নতুন বছরে দুই দলে বাড়তে পারে সংঘাত

আওয়ামীলীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বি.এন.পি। এর পরেই অবস্থান সাবেক রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ জাতিয় পার্টি (জাপা)। এছাড়া রয়েছে অনেক রাজনৈতিক দল। বিএনপি পরিচিত চারদলীয় জোটে আর আ’লীগ পরিচিত ছিল ১৪ দলে। কিন্তু ২০০৯ সালের সংসদ নির্বাচনে জাতিয় পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল যোগ দেয় ১৪ দলে। ফলে তারা রূপান্তরিত হয় ২০ দলের সমাহার মহাজোটে। সারাদেশে তারা এখন মহাজোট নামেই পরিচিত। তাদের প্রধান শরিক জাপা। আর জোটের প্রধান শরিক বর্তমানে বিতর্কিত অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অবস্থান নিয়েছিল পাকিস্তানের পক্ষে। সেকারনেই তাদের যুদ্ধাপরাধীর দল বলা হয়। বর্তমানে তাদের প্রধান ৫ নেতা কারাগারে। গ্রেফতারের অপেক্ষায় আরো কয়েক জামায়াত নেতা। সব মিলিয়ে বলা চলে আ.লীগ-বিএনপিই দেশের দুটি সরকার। যারা একবার জেতে আবার হারে। এভাবেই চলছে এরশাদের স্বৈরশাসন বিলুপ্তির পরবর্তী বছরগুলি থেকে বর্তমান পর্যন্ত।

হামলা-মামলা গ্রেফতার এ নিয়ে এগিয়ে চলে ২০১০ সালের বিএনপি। এবছরটি তাদের তেমন কোন কাজে আসেনি। উল্টো হারাতে হয়েছে কয়েক নেতাকে। মামলা হয়েছে কয়েক হাজার। গ্রেফতারও হয়েছে কয়েক হাজার। অবশ্য এ দলটি হরতাল ডেকেছে কয়েকবার। কিন্তু পুলিশ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর মোকাবেলায় তেমন একটা সফল করতে পারেনি। বিশেষ করে দলীয় নেতাকর্মীরা রাস্তায় নামতে পারেনি পুলিশের হামলায়। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ছিল বেশ মারমুখী ভূমিকায়। সেকারনেই কয়েকবার ঘাষণা দিয়েও সরকার পতনের আন্দোলন তেমন একটা জমাতে পারেনি দেশের প্রধান এই বিরোধী দল। উপরন্তু সরকারের কৌশলী পদক্ষেপে দলটির একের পর আন্দোলনের ইস্যু বুমেরাং হয়ে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়তে হয়েছে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে তাদের সমর্থিত প্রার্থী জিতলেও দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে দলীয় মেয়র প্রার্থী বাছাই করতে না পারার ব্যর্থতাটাই প্রকট হয়ে ফুটেছে। তারওপর চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা ও কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর আরো বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। এছাড়া নাটোরের উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবু হত্যা, সিরাজগঞ্জে ট্রেনে কাটা পড়ে অর্ধডজন মানুষের মৃত্যু, উপ নির্বাচনে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদের পরাজয় ইত্যাদি ইস্যুর পালেও ঠিকমতো হাওয়া জোগাতে পারেননি দলটির নেতারা। বিশেষত, শিক্ষানীতি নিয়ে ওলামা-মাশায়েখ পরিষদের ডাকা ২৬ ডিসেম্বরের হরতালে সমর্থন ছিল। কিন্তু সরকারের সাথে সমঝোতায় হরতালের আগ মুহুর্তেই হরতাল প্রত্যাহার করে নেয় ওলামা মাশায়েখরা। ফলে এখানেও নিষ্ফল বিএনপি।

নির্ভরযোগ্য সন্ধানী সুত্রে জানাগেছে, নতুন বছরে দেশে বাড়তে পারে রাজনৈতিক সংঘাত । প্রধান দুই দলই পরস্পর বিরোধী অবস্থানে। দুটি দলই রাজপথে নামার প্রস্ততি নেয়ায় এই আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি দলের লোকদের বেপরোয়া মনোভাব, ঐক্যের পরিবর্তে বিভেদে উসকানি, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিরোধীদের পাত্তা না দেয়া, দেশের স্বার্থ রক্ষায় ‘ব্যর্থতা’, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দলন, সংসদের অকার্যকারিতার মতো রাজনৈতিক ইস্যুর সাথে অর্থনীতিতে স্থ’বিরতা, দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় অপারগতা এবং প্রশাসনিক কাজে গতিহীনতার কারণে দুই বছর পার না হতেই মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তা নামতে শুরু করেছে।

পর্যবেক্ষকদের মূল্যায়ন অনুযায়ী, অতীতাশ্রয়ী, পশ্চাৎপদ ও অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে দুই বছর পার করেছে মহাজোট সরকার। এই দুই বছরের বেশির ভাগ সময়েই সরকারের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল স্পর্শকাতর কয়েকটি বিষয়ের বিচারকাজ শেষ করার দিকে। একই সাথে মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগবর্জিত শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন, বৈরী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত বিষয়ে একাধিক চুত্তিপ্তর উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। সরকার যেসব স্পর্শকাতর বিষয়ে বিচারের ঘোষণা দিয়েছে, এর মধ্যে কয়েকটি এখনো প্রত্রিপ্তয়াধীন। বিডিআর হত্যাকাণ্ড, ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলা মামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র চালান আটকের মামলার মতো বেশ কয়েকটি মামলার বিচারকাজ শেষ অথবা নতুন করে শুরু করার কাজ হাতে নিয়েছে সরকার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গেও তারা সোচ্চার। বিশেষ করে ৭১’র মানবতা বিরোধী যুদ্ধপরাধ মামলায় আটক রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর ৫ হেভিযেত নেতা। এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার করেছে পুলিশ। শুধু তাই নয় আরো কয়েকটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি।

গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সাংবিধানিক বিষয় রয়েছে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। এসব কাজে মনোযোগী ও সর্বশত্তিপ্ত নিয়োগের ফলে দেশের অর্থনীতি এখন অনেকটাই গতিহীন।

জানা গেছে, নতুন বছরের শুরুতেই বিএনপি সারা দেশে সাংগঠনিক সফর শুরু করবে। নতুন কমিটির নেতারা ইতোমধ্যেই তৃণমূল পর্যায়ে যোগাযোগ শুর“ করেছেন। দলের চেয়ারপারসন বিভাগীয় ও গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরগুলোতে সমাবেশ করবেন। সোমবার জাসাসের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে সতর্ক করে বক্তব্য রেখেছেন। তিনি দ্বিতীয়বারের মত প্রকাশ্যে কোনো বড় ধরনের সমাবেশে কড়া বত্তপ্তব্য রাখলেন। সমাবেশে তিনি সরকারের প্রতি পদত্যাগের আহ্বান জানান। এছাড়া তিনি দলের নেতাকর্মীদের আন্দোলন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।

এ দিকে বিএনপি’র এসব প্রস্ততির মুখে আওয়ামী লীগও বসে নেই। তারাও একই ধরনের প্রস্ততি নিচ্ছে। সরকারের দুই বছরের ‘সাফল্য’ তুলে ধরে এ মাসেই তারা প্রচারণা শুরু করবে। এ লক্ষ্যে দলকে গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। নবীন-প্রবীণের সমন্বয় করে তৃণমূল সংগঠনে পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে তারা। ৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। ‘দিন বদলের সনদ’ বাস্তবায়নে এরপরই কঠিনভাবে মনোযোগী হবে তারা। এসব সাংগঠনিক কর্মসূচির পাশাপাশি নেতাকর্র্মীদের মতামত নিয়ে সরকার ও দল পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে মহাজোটের শরিকদের সাথে বৈঠকের পরিকল্পনা নিয়েছে আওয়ামী লীগ। একই সাথে সরকারি-বেসরকারি খাতে দলীয় নেতাকর্মীদের চাকরির সুযোগ-সুবিধার জন্যও বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।

রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, দীর্ঘদিন চলে আসা ঐতিহ্যের বাইরে দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে সরকারি তরফেই জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। গত দুই বছরে সংসদকে কার্যকর এবং সব কাজের কেন্দ্রবিন্দু করতে পারেনি সরকারি দল। বিরোধী দলবিহীন জাতীয় সংসদ বাস্তবে পরিণত হয়েছে একদলীয় সংসদে। কোনো জাতীয় ইস্যুতেই সংসদ ভূমিকা রাখতে পারছে না। গত দুই বছরে বিরোধী দল সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচিতে না গিয়ে সরকারকে এক প্রকার সহযোগিতা দিলেও সরকারি দল এই ইতিবাচক দিকটিকে কাজে লাগাতে পারেনি বরং তাদের মনোভাব্লে ‘এ ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন নেই’ জাতীয় মানসিকতা ফুটে উঠেছে। তাই বিএনপি এখন আর সরকারকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছাড়তে চাইছে না। দল গুছিয়ে নেয়ার পর আন্দোলনে যাওয়ার চাপ বাড়ছে তাদের ওপর। অত্যাচারিত নেতাকর্মীরা ময়দানে নেমেই সরকারের কার্যত্রপ্তমের প্রতিবাদ জানানোর কথা প্রতিনিয়তই জানাচ্ছে।সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে জনমতও রয়েছে। এ অবস্থাকে নতুনভাবে উজ্জীবিত দল বিএনপি কাজে লাগাতে চাইছে। সংশিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি’র সব কর্মসূচির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে সরকারি দল। তারা কোনো কর্মসূচি দিলে সরকারি দলও মাঠে পাস্ফটা কর্মসূচি দেবে। দুই দলের এই মুখোমুখি অবস্থান আগামী দিনের রাজনীতিতে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন।

এ ব্যাপারে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ একান্ত আলাপকালে বলেন, বিদায়ী বছরটি ছিল বিএনপি’র জন্য সংগঠন সাজানো-গোছানোর বছর। অবশ্য এবছরে আন্দোলও ছিল। তবে ২০১১ সাল হবে কঠিন আন্দোলন-সংগ্রামের বছর। আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে জনগণের আকাড়ক্ষার প্রতিফলন থাকবে। পাশাপাশি জাতীয় স্বার্থ রক্ষায়ও বিএনপি কোনো আপস করবে না।

স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য জানান, বিএনপিকে সরকারই বারবার আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিচেছ। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমাদের। তাই রাজপথে থাকা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ দেখছি না। তাছাড়া সম্প্রতি বেগম খালেদা জিয়া ৬ দিনের সফরে চীনে যাওয়ার সময় বিমান বন্দরে দলের ভিআপি নেতাকর্মীদের ভিতরে ঢুকতে দেয়নি। এর পরে ফেরার দিন বিমান বন্দরের ঢোকার জন্য সংসদের স্পীকার অনুমতি দিয়ে লিখিতপত্র দিলেও বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষ সরকারের নির্দেশে তাদের ঢুকতে দেয়নি। যেসব বিষয় প্রতিহিংসা পরায়ণ যার বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির এই নেতা।

এদিকে সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, আমরা বিএনপি’র আন্দোলনের হুমকিতে ভয় পাই না। দলের প্রেসিডিয়ামের একজন সদস্য একটি টিভি চ্যানেলের সাথে সাক্ষাৎকারেও বিএনপি’র আন্দোলনের কর্মসূচি প্রসঙ্গে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করেন। দলের কয়েক নেতা বিএনপিকে যুদ্ধাপরাধীর দলে বলে আখ্যায়িত করছেন। যেটা কখোনোই বলা উচিত হয়নি বলে মনে করেন অনেক নেতা।

এ দিকে কূটনৈতিক সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই বিশ্বের এক নম্বর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক চ্যানেলে সরকারের কাছে এই বার্তা পৌঁছানো হয়েছে যে, যেসব বিষয় অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত নয় বর্তমান সরকার সেসব বিষয় প্রাধান্য দিচ্ছে। কৌশলগত অনেক বিষয়ে বাংলাদেশ তার বিঘোষিত নীতি থেকে সরে এসেছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে।