খুচরা টাকার বিড়ম্বনা

চায়ের স্টলে চা ও বিস্কুট খেয়ে যখন দোকানদারকে ২০ টাকা দিলেন দোকানদার তাকে খুচরো ৮ টাকা ফেরত দেয়ার সময় হাতে ধরিয়ে দিলেন একটি পাঁচ টাকার নোট, একটি দুই টাকার কয়েন ও একটি চকোলেট।

সব মিলিয়ে রত্না ফেরত পেলেন আট টাকা। এক টাকার বদলে চকোলেট দেয়ার কারণ জানতে চাইলে দোকানদারের সরল উত্তর আপা এক টাকা খুচরা নাই। রত্না জানালেন, এই যে উনি আমার কাছে এক টাকা রেখে দিলেন, আমি যখন অন্য কোনোখানে এক টাকা কম দেবো তখন সে ব্যক্তি এটা নেবেন না। এমনকি এ দোকানদারকেই যদি পরে আমি এক টাকা কম দেই উনি নেবেন না। তাহলে তো আমার এক টাকা জোর করে নিয়ে নেয়া হচ্ছে। এটা কি অন্যায় নয়!

মাহমুদ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। প্রতিদিন তিনি লোকাল বাসে চড়ে বাংলামোটর থেকে শাহবাগ যান। বাসে উঠে কন্ডাক্টরকে দুই টাকা দিলে তিনি তা রেখে দেন। কোনোদিন এক টাকা দিলে আর দুই টাকা চান না। এর কারণ জানতে চাইলে বাসের কন্ডাক্টর বলেন, ভাই ভাড়া তো এক টাকা, কিন্তু খুচরা থাকে না। কী করবো কন! এক টাকা ছাড়তে তো আপনা গো কোনো ক্ষতি নাই। মাহমুদ বলেন, এভাবে প্রতিদিন এক টাকা করে দিতে গেলে মাসের মোটা অংকের একটা টাকা অকারণ খরচ হয়ে যায়। এর সঙ্গে মাসিক ব্যয় মেলানো কঠিন হয়। নাসরিন বেগম প্রতিদিন আজিমপুর থেকে ফাল্গুন গাড়িতে চড়ে কাকরাইলে যান। তার ভাড়া দিতে হয় ১২ টাকা। তিনি কাউন্টারে গিয়ে ১০ টাকা ও ২ টাকার নোট দিলে কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু যদি তিনি কোনোদিন একটি ১০ টাকার নোট এবং একটি ৫ টাকার দেন বা ২০ টাকার নোট দেন তাহলেই বাধে বিপত্তি। কাউন্টারের ছেলেটি তখন ফেরত দেয়ার সময় অনায়াসে এক টাকা কম দেয়। টাকা চাইলে বলে, জানেন তো খুচরা দিতে হবে। খুচরা টাকা নিয়ে আসেন না কেন? নাসরিন বলেন, এভাবে প্রতিদিন হাতে খুচরা টাকা থাকে না। ওদেরও জানা আছে যে কাউন্টারে খুচরা টাকা লাগে ওরা কিছু এক টাকা বা দুই টাকার কয়েন রাখলেই তো পারে!

রত্না, মাহমুদ, নাসরিনদের এ সমস্যা শুধু তাদের একার সমস্যা নয়। এ সমস্যা এখন সারা দেশে বিরাজ করছে। টাকা ভাঙানো এবং খুচরো টাকা হাতে পাওয়া এটি সাধারণ মানুষের কাছে এক ভয়াবহ যন্ত্রণা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

বর্তমানে দেশে এক, দুই ও পাঁচ টাকার কয়েন এবং এক, দুই, পাঁচ, দশ, বিশ, পঞ্চাশ, একশ, পাঁচশ ও এক হাজার টাকার নোট রয়েছে। আজিমপুর এলাকার গৃহিণী শাহনাজ বিশ্বাস জানালেন, আমার স্বামী আগে ব্যাংক থেকে বেতন তুলে পাঁচশ টাকার নোট দিতো। সেই নোট খুচরা করতে অনেক কষ্ট হতো। আর এখন সে বেতন তুলে আনে ১ হাজার টাকার নোট। এ নোট ভাঙানোর জন্য আমার নিয়মিত বাজারের সিস্টেম বদলাতে হয়েছে। দোকানে গিয়ে বেশ কিছু টাকার বাজার না করলে সেই নোট ভাঙানো সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, এমনিতেই দেশের মানুষের জিনিসপত্রের দাম নিয়ে কষ্ট। তার ওপর সরকারের এমন আচরণ কাম্য নয়। এখন সরকারের উচিত ছোট নোটের সংখ্যা বাড়ানো।

খুচরা এক টাকা কম দেয়ার কারণে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে এক যাত্রীকে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। প্রতিদিনই ঢাকা শহরের রাস্তায় দেখা যায়, রিকশাওয়ালার সঙ্গে, গাড়ির কন্ডাক্টরের সঙ্গে, দোকানদারের সঙ্গে টাকা ভাঙানো নিয়ে কথা কাটাকাটি, মারামারি হচ্ছে কিন্তু যাদের এ বিষয়ে নজর দেয়ার কথা তারা তা দেখার সময় পাচ্ছেন কি?

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাশউদ্দিন বলেন, খুচরো টাকা নিয়ে সমস্যা বিশেষ সময়ে একটু বেশি হয়। মানুষ খুচরা টাকা বেশি ব্যবহার করে। এ সমস্যা নতুন না। তিনি বলেন, সরকার খুচরা অনেক কয়েনের অর্ডার দিয়েছে। কয়েন বাজারে আসলে আর এ সমস্যা থাকবে না। একটা সময় ছিল যখন ধাতুর কারণে কয়েনগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছিল তখন এ সমস্যা সৃষ্টি হয়। বাজারে খুচরা টাকার সংকটের কারণে এক টাকার বদলে চকোলেট দেয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, এখানে সংকটটি বড় কারণ নয়। মানসিকতাই আসল। তিনি বলেন, এই যে এক টাকার বদলে একটি চকোলেট ধরিয়ে দেয়া চাঁদাবাজির একটি ছোট সংস্করণ।

Published on: http://www.bhorerkagoj.net/content/2011/01/24/news0641.php