সংগঠিত হচ্ছে জঙ্গী সংগঠন হিজবুত তাওহীদ

সরকার গঠন করার পর পরই কয়েকটি সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনার মধ্য দিয়ে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে আত্মপ্রকাশ করে উগ্রপন্থি মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠন হিজবুত তাওহীদ। প্রশাসনের কঠোর নজরদারী ও ধরপাকড়ের কারনে দীর্ঘদিন সংগঠনটির কার্যক্রম নিস্কিয় ছিলো। এছাড়াও সরকারি ভাবে এ সংগঠনটির নাম কালো তালিকাভুক্ত করা হলেও পরবর্তীতে আর তা কার্যকর করা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে উগ্রপন্থি জঙ্গী হিজবুত তাওহীদের সহস্রাধীক প্রশিক্ষিত নারী ও পুরুষ সদস্যরা।

সূত্রমতে, ২০০১ সালে জেলার গৌরনদী উপজেলার সাকোকাঠী গ্রামে সর্বহারা কামরুল গ্রুপের সাথে হিজবুত তাওহীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর গৌরনদী থানা পুলিশ হিজবুতের দক্ষিণাঞ্চলের চারজেলার আমীর সোহরাব হোসেন খানকে গ্রেফতার করে। তৎকালীন সময়ে অদৃশ্য কারনে সোহরাব খান অল্পদিনের মধ্যেই জামিনে বের হয়ে পূর্নরায় কার্যক্রম শুরু করে। ২০০২ সালের ১৫ জুন গৌরনদী উপজেলার সরিকল, শাহজিরা, কালিহাতা, ধামসর এলাকায় হিজবুতের ৬ জন ক্যাডারকে ধর্মীয় আপত্তিকর লিফলেট ও উগ্র কথাবার্তা বলায় স্থানীয় জনগণ গণধোলাই দেয়। পরেরদিন হিজবুতের সেকেন্ড ইন কমান্ড আবু বক্কর সিদ্দিককে সর্বহারা কামরুল গ্রুপের ক্যাডাররা হাত-পা বেঁধে বেধড়ক পিটিয়ে জখম করে। এ ঘটনার পর হিজবুত সদস্যরা সর্বহারা জিয়া গ্রুপের একাধিক আঞ্চলিক নেতাকে নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় গোপন বৈঠক করে। সে সময় পুলিশ হিজবুতের আমীর সোহরাব খানসহ অন্যান্য ক্যাডারদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বরিশাল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও ঝালকাঠি জেলায় হিজবুতের কার্যক্রম এলাকার মার্ক করা ম্যাপ, সংগঠনের জেহাদী বই, আপত্তিকর লিফলেট উদ্ধার ও সোহরাব খানসহ হিজবুতের ১২ জন সদস্যকে গ্রেফতার করে। এরপর থেকেই বেড়িয়ে আসতে থাকে তাদের জঙ্গীপনার নানা বিচিত্র কাহিনী।

গ্রেফতারের ৫দিন পর ৪১জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। তৎকালীন সময় মামলার এস.আই মোকলেছুর রহমান দীর্ঘ তদন্ত শেষে আরো ২ জনকে অভিযুক্ত করে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে বরিশাল প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আদালত ২০০৪ সালের ২০ জানুয়ারি আমীর সোহরাব খানসহ ৩৯ জনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন। ২০০৩ সালের ৫ মে সকালে হিজবুত তাওহীদের ১০/১৫ জন সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় বরিশাল ও মাদারীপুরের সীমান্তবর্তী ভুরঘাটা মজিদবাড়ি বাসষ্ট্যান্ডে তাদের সংগঠনের আপত্তিকর হ্যান্ডবেল বিলিসহ প্রচার অভিযান চালাতে যায়। সে সময় স্থানীয়রা তাদের হ্যান্ডবেল গ্রহন না করায় এবং উগ্র মৌলবাদি বক্তব্যের দ্বিমত পোষন করায় হিজবুত তাওহীদের ক্যাডার মোফাজ্জেল হোসেন আকাশ ক্ষিপ্ত হয়ে তার কোমরে লুকানো ধারালো অস্ত্র দিয়ে স্থানীয় মাসুম বেপারী ও কাজী নাজমুলের ওপর হামলা চালিয়ে কুপিয়ে জখম করে। এ ঘটনার জের ধরে স্থানীয়রা হিজবুত সদস্যদের ওপর পাল্টা হামলা চালায়। হিজবুত ক্যাডাররা বাঁশিতে হুইসেল বাজিয়ে সামরিক কায়দায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাদের সহযোগীদের জড়ো করে প্রতিবাদী জনতার ওপর পাল্টা হামলা চালায়। হিজবুত ক্যাডার ও এলাকাবাসির মধ্যে প্রায় দু’ঘন্টাব্যাপী ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের এক পর্যায়ে হিজবুত ক্যাডাররা পিছু হটে। এলাকাবাসি ধাওয়া করে গৌরনদীর খাঞ্জাপুর এলাকা থেকে হিজবুতের দলনেতা সাইফুল ইসলাম, ক্যাডার মোফাজ্জেল হোসেন আকাশ, মুনীর হোসেন, ইসমাইল ও কামাল শরীফকে আটক করে গণধোলাই দেয়। এক পর্যায়ে জনতার গণপিটুনিতে দলনেতা বাবুগঞ্জের আগরপুর গ্রামের সাইফুল ইসলাম নিহত হয়। ওই সংঘর্ষে হিজবুতের দলনেতা সাইফুল নিহত, ৪ সদস্য আহত ও ইউপি সদস্যসহ ১০ জন এলাকাবাসি আহত হয়েছিলো। বিভিন্ন সময় পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর হিজবুত তাওহীদের একাধিক সদস্যরা  জানায়, বাংলাদেশ হচ্ছে অনৈসলামিক দেশ। এখানে যে ইসলাম প্রচলতি রয়েছে সে ইসলাম ইসলাম নয়। তাদের ভাষ্যমতে, জুম্মার নামাজ বা জামায়াতে নামাজ পরার জায়েজ নেই। দেশের প্রচলিত আইন আদালতের বদলে তারা কাজীর বিচারে ও নিজস্ব ইমামতিতে বিশ্বাসী। তাদের এ উগ্র কথাবার্তায় প্রতিবাদ করায় ২০০৩ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে সাকোকাঠী গ্রামের খলিফা বাড়ি জামে মসজিদে আসা তাবলীগ জামাতের ওপর হামলা চালায় হিজবুতের সদস্যরা। সশস্ত্র অবস্থায় হিজবুতের সদস্যরা তাবলীগ জামাতের লোকজনদের ব্যবহারিক জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে যায় এবং তাদের মসজিদ থেকে বের করে দেয়। এ ঘটনায় মসজিদের নিয়মিত নামাজ আদায়কারী মুসুল্লীরা হিজবুত সদস্যদের প্রতিবাদ করায় তারা (হিজবুত সদস্যরা) ক্ষিপ্ত হয়। এক পর্যায়ে একই বছরের ৭ মে রাতে হিজবুত তওহীদের সদস্যরা সাকোকাঠী খলিফা বাড়ির মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়। সে সময় মসজিদে আগুন দেয়ার ঘটনায় মসজিদের ইমাম মাওলানা হেমায়েত হোসেন হিজবুত তাওহীদের সদস্যদের নামে গৌরনদী থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা দায়েরের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও রহস্যজনক কারনে মামলার তেমন কোন অগ্রগতি ঘটেনি।

