ভাষা আন্দোলনের আহবায়ক : শহীদ মিনার

স্মৃতি বিজরিত জন্মস্থান বরিশালের গৌরনদী পৌর এলাকার লাখেরাজ কসবা গ্রাম। ওইগ্রামসহ ভাষা সৈনিকের সমাধীস্থল কিংবা পাশ্ববর্তী মহল্লার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নেই কোন স্থায়ী শহীদ মিনার। এছাড়াও লাখেরাজ কসবা গ্রামের পাশ্ববর্তী নীখখোলা নামকস্থানে গত ছয় বছর পূর্বে নির্মিত হয়েছে ‘ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব স্মৃতি পাঠাগার’। পাঠাগারের সম্মুখেও আজো নির্মিত হয়নি কোন শহীদ মিনার। ওইসব এলাকার দু’একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর কলাগাছ দিয়ে শহীদ মিনার নির্মান করা হলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই ভাষা শহীদদের স্মরনে কোন কর্মসূচী পালন করা হয়না বলে অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ বছর স্মৃতি পাঠাগারের সম্মুখে কলাগাছ দিয়ে শহীদ মিনার নির্মানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এলাকাবাসি ভাষা সৈনিকের জন্মস্থানসহ স্মৃতি পাঠাগারের সম্মুখে স্থায়ী ভাবে শহীদ মিনার নির্মানের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। 

সূত্রমতে, বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের পাশ্ববর্তী গৌরনদী পৌর এলাকার নীলখোলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন স্থানে পারিবারিক উদ্যোগে ভাষা সৈনিকের পৈত্রিক স¤পত্তিতে ২০০৬ সালের ১৪ ফেব্র“য়ারি “ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব স্মৃতি পাঠাগার” ও তার মায়ের নামে “আছিয়া চ্যারিটেবল ক্লিনিক”-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ছোট্ট একটি ভবনের একটি কক্ষে পাঠাগার ও অপর একটিতে ক্লিনিকের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ক্লিনিকের সহযোগী ইনচার্জ দিদারুল ইসলাম জানান, সপ্তাহে তিনদিন বরিশাল ও গৌরনদী হাসপাতালের বিশেষ্ণ চিকিৎসকেরা বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্লিনিকে আসা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। সপ্তাহের তিনদিন ওই ক্লিনিকে আসা প্রায় দুই থেকে আড়াই’শ রোগীদের বিনামূল্যে ক্লিনিকের পক্ষ থেকে ঔষধ সরবরাহ করা হয়। শুরু থেকেই ক্লিনিক ও পাঠাগারে হারুন-অর রশিদ ও দিদারুল ইসলাম নামের দু’জন ষ্টাফ নিয়োগ রয়েছেন। তাদের বেতনাদিসহ সকল ব্যয়ভার ভাষা সৈনিকের পুত্র ডাঃ কাজী মাহমুদুল হাসান চঞ্চলই বহন করছেন। পাঠাগারে রাষ্ট্রভাষার ওপর সহস্রাধীক বই, ভাষা সৈনিকের ভাস্কর্য ও বিশেষ কিছু ছবি রয়েছে। ভাষা সৈনিকের প্রতি এলাকাবাসির অনেক আবেগ, শ্রদ্ধা আর বুকভরা ভালবাসা নিয়ে দৃষ্টি নন্দন ও বইপত্রে সমৃদ্ধ পাঠাগারটিতে প্রতিদিন শত শত স্কুল-কলেজ পড়য়া শিক্ষার্থীরা এসে ভাষার ওপর জ্ঞান চর্চা করছেন। ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ফাউন্ডেশনের গৌরনদী শাখার সাধারন সম্পাদক জহুরুল ইসলাম জহির বলেন, পাঠাগারের শুরু থেকে অদ্যবর্ধি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উদ্যোগে ভাষা সৈনিকের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানিয়ে কোন ভূমিকাই রাখা হয়নি। এমনকি স্থানীয় পৌরসভাসহ উপজেলা প্রসাশনের কাছে ভাষা সৈনিকের জন্মভূমি, সমাধীস্থল ও পাঠাগারের সম্মুখে শহীদ মিনার নির্মানের জন্য একাধিকবার ধর্ণা দিয়েও কোন সুফল মেলেনি।

এলাকাবাসির ভাষ্যমতে, বায়ান্নর ভাষা শহীদদের স্মরনে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় গ্রন্থাগার নির্মিত হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ভাষা সৈনিকের জন্মভূমি ও সমাধীস্থলে সরকারি উদ্যোগে কোন গ্রন্থাগার কিংবা স্মৃতি জাদুঘর এমনকি একটি শহীদ মিনার পর্যন্ত নির্মিত হয়নি। এলাকাবাসি সরকারি উদ্যোগে ভাষা সৈনিকের স্মরনে স্মৃতি গ্রন্থাগার ও জাদুঘর নির্মানের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

সূত্রে আরো জানা গেছে, ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের বাড়ির সম্মুখে ১৯৫১ সালে নির্মিত হয় লাখেরাজ কসবা প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই বিদ্যালয়ের পার্শ্বেই চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অদ্যবর্ধি ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নির্মিত হয়নি কোন শহীদ মিনার। ভাষা সৈনিকের গ্রামে রয়েছে ইসলামী মিশন, কসবা নূরানী মাদ্রাসা, কসবা ইসলামী প্রি-ক্যাডেট স্কুল, রামসিদ্ধি ও বড় কসবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটিতেও নেই স্থায়ী কোন শহীদ মিনার।

উল্লেখ্য, ১৯২৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর লাখেরাজ কসবা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন কাজী গোলাম মাহবুব ওরফে ছরু কাজী। তিনি ওই গ্রামের কাজী আব্দুল মাজেদের জ্যেষ্ঠপুত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত অবস্থায় ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহন করেন। ওই বছরের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অনুষ্ঠিত হরতাল কর্মসূচীতে পিকেটিং করতে গিয়ে তিনি গ্রেফতার হয়ে কারা বরন করেন। কারাভোগের পর জামিনে মুক্ত হয়ে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন সময়ের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমদ্দিন কর্তৃক উর্দুকে পাকিস্তানে একামাত্র রাষ্ট্রভাষার ঘোষনা দিয়ে পল্টনে বক্তব্যে রাখার পর নতুন করে ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি সর্বদলীয় সভার আয়োজন করেন। ওইসভায় তাকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক করা হয়। ’৫২-র ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করায় তৎকালীন পাকিস্তানের প্রশাসন তার ওপর হুলিয়া জারি করেন। ২০০৬ সালের ১৯ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক কাজী গোলাম মাহবুব ঢাকার ধানমিন্ডস্থ বাসায় শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন। ২০ মার্চ তার জন্মভূমি গৌরনদীর লাখেরাজ কসবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হয়।


খোকন আহম্মেদ হীরা : সম্পাদক, Gournadi.com