‘টাকায় ধান আনে’

রুপান্তর করেছেন বিত্তবানরা। অবহেলার ষোলকলা পূর্ণ করা বোরো চাষীরা চাষ কাজের ব্যয় যোগাতে ব্যাংক থেকে ঋণ না পেয়ে উৎপাদন শেষে ধান দেয়ার শর্তে সমাজের বিত্তবানদের পেঁতে রাখা ফাঁদে নিরুপায় হয়ে পাঁ দিতে বাধ্য হচ্ছে। সরকার স্বল্প সুদে বোরো উৎপাদনে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করেছে তা প্রত্যন্তাঞ্চলের অনেক কৃষক জানেনই না। প্রচারণা না থাকায় তা সমাজের শেকড় পর্যায়ে পৌঁছায় না। যাঁরাও ব্যাংক ঋণের কথা জানেন তারাও আইনী জটিলতার কারনে ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে সহজে সুদের ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। বিনিময়ে ধান উৎপাদনের শেষে প্রতি হাজারে এক মন করে ধান দিতে বাধ্য থাকেন। মাত্র ৩থেকে ৪মাস টাকা রাখার বিনিময়ে বোরো চাষীদের এই ধান দিতে হয়।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার পৌর এলাকাসহ ১৪টি ইউনিয়নে বোরো উৎপাদন লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩হাজার ১শ’ ৩৫হেক্টর। এ প্রর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৯হাজার হেক্টরে আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। সাহেবরামপুর, কয়ারিয়া ও ডাসার এলাকায় এখন আবাদ চলছে পুরোদমে।

কৃষি অফিসের জরিপ মতে, কালকিনি উপজেলায় প্রায় ৪০হাজার বোরো চাষী রয়েছে। যার ৭থেকে ১০হাজার কৃষক ব্যাংকের নিকট থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন। বাকীরা নিজ ও অন্যের নিকট থেকে ধার এনে চাষাবাদ ব্যয় মিটিয়ে থাকেন।

পৌর এলাকার বোরো চাষী রশিদ বেপারী জানান, ‘ধানের দাম বাড়ার সাথে সাথে উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। ব্যাংক ঋণের টাকা দিয়ে সব কাজ শেষ করা যায় না। বাধ্য হয়েই ২০হাজার টাকা একজনের কাছ থেকে ধার এনেছি। বিনিময়ে তাকে ২০মন ধান বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে’। বর্গাচাষী কালু সরদার বলেন, ‘মোর তো জমির কাগজ-পাতি নাই। অর্ধেক ভাগে আরেকজনের ২০শতাংশ জমিতে বোরো ধান লাগাইছি। এহনো জমিতে অনেক কাজ বাকী রইছে, টাকার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি’। বাঁশগাড়ি এলাকার বোরো চাষী রহিম হাওলাদার বলেন, ‘ধান উৎপাদনের জন্য টাকা নিলে ওদের (দাদন ব্যবসায়ীদের) ধানই দিতে হবে, সুদের টাকা দিলে নেয় না’।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে পৌর এলাকার শিকারমঙ্গল গ্রামের এক ইটালী প্রবাসীর স্ত্রী বলেন, ‘টাকা তো এমনেও ব্যাংকে পড়ে থাকে। টাকা দিয়ে যদি ধান পাওয়া যায় তাহলে তা হাত ছাড়া কেউ করে না। ধান উৎপাদনের উপর এ বছর সাড়ে ৩লক্ষ টাকা লাগাইছি। ধান পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু অনেক সময় টাকা উঠাতেও ঘাম ঝড়ে যায়’। আরেক দাদন ব্যবসায়ী বলেন, ‘এলাকার সবাই তো ধানের উপর টাকা লাগায় (বোরো চাষীদের দাদন দেয়া) এতে আমার দোষ কি? বোরো চাষীদের টাকা দিলে তারাও ভালোভাবে ধান উৎপাদন করতে পারে আর আমরাও বিনিময়ে ধান পাই, এতে সবারই উপকার হয়’।

একাধিক বোরো চাষী এ প্রতিবেদককে জানান, ‘সমাজে এমনও টাকাওয়ালা লোক আছে যাঁদের কোনো ধানী জমি নেই কিন্তু প্রত্যেক বছর বোরো ধান উৎপাদনে বোরো চাষীদের কাছে দাদন দিয়ে ২শ’ থেকে আড়াই শ’ মন ধান ঘরে তুলে থাকে। এসব লোকদের টাকা বা ধান আনতেও যাওয়া লাগে না, পরের বছর আবার টাকা ধার নেয়ার আশায় বোরো চাষীরা বাড়িতেই দিয়ে যায়’।

উপজেলার প্রত্যন্তাঞ্চলের গ্রামগুলোতে ঘুরে বোরো চাষীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, বোরো উৎপাদনে সরকার ব্যাংকের মাধ্যমে অত্যন্ত স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে তা অনেকে জানেনই না। কৃষি বিভাগ কৃর্তৃক ব্যাংক ঋণের কথা স্বল্প সংখ্যক কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় বলা হলেও পরে আর কোনো প্রচারণা চালায় না কেউ। ফলে গ্রামাঞ্চলের প্রকৃত বোরো চাষীরা বঞ্চিত হয় ব্যাংক ঋণ থেকে। আর জড়িয়ে পড়ে বিত্তবানদের দাদন ব্যবসার পেতে রাখা ফাঁদে।