নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল নিয়ন্ত্রন নিতে মরিয়া ফাঁসি কামাল

ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক কামাল হোসেন সরদার ওরফে ফাঁসি কামাল। ইতোমধ্যে তিনি ও তার সহযোগীরা  জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আফতাব হোসেনের অনুপস্থিতির সুযোগে টার্মিনালে ধুমধাম করে ভুড়ি ভোজের আয়োজনও করেছে। অনেকটা যুদ্ধাংদেহী অবস্থায় রয়েছেন বিসিসি মেয়র শওকত হোসেন হিরন সমর্থিত কামালের সহযোগীরা। আশংকা করা হচ্ছে টার্মিনালের দখলের ঘটনায় যে কোন সময় বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী সংর্ঘষের।

এর আগে ১ ফেব্র“য়ারী দুপুরে নির্বার্হী ম্যাজিষ্টেট কামরুজ্জামান এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী পরিচালক জহিরুল ইসলাম নথুল্ল­াবাদ বাস টার্মিনালে ফিটনেসবিহীন ও অবৈধ যানবাহন আটকিয়ে জরিমানা আদায় করতে ছিল। ওই সময়ে জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক শাহ আলম জরিমানা কম করার জন্য অনুরোধ করে। এতে তেলে বেগুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ভ্রাম্যমান আদালত। এরপরই পুলিশ শ্রমিক নেতা শাহ আলমকে বেদম মারধর করে। এ ঘটনায় শ্রমিক-পুলিশ সংর্ঘষে জড়িয়ে পড়ে। বেশ কয়েকবার উভয় গ্র“প ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও ইট পাটকেল নিক্ষেপ করেছে। এতে সংঘর্ষ চলাকালে ৩ পুলিশ সদস্যসহ, সাংবাদিক, শ্রমিক আহত অর্ধশত। আহতদের বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গুরুতর আহত পুলিশ সদস্য রফিকুজ্জামান টুকু (৩০), মিজানুর রহমান ও নান্নু মিয়াকে আশংকাজনক অবস্থায় হেলিকপ্টার যোগে ঢাকায় প্রেরন করা হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা সকলেই শ্রমিক এবং সংর্ঘষে আহত হয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো ওয়াসিম মালী, রানা আকন, মোঃ সাদেক আলী, গোবিন্দ কর্মকার, মনির শিকদার, পরিমল হাজরা, হযরত আলী, আতিকুর রহমান, মিরাজ। নথুল্ল­াবাদ বাসটার্মিনালে শ্রমিক-পুলিশের রক্তক্ষয়ী সংর্ঘষের পরই কথা উঠে পুলিশের ওপর হামলা চালাতে জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আফতাব হোসেন প্রকাশ্য ইন্ধন দিয়েছেন। তিনি শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তোলায় এরকম রক্তক্ষয়ী সংর্ঘষ ঘটেছে। সংর্ঘষের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি দ্রুত বিচার আইন ও অপরটি পুলিশ আক্রান্ত আইনে মামলা দায়ের করা হয়। মামলা দুটিতে শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সাধারন সম্পাদকসহ ৫’শ জনকে আসামী করা হয়েছে। ওই দিন বিকেল থেকেই মেয়র হিরন সমর্থকরা টার্মিনাল এলাকায় অবস্থান নিয়ে আফতাব বিরোধী মিছিল সমাবেশ করে আসছে। তারা আফতাব মুক্ত টার্মিনালের দাবী তোলেন।

শ্রমিক নেতা কামাল হোসেন সরদার বলেন, নথুল্লাবাদের শ্রমিকরা তাকে নেতৃত্বের ভার নেয়ার জন্য অনুরোধ করে আসছে। এজন্য তিনি সেখানকার শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব নিতে আগ্রহী বলে মন্তব্য করেন।

শ্রমিক নেতা আফতাব হোসেন বলেন, মেয়র শওকত হোসেন হিরনই নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালের পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তুলেছেন। তিনি বলেন অবৈধ পন্থায় মেয়র হিরন টার্মিনাল দখলে নেয়ার চেষ্টা করছেন। তবে তার এ কল্পনা কখনোই বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না। শ্রমিক নেতা আফতাব বলেন তিনি আ’লীগের মধ্যে গ্র“পিং রাজনীতির সৃষ্টি করে সংগঠনকে বিতর্কিত করে চলছেন।

