গুনতে হচ্ছে তাকে। রেখার বড় ছেলে জীবন ব্যাপারি ষষ্ট শ্রেনীর, নিশিতা তৃতীয় ও রিংঙ্কু দ্বিতীয় শ্রেনীর ছাত্রী। কান্নাজড়িত কন্ঠে রেখা রানী বলেন, ছেলে-মেয়েদের লেখা পড়া করিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার বড়ই ইচ্ছা কিন্তু অভাবের সংসারে ভগবান বুঝি মোর মোনের আশা কোন দিনই পুরন করবেনা।

একই গ্রামের দিনমজুর সোহরাব ঘরামীর স্ত্রী রুমা বেগম (৩৩) রেখার সাথে একত্রেই দিনমজুরের কাজ করছেন। তিনি জানান, পান বরজের দিনমজুর স্বামীর অভাবের সংসারে যখন নুন আনতে পান্তা ফুরায় ঠিক তখনই তিনি (রুমা) ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার জন্য দিনমজুর স্বামী আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে এবং বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে রুমার চিকিৎসা করান। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত ঋণের টাকা পরিশোধ করতে যখন রুমার স্বামী হিমশিম খাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় রেখা রানীর পরামর্শে তিনি (রুমা) অপরের জমিতে কৃষানের কাজে নেমে পড়েন। পাঁচ সদস্যর অভাবের সংসারে রুমার বড় মেয়ে দোলন আক্তারকে ষষ্ট শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশুনা করিয়েই তা বন্ধ করে দেয়া হয়। পুত্র নয়ন (১১) ও ছোট মেয়ে হেপীকে (৯) ইচ্ছে থাকা সত্বেও আর্থিক সংকটে তাদের পড়াশুনা করাতে পারছেন না। প্রতি সপ্তাহে এক হাজার টাকা কিস্তি গুনতে হচ্ছে রুমাকে।

রেখা ও রুমা তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে সমাজের মহানুভব সমাজপতি ও সরকারের কাছে জোড় দাবি করেন। রেখা ও রুমার পাশাপাশি ওই গ্রামের মনোয়ারা বেগম, সেলিনা বেগমসহ অনেকেই এখন ইরি-বোরো ক্ষেতে কৃষাণের কাজ করছেন। পাশ্ববর্তী আগৈলঝাড়া উপজেলার ইরি-বোরো ও আলু ক্ষেত্রে দিনমজুরের কাজ করছেন শত শত নারী শ্রমিকেরা।