২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট জেএমবি কর্তৃক দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর গোয়েন্দা সংস্থার রির্পোটের ভিত্তিত্বে একই বছরের ২০ আগস্ট গৌরনদী থানা পুলিশ সাকোকাঠী গ্রামে অভিযান চালিয়ে হিজবুত তাওহীদের জেহাদী বই, লিফলেট ও জঙ্গিদের ব্যবহৃত কাগজপত্রসহ হিজবুতের আমীর সোহরাব হোসেন খানের পুত্র হিজবুত সদস্য শাহীন খান (৩০) ও এমদাদকে (২৭) গ্রেফতার করে। সিরিজ বোমা হামলার পর থেকেই সাকোকাঠী গ্রামকে হিজবুত তাওহীদের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর হিজবুতের দক্ষিণাঞ্চলের ৪ জেলার র্শীর্ষ আমীর সোহরাব হোসেন খানসহ তার পরিবারের ৪ সদস্যকে নিয়ে স্থানীয় মোল্লাবাড়ি জামে মসজিদে বসে মসজিদের ইমাম মাওলানা ক্বারী আঃ আউয়ালের কাছে তওবা পরে দল ত্যাগের ঘোষনা করেন। ওইসময় পুলিশের লোকজনও উপস্থিত ছিলো। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকার সন্দেহে ৪৩ জন হিজবুত তাওহীদের সদস্যদের নামে মামলা দায়ের করা হলেও রহস্যজনক ভাবে সবাই মামলা থেকে অব্যহতি পাওয়ায় হিজবুত সদস্যরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের ৪ জেলার হিজবুত তাওহীদের সর্বপ্রথম আমীর সোহরাব হোসেন খান তওবা করে দলত্যাগের পর তারস্থলে ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করে সাকোকাঠী গ্রামের জামাল শরীফ। পরবর্তীতে বৈঠকের মাধ্যমে একই গ্রামের মৃত আসু মীরের বড়পুত্র মান্নান মীরকে দক্ষিণাঞ্চলের ৬ জেলার শীর্ষ আমীরের দায়িত্ব দেয়া হয়।

এদিকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তায় হিজবুত তাওহীদের সাংগঠনিক কার্যক্রম আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। গোপনে তারা কর্মকান্ড চালিয়ে আসছিল। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৫ ডিসেম্বর দুপুরে বরিশালের আগৈলঝাড়া থানা পুলিশ জেহাদী বই, লিফলেট ও সিডি বিতরনকালে হিযবুত তাওহীদের চার নারী সদস্যকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে-আসমা বেগম (২৮), জেবুন নাহার বেগম (১৯), ফারজানা বেগম (২০) ও বকুল বেগমকে (৪৫)। এসময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমান জেহাদী বই, লিফলেট, সিডি উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের বাড়ি গৌরনদী উপজেলার সাকোকাঠী ও শাহজিরা গ্রামে।

আটককৃতরা জানায়, তারা দীর্ঘদিন যাবৎ দিনাজপুর, গাইবান্ধা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ঝালকাঠী, ভোলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় জেহাদী বই, লিফলেট ও সিডি বিতরন করে আসছে। হিযবুত তাওহীদের প্রতিষ্ঠাতা মোঃ বায়োজিত খাঁন পন্নির লিখিত জেহাদী বই, লিফলেট ও সিডি তারা সাকোকাঠী গ্রামের আনিস খাঁনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে বিলি করছেন। এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার দেবদাস ভট্টাচার্যের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সকল প্রকার নাশকতামূলক কর্মকান্ড প্রতিরোধে পুলিশ প্রসাশন তৎপর রয়েছে।