এদিকে শ্রমিকলীগ আফতাব হোসেনের কাছে অনেকটা জিম্মীদশায় নগরীর সাড়ে ৪ লাখ মানুষ। ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও তাকে নিয়ে বিব্রত। কথায় কথায় বাস বন্ধ, পরিবহন ধর্মঘটের হুমকি, জনপরিবহনে বাধা, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত, এমনকি হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগেও নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তিনি। তার আচরণে তটস্থ সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন। শ্রমিক ইউনিয়নের অভ্যন্তরেও রয়েছে তীব্র ক্ষোভ। জোর করে সভাপতির পদ দখল ছাড়াও ইউনিয়নের কয়েক কোটি টাকার তহবিল লোপাটের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নগরীর কাশিপুর ইউনিয়নে আফতাবের বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই তিনি উগ্র স্বভাবের। তার বেশির ভাগ সময় কাটত নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে। আশির দশকের শেষ দিকে তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পূক্ত হন। নির্বাচিত হন কাশিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। এরপর থেকে ক্রমেই হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। নব্বই দশকের শুরুর দিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস এবং তৎকালীন শ্রমিক নেতা বর্তমান এমপি মজিবর রহমান সরোয়ারের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। তৎকালীন সময়ে বিশ্বাস পরিবারের পক্ষ নেন আফতাব। সেই সঙ্গে শুরু হয় সরোয়ার-আফতাব দ্বন্দ্ব। বাস টার্মিনালের দখল নিয়ে মুখোমুখি হন দু’জন। ’৯৬তে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও বিরোধ অব্যাহত থাকে। সরোয়ারকে দমাতে ব্যাবহার করা হয় আফতাবকে । বিএনপিতে রেখেই তাকে দিয়ে চলতে থাকে বিএনপি দমন। নেতার সহযোগিতায় দখল হয় টার্মিনাল। ১৯৯২ সালে আফতাবের বিরুদ্ধে ওঠে চাঞ্চল্যকর সবুজ হত্যার অভিযোগ। মামলার এজাহারেও নাম ছিল তার। পরে অবশ্য প্রভাব খাটিয়ে রেহাই পেয়ে যান তিনি। মামলার খবর প্রকাশ করায় স্থানীয় এক পত্রিকা সম্পাদককে দিয়েছিলেন প্রাণনাশের হুমকি। ’৯৬তে ছাত্রলীগ নেতা সোহেল হত্যা মামলারও আসামি ছিলেন তিনি। ১৯৯৪ সালে তার নেতৃত্বে হামলা হয় স্থানীয় একটি পত্রিকা অফিসে। মসজিদ থেকে ধরে এনে হেনস্থা করা হয় এর সম্পাদককে। ১৯৯৮ সালে মামলা করেন দৈনিক জনকণ্ঠের বিরুদ্ধে। কাশিপুর এলাকায় হামলা চালান এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে। ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত প্রতিবাদ সভাতেও হামলা করেন তিনি। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় সমাবেশ মঞ্চ। চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় নিজের হাতে বিচারের নামে অনেক মানুষের ওপর চালান নির্যাতন। ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর অবশ্য পাল্টে যায় পরিস্থিতি। আতœরক্ষার্থে গা-ঢাকা দেন ক্ষমতাধর আফতাব। অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় আফতাবের বাড়িতে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়েও পরপর দু’বার অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় আটক হলেও পরে রহস্যজনক সমঝোতায় বেরিয়ে আসেন বাইরে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বনে যান পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি। আ’লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার আসীনের পর  আবার পুরনো মূর্তিতে আবির্ভূত হন শ্রমিক নেতা আফতাব। বাস টার্মিনালের পাশাপাশি নজর দেন লঞ্চঘাটের দিকে। তার নেপথ্য বাধার কারণে দীর্ঘ প্রায় এক বছর গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘাটে ইজারাদার নিয়োগ দিতে পারেনি বিআইডব্লিউটিএ। পরপর পাঁচ বার টেন্ডার দিয়েও দাখিল হয়নি কোন দরপত্র। পরিবহন সেক্টরেও চলছে তার একক রাজত্ব। প্রশাসন পর্যন্ত তার কাছে হয়ে আছে জিম্মি। গত বছর নথুল্লাবাদ এলাকায় বিরোধপূর্ণ একটি জমিতে ইউনিয়ন অফিস তোলার কাজ শুরু করেন আফতাব। অনুমোদিত প্ল্যান না থাকায় বাধা দেয় নগর ভবন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ কয়েক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যান কাজ বন্ধ করতে। এ সময় তাদের সঙ্গে চরম অশোভন আচরণ করেন আফতাব। ‘গোলাম’ বলে গালাগালের পাশাপাশি করা হয় লাঞ্ছিত। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনে সৃষ্টি হয় ক্ষোভের। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে উল্টো চাল চালেন আফতাব। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দুই কর্মকর্তাকে দেন নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার আলটিমেটাম। অন্যথায় আবারও দেয়া হয় ধর্মঘটের হুমকি। সর্বশেষ গত ২৭জানুয়ারী এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র নিয়ে মেয়র হিরন ও আফতাব হোসেন পরস্পরকে ঘায়েল করতে হার্ডলাইনে যায়। শিক্ষার্থী কর্তৃক মানববন্ধন করানোর অভিযোগ এনে তৎসময়েও আফতাব হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন মেয়র হিরনকে সাত দিনের মধ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। নচেৎ বরিশালের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। এসব কারনে নথুল্লাবাদ বাস শ্রমিকদের একাংশ আফতাব হোসেনের জিম্মীদশা থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছে।