এক মুক্তিযোদ্ধা (!) আওয়ামী লীগ নেতার আত্মকাহিনী

তিনি পরিচয় দেন আওয়ামী লীগের একটি উপজেলা কমিটির মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে। এর আগে করতেন জামায়াতে ইসলামী। রুকন হওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন। শোনা গেছে রুকন প্রার্থীও নাকি হয়েছিলেন। জামায়াতের রুকন হওয়ার জন্য আগে প্রার্থী হতে হয়। ছিলেন একটি ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। আবদুল মান্নান মৃধাজামায়াতের নেতা-কর্মীরা তাকে নির্বাচিত করার জন্য নিজেদের গাটের পয়সা খরচ করেছেন বলে জনশ্রুতি আছে। কেউ কেউ এক মাসের বেতন দিয়েছিলেন বলেও শোনা যায়। নিষিদ্ধ সর্বহারা পার্টি ছেড়ে জামায়াতে যোগ দিয়েছিলেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার পর একবার কিছু দিনের জন্য বিএনপির স্বাদও গ্রহণ করেছিলেন। তার কাজিন বিএনপির এমপি ছিলেন। বিরোধ ছিল তার সাথে। আবার ফিরে আসেন জামায়াতে। বিএনপিতে যোগ দেয়ার কথা বেমালুম অস্বীকার করেন। জামায়াত নেতাদের বোঝাতে চেষ্টা করেন তার এলাকায় জামায়াতের যে কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন তার চেয়েও তিনি বেশি জামায়াতী।

চেয়ারম্যান থাকার এক পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন জামায়াতে তিনি স্যুট করছেন না। জামায়াতে থেকেও আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করছেন এমন অভিযোগ আসে। ফলে জামায়াতের সাথে দূরত্বও বেড়ে যায়। জামায়াতও তাকে বহিষ্কারের চিন্তা করে। এক সময়ে এক বড় নেতার হাত ধরে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিতে ওই আওয়ামী লীগ নেতা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ততা অর্জন করেন খুব অল্প সময়ে। ২০০৬ সালে ওই নেতার নির্বাচনের জন্য ২ লাখ টাকা এনেছিলেন তিনি। শোনা গেছে এই টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। তার এলাকার কোনো আওয়ামী লীগ কর্মীকে এই টাকার সংবাদ তখন জানাননি।

শোনা গেছে সাবেক এই ইউপি চেয়ারম্যান তার এলাকার আওয়ামী লীগের এর আগের এমপির সাথে পরামর্শ করে একটি চর নিজের নামে দলিল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। চরটি দু’টি উপজেলার সীমান্তে অবস্থিত। এর আগের আওয়ামী লীগের ক্ষমতার শেষ সময় হওয়ায় তিনি এটি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ওই এমপিকেও চরটির কিছু অংশ দেয়ার কথা ছিল বলে লোকমুখে শোনা গেছে। তবে বিষয়টি খুবই গোপনে হচ্ছিল বলে কম লোকই এটি জানতে পেরেছে। চরটি এখনো দখলের জন্য তিনি প্রায়ই বরিশাল ভূমি অফিসে যোগাযোগ করেন বলে প্রায়ই শোনা যায়।

সর্বহারা পার্টি করার সময়ের একটি ঘটনা। তিনি তার দলবল নিয়ে গিয়েছিলেন ডাকাতি করতে এক প্রভাবশালীর বাড়িতে। গৃহকর্তা টের পেয়েছিলেন। দলের অন্যরা পালিয়ে যায়। ঘরটি পুরো অন্ধকার থাকায় তিনি ছিলেন কিংকর্তব্যবিমুঢ়। গৃহকর্তার অস্ত্র ছিল বলে জানা ছিল এই আওয়ামী লীগ নেতার। প্রাণ বাঁচানোর জন্য এলাপাথারি ব্রাশফায়ার শুরু করেন তিনি। গৃহকর্তাসহ তখন ওই পরিবারের পাঁচ জন নিহত হয়েছিলেন। তবে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন অল্পের জন্য। এরপরই বাড়িতে ফিরে আসেন। ভালো হওয়ার অভিনয় করেন।

চাকরির জন্য চলে যান রংপুরে। সেখানে আশ্রয় নেন আর এক প্রভাবশালী পরিবারের কাছে। তাদের ব্যবসা দেখাশুনা করতেন। রহিম উদ্দিন ভরসা আর করিম উদ্দিন ভরসার নাম সবাই জানে। আশ্রয়দাতা ছিলেন এই পরিবার। অনেক দিন কাজ করে বিশ্বস্ততা অর্জনের পর বড় একটা চালান আত্মসাৎ করে বাড়ি চলে আসেন। বিড়ি ফ্যাক্টরি দেন সরিকল হাটে। এক পর্যায়ে লোকসান দিয়ে বিক্রি করে দেন ফ্যাক্টরি। এরপর অনেক ব্যবসা করেছেন। কিন্তু কোনো ব্যবসায় সফল হতে পারেননি।

গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা সম্পাদক বলে পরিচয়দানকারী সাবেক এই উপজেলা চেয়ারম্যান সর্বহারা পার্টি করতেন শরীয়তপুরে। ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা উপজেলার পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি যে কেউ তার ব্যাপারে বলতে পারবেন। তার নাম শুনলেই সবাই ভয় পেত।

মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন বলে তিনি প্রচার করেন। সার্টিফিকেটও আছে। কিন্তু যুদ্ধে তিনি ও তার বাহিনী অস্ত্র লুটের জন্যই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সিরাজ সিকদারের অনুসারী ছিলেন এই নেতা।

বর্তমানে বরিশাল কোর্টে দালাল হিসেবে পরিচিত এই নেতা। মামলার দালালী করেন। বাদি বিবাদি উভয়কে পরামর্শ দেন। উভয়ের কাছ থেকে টাকা নেন। জমির দালালী হলে খুশি হন বেশি। মামলা চালাতে পারেন কয়েক বছর। গৌরনদীতেও ইদানিং দালাল হিসেবে বেশ পরিচিতি পাচ্ছেন। তার হতে কোনো মামলা পড়লে সাধারণত উপজেলা ভূমি অফিসে শেষ হয়না। বরিশাল যেতে হয়। তার নিজ গ্রাম হোসনাবাদে তার ব্যাপারে অনেক সমালোচনা আছে। সমালোচনা আছে তার নিজ বাড়িতেও। বাড়ির সামনের দু’টি স্কুল, মসজিদ, ময়দানের অর্থ সম্পদ তিনি আত্মসাৎ করেছেন বলে প্রতিবেশীরাই অভিযোগ করছেন।

মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটধারী ও আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয়দানকারী সাবেক এই চেয়ারম্যানের নাম আবদুল মান্নান মৃধা। পিতার নাম আব্দুল মজিদ মৃধা। জনশ্রুতি আছে তিনি আবারও ইউপি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করবেন। চেষ্টা করবেন আওয়ামী লীগের সমর্থন নেয়ার। হয়তো ধুর্ত এই নেতা তার চাপার জোরে আওয়ামী লীগের সমর্থনও আদায় করতে পারবেন।

ভেবে দেখা দরকার তার রাজনৈতিক পরিচয় আসলে কী? তিনি শিবিরকে এখনো নিয়মিত এবং বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে চাঁদা দেন। বক্তব্য দেন কাজিন জহির উদ্দিন স্বপনের পক্ষেও। গ্রাম্য সালিশের রায় দেন অর্থের বিনিময়ে। অর্থ না দিলে মীমাংসা হয় না। বাড়ে থানা পুলিশের হয়রানি।

আওয়ামী লীগ তাকে শাস্তি দিলে এলাকার লোক অনেক খুশি হতো। বেরিয়ে আসতো এলাকার অনেক খুনের ঘটনার অজানা তথ্য। তিনি নিজেই পরিচিত হতেন একজন খুনী হিসেবে। চরিত্রহীন, লম্পট এই লোকটিকে আওয়ামী লীগ শাস্তি দেবে এই প্রত্যাশা সবার। উন্মোচন করা দরকার এই মুখোশধারীর আসল চরিত্র। তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিলেই সব বেড়িয়ে আসবে।