বরিশালে ওদের সন্ধান এখনো মিলেনি!

ব্যক্তির হদিস এখনো মেলেনি। র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে হত্যা শেষে লাশও গুম করে ফেলা হয়েছে বলেও গুঞ্জন উঠেছে। এ অপহরনকারীদের পরিচয় কি ! তারা কি আসলেই র‌্যাব? নাকি নাম ভাঙ্গিয়ে মূর্তিমান আতংকরূপে আর্ভিভাব হচ্ছে অন্ধকার জগতের কোন মাফিয়া চক্র! বিভিন্ন মহলে নানামুখী প্রশ্ন আলোচনায় আলোচিত হচ্ছে। বরিশালে সর্বপ্রথম র‌্যাব পরিচয়ে অপহরনের স্বীকার  জেলা ছাত্রলীগ নেতা শফিকুল্লাহ মোনায়েম। সর্বশেষ অপহৃত হয় হারতা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির খান ও বিএনপি নেতা আবুল হায়দার। এখনো নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না তারা জীবিত না মৃত্যু ! কান্না থামছে না ওইসব পরিবারের স্বজনদের। বিশেষ করে হায়দার অপহরনের পর বন্ধু-বান্ধবরাও হয়রানীর শিকার হচ্ছে বলেও কথা উঠেছে। আতংক তাড়া করে ফিরছে তাদের মাঝে। ইতোমধ্যে কেউ কেউ নিরাপদে আশ্রয়ও নিয়েছে।

নগরীর করিম কুটির এলাকার আবদুর রশিদের পুত্র আবুল হায়দার। সে নগরীর ২১ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। করিম কুটিরের সামনে তার একটি ফার্মেসী রয়েছে। সেখানে মাঝে মাঝে বসতেন হায়দার। এছাড়া একটি ওষুধ কোম্পানীতেও চাকুরী করতেন তিনি। ওষুধ কোম্পানীর অফিশিয়াল কাজের জন্য গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর হায়দার তার কলিক কবির হোসেনকে নিয়ে লঞ্চ যোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ওই দিন সকালে  লঞ্চ থেকে নেমে মহাখালীর জাকারিয়া হোটেলে  থাকার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। হায়দার নিচে দাড়িয়ে থেকে হোটেলের দ্বিতীয় তলায় কেবিন বুকিং করতে পাঠান তার কলিককে । এমন সময় কালো গাড়ি থেকে কয়েক  ব্যাক্তি র‌্যাবের পরিচয় দিয়ে গাড়িতে তুলে নেয় হায়দারকে। এরপর থেকেই হায়দারের সন্ধান মিলছে না। এ ঘটনায় গুলশান থানায় একটি সাধারন ডায়রীও করা হয়েছে।হায়দারের ভাই হারুন অর রশীদ বাদী হয়ে সাধারন ডায়রী করেন। ডায়রীতে  সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জিয়াউর রহমান বিপ্ল¬বকে আসামী করা হয়। তৎসময়ে হায়দারের স্ত্রী রোমানা হায়দার  বিলাপ করে বলেছিলেন হায়দারের সঙ্গে বৈদ্ধপাড়ার বিপ্ল¬বের জমি সংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে। এ কারনে অপহরনের ঘটনার সঙ্গে তাদের পরিবারকে সন্দেহ করছি। প্রতিপক্ষরা আমাদেরকে অনেক আগ থেকেই একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করে আসছিল। অপহরনের মাস খানেক আগে বরিশাল আদালতের অভ্যন্তরে বসে বিপ্লব আমার স্বামীকে র‌্যাব দিয়ে মেরে ফেলার হুমকী দিয়েছিল।তিনি বলেছিলেন বিপ্ল¬বের বড় ভাই র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হওয়ার পেক্ষিতেই এমনটি বলেছে বিপ্লব।

এ প্রসঙ্গে জিয়াউর রহমানের বক্তব্য ছিল হায়দারের পরিবার নয়; তার এক নিকটাতীয়ের সঙ্গে আমার জমি সংক্রান্ত মামলা চলছে।তিনি বলেন আমি বরিশালে অবস্থান করছি। তাকে অপহরনের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তাছাড়া আমাদের পরিবার ওরকম মনোভাবেরও নয়। তিনি তাকে কখনো হত্যার হুমকী দেননি বলে মন্তব্য করেন। হায়দারের  চাচা বদিউজ্জামান টলনের বক্তব্য ছিল জমি সংক্রান্ত বিরোধ কেন্দ্র করেই কৌশলী পদক্ষেপে হায়দারকে র‌্যাব পরিচয়ে অপহরন করা হয়েছে। এর বাইরে হায়দারকে অপহরনের অন্য কোন কারন খুঁজে পাওয়া যায় নি। কোন রাজনীতির সঙ্গে সম্পূক্ত নয়।সে চাকুরী ও ব্যাবসা করে সাদাসিদাভাবে জীবন যাপন করে আসছিল। তার ব্যাক্তিগত কোন শত্র“ নেই। তবে জমি সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে হায়দারকে তুলে নিয়েছে তা অনেকটাই নিশ্চিত। বরিশাল মহানগর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাড.মহসিন মন্টু’র বক্তব্য রাজনৈতিক ও ব্যাক্তিগতভাবে বিএনপি নেতা আবুল হায়দার স্বচ্ছতার সঙ্গে জীবন যাপন করে আসছে। তার বিরুদ্ধে কোন মামলাও নেই। অপহরনের ঘটনাটি রহস্যজনক। জমি সংক্রান্ত বিরোধেই হায়দার অপহরন হতে পারে। কিন্তু মিডিয়ায় এরকম বক্তব্য প্রকাশের পর থেকে অদৃশ্য কারনে নিশ্চুপ থাকেন হায়দারের স্বজনরা। হায়দারের তারা কোন সন্ধান পাননি। এরবাইরে তারা মিডিয়ায় কোন কিছু বলতে অপরগতা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে হায়দারের স্বজনদের মাঝে আতংক জুরে বসে। ওই আতংকের কারনেই তারা মুখ খুলতে পারছে না। কি এমন ভয়ঙ্কর আতংক হতে পারে। দিশোহারা পরিবারটি হায়দারকে উদ্ধারে র‌্যাবের ঢাকা হেড কোয়ার্টারসে অভিযোগ দেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে এখানকার একটি সংস্থা তদন্তের দায়িত্ব পান। তদন্ত কার্যক্রমও চলছে।

তদন্ত শুরুর হওয়ার পর পরই হায়দারের বেশ কয়েক জন বন্ধু বান্ধবদের  দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে অদৃশ্য এক শক্তি। এমনকি তাদের টর্চার সেলে নিয়ে অমানষিক নির্যাতন করারও খবর পাওয়া গেছে। এহেন ভয়ঙ্কর শক্তির নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে কেউ কেউ অন্যত্র পালিয়েও বেড়াচ্ছেন। একইভাবে উজিরপুর উপজেলার হারতা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন খানকে গত ২৩ নভেম্বর র‌্যাব পরিচয়ে রাজধানী ঢাকার মালিবাগ থেকে অপহরন করে নিয়ে যায়। তাকে আটকের খবর স্বীকার করেনি কেউ। উদ্বেগ উৎকন্ঠায় স্বজনরা চোখের জ্বলে ভাসছে। একটি সূত্র বলছে অপহ্নত হুমায়ুন খান জীবত রয়েছেন। পরিবারের সবোর্চ্চ তদবীরের কারনে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। তবে কবে তিনি মুক্তি পাবেন তার কোন নিশ্চয়তা নেই। মুক্তির আশায় অপেক্ষার প্রহর পার করছেন স্বজনরা। নিখোঁজের পাশাপাশি অপহরণের পর লাশ হয়ে ফেরার ঘটনাও একেবারে কম নয়। উঠিয়ে নেয়া এসব মানুষের মধ্যে কেউ কেউ পরে ফিরলেও রহস্যজনক কারণে তাদের মুখও রয়েছে বন্ধ।

গত বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে উজিরপুর থেকে নিখোঁজ হয় সাবেক সর্বহারা নেতা সন্ত্রাসী কানা বাদল। কয়েক দিন পর মাদারীপুর থেকে উদ্ধার হয় তার গুলিবিদ্ধ লাশ। অনুরূপ ঢাকার দৈনিক বাংলা এলাকা থেকে সাদা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নেয়া হয় বাবুগঞ্জের বিএনপি নেতা গোলাম মোস্তফা নান্নাকে। ৩ দিন পর গ্রামের বাড়ির কাছে তার লাশ পায় পরিবার। এ দু’টি অপহরনের বিষয়ে র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল সংশ্লিষ্টদের পরিবার। কিন্তু তা পুরোপুরি অস্বীকার করে র‌্যাব। গত বছরের ১৯ মার্চ পাথরঘাটার চরদোয়ানি বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয় তালুকেরচর গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী আবুল কালাম। টানা ১ মাস ৩ দিন নিখোঁজ থাকে সে। বেশ কিছু দিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে নিখোঁজের পরিবার। র‌্যাব সদস্যরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ  করা হয়। র‌্যাব পরিচয়ে গত বছরের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী এলাকা থেকে নিখোঁজ হয় সাগর জেলে শাহ আলম। তার কোন সন্ধান মেলেনি। অনুরূপ নিখোঁজ রয়েছে পাথরঘাটার পদ্মা  গ্রামের  জেলে কবির হোসেন। গত বছরের জুন’র মাঝামাঝি সময়ে তুলে নেয়া হয় তাকে। কবিরের বাবা আব্দুল হালিম জানান, ‘আমার ছেলে এবং বেলাল নাজির নামে এক ট্রলার মালিককে উঠিয়ে নেয় তারা। কিছু দিন পর ফিরে আসে বেলাল নাজির। ঝালকাঠির রাজাপুরের সাতারিয়া এলাকার মিজানুর রহমান নামের এক ব্যাক্তি কে গত বছরে ঢাকার বাড্ডা এলাকা  থেকে র‌্যাব পরিচয় দিয়ে গাড়িতে তুলে নেয়। অপহরনের বেশ কিছু দিন পর তুরাগ নদী সংলগ্ন বালুর মাঠ থেকে মিজানের বস্তা বন্দী লাশ উদ্ধার করা হয়।

২০০৭ সালের ১ ডিসেম্বর র‌্যাব পরিচয়ে বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক শফিকুল্লাহ মোনায়েমকে কাউনিয়ার বাসভবন থেকে তুলে নেয়। সেই থেকে তার আর কোন সন্ধান মিলে নি। গত ৩ বছরেও তার সন্ধান মেলেনি। পরবর্তীতে আইনের আশ্রয় নেয় মোনায়েমের পরিবার। আবেদন করা হয় মানবাধিকার কমিশনে। প্রায় দু’বছর ধরে চলে চিঠি চালাচালি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় সব। হদিস নেই মোনায়েমের। অনেকেই মনে করছেন মোনায়েম জীবত নেই। বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘একের পর এক নিখোঁজ এবং গুপ্ত হত্যার ঘটনায় শঙ্কিত হয়ে পড়ছে মানুষ। সবচেয়ে বেশী সঙ্কটে পড়ছে নিখোঁজদের পরিবার। লাশ পাওয়া গেলে অন্ততঃ শান্তনাটুকু থাকতো। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের ভাগ্যে তাও জুটছেনা।