স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা অনেক বড় বড় রোগের কারণ নির্ণয় করেছেন এবং তদানুসারে ঔষুধও আবিষ্কার করেছেন। ম্যালেরিয়া, কলেরা, গুটি বসন্ত, যা- ইত্যাদি ভয়াবহ রোগগুলোর কারণ আবিষ্কৃত হওয়ায় এ অসুখগুলো নিয়ে মানুষ আর চিন্তিত নয়। ‘হলে যক্ষা, নাই রক্ষা’ -এ প্রবচন আজ মানুষ বিষ্মৃত প্রায়। কিন্তু প্রাণান্তকর চেষ্টা ও শত গবেষণা সত্বেও ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা বলছেন যে কোন অজানা কারণে প্যানক্রিয়াসের বেটা সেল (Beta Cell) ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। এর ফলে ইনসুলিন তৈরিতে প্যানক্রিয়াস সম্পূর্ণ অথবা আংশিক অম হয়ে পড়ে। ইনসুলিনের অভাবের কারণে রক্তের গ্লুুকোজ আমাদের শরীরের বিপাক ক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না। এর ফলে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ:
স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা ডায়াবেটিসকে মূলত: ৩ ভাগে ভাগ করেছেন যথা টাইপ-১ (Type-1), টাইপ-২ (Type-2), এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational Diabetis)।
টাইপ-১: ডায়াবেটিস বলতে আমাদের শরীরের এমন এক অবস্থা বুঝায় যখন আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী ব্যবস্থা (Immunology) আমাদের শরীরের কোন বিশেষ অংগের তি বা ধ্বংস সাধন করে। এ অবস্থায় আমাদের প্যানক্রিয়াসের বেটা সেল (Beta Cell) গুলো ধ্বংস প্রাপ্ত। ফলে প্যানক্রিয়াসে ইনসুলিন উৎপাদিত হয় না বা খুব অল্প পরিমান ইনসুলিন উৎপাদিত হয়। রোগীকে ইনসুলিন নিয়ে বাঁচতে হয়। কেন এমনটি ঘটে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা তা এখনও নির্ণয় করতে পারেনি। তবে তাঁরা ধারণা করেন যে শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী ব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বা কোন বিশেষ পরিবেশগত কারণে বা কোন ভাইরাসের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। সনাক্তকৃত মোট ডায়াবেটিস রোগীর ৫%-১০% টাইপ-১ ভুক্ত। সাধারণত: ৩০ বৎসরের কম বয়সের লোক, ছোট ছোট ছেলে মেয়ে এবং যুবক যুবতীদের মধ্যে টাইপ-১ ডায়াবেটিস দৃষ্ট হয়। তবে যে কোন বয়সে টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগ হতে পারে।
টাইপ-১ ডায়াবেটিস এর লণঃ টাইপ-১ ডায়াবেটিস এর লণগুলো হলো তীব্র পিপাসা, ঘনঘন প্রস্রাব, ক্ষুধার আধিক্য, ওজন কমে যাওয়া, দৃষ্টি শক্তির হ্রাস এবং চরম দূর্বলতা। যদি টাইপ-১ ডায়াবেটিস সনাক্ত করা না হয় বা ইনসুলিন প্রদানের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু না করা হয়, তবে রোগী ডায়াবেটিক কোমা (গভীর অচৈতন্যাবস্থা বা মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থা) তে উপনীত হতে পারে।
টাইপ-২ : ডায়াবেটিস রোগীদের প্রায় ৯০% টাইপ-২ ডায়াবেটিসভুক্ত। বার্ধ্যক্য, স্থুলতা, কর্মহীনতা, পিতামাতার ডায়াবেটিস থাকা-এ কারণগুলো মূলত: টাইপ-২ ডায়াবেটিসের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। টাইপ-২ ভুক্ত ডায়াবেটিসের ৮০% ভাগ রোগীর ওজন কাম্য ওজনের চেয়ে অধিক। আজকাল ত্রিশ বছরের নীচে এ ধরনের ডায়াবেটিস দেখা যাচ্ছে এবং দিন দিন বেড়েই চলেছে।
প্যানক্রিয়াসে যথেষ্ট পরিমান ইনসুলিন উৎপাদিত হওয়া সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে আমরা ইনসুলিনের পরিপূর্ণ ব্যাবহার করতে পারি না। এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কয়েক বছর পরই ইনসুলিন উৎপাদন কমে যায় এবং টাইপ-১ এ রূপান্তরিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে টাইপ-২ ভুক্ত ডায়াবেটিক রোগীরা শারিরীক কোন অসুবিধা অনুভব করেন না; ফলে চিকিৎসকদের কাছে আসেন না। বিনা চিকিৎসায় বছরের পর বছর পার করে এবং বিভিন্ন জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হন।
টাইপ-৩ : গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational Diabetis)ঃ কিছু কিছু মহিলার গর্ভধারণের শেষ দিকে এ ডায়াবেটিস হয় এবং বাচ্চার জন্মের পর পরই এ ডায়াবেটিস হতে প্রসূতি সাধারণতঃ মুক্ত হয়ে যায়। যে সকল গর্ভবতী মেয়েদের এ ডায়াবেটিস হয় তাদের ২০% – ৫০% সাধারণতঃ ০৫/১০ বছরের মধ্যেই টাইপ-২ ধরণের ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হয়। এক তথ্য বিবরণীতে দেখা গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের ৩%-৫% গর্ভবতী মহিলা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের (Gestational Diabetis) রোগী। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational Diabetis) প্রসুতি, ভ্র“ণ এবং সদ্য প্রসূত শিশু সকলের জন্যই বিপদজনক হতে পারে। এ জন্য প্রয়োজনে ইনসুলিন (Insulin) নিয়ে এ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা আবশ্যক।
কিভাবে বুঝা যায় যে ডায়াবেটিস হয়েছেঃ
(ক) সকাল বেলা খালি পেটে রক্তের শর্করার পরিমাণ নির্ণয় করার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নির্ণয় কে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অগ্রধিকার দিয়ে থাকেন
ক্স খালি পেটে প্রতি ১ ডেসি লিটার রক্তে ১২০ মিঃগ্রাঃ (৬.৬ মিলি মোল/লিটার) বা তার কম শর্করা পাওয়া গেলে ধরে নেয়া হয় যে, কোন ব্যক্তির ডায়াবেটিস ভাল নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ডায়াবেটিস নির্ণয়ের এ পরীক্ষাকে অভুক্ত থাকার পরীক্ষা (Fasting glucose Test) বলে। খালি পেটে থাকা অবস্থায় রক্তে গ্লুকোজের আধিক্য হলে, পরবর্তিতে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই ডায়াবেটিসের এ অবস্থা বিশেষ গুরুত্ববহ। এ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ না রাখলে ধমনী-শিরা ও হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ক্স খাবারের পর প্রতি ডিসি লিটার রক্তে ১৮০ মি: গ্রাম (১০ মি: মোল/লিটার) গ্লুকোজ বা ততোধিক শর্করা পাওয়া গেলে ধরে নেয়া হয় যে, কোন ব্যক্তির ডায়াবেটিস হয়েছে।
ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে কি হবে:
ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত রাখার বিপদ অনেক। পাঘাত, পায়ে পচনশীল ত, স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতা, হৃদরোগ, দৃষ্টিশক্তিহীনতা, কিডনীর কার্যমতা লোপ পাওয়া, মাড়ির প্রদাহ, চুলকানি, পাঁচড়া, যৌনতা লোপ, ইত্যাদি বিভিন্ন রোগের সাথে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক গভীর। ডায়াবেটিক প্রসূতিদের ক্ষেত্রে মৃত শিশুর জন্মদান, অকালে সন্তান প্রস্রব, অধিক ওজনের শিশুর জন্মদান হতে পারে। ডায়াবেটিক রোগীদের উচ্চ চাপ থাকলে জটিলতা আরও বেড়ে যেতে পারে। ধূমপান এ ক্ষেত্রে জটিলতাকে তরান্বিত করে।
ডায়াবেটিস রোগী সমন্ধে কয়েকটি ধারণা।
(ক) রক্তে শর্করার স্বল্পতা (Hypoglycemia) রক্তের শর্করার পরিমান কমাবার জন্য যদি ট্যাবলেট খাওয়া বা ইনসুলিন নেয়া হয় এবং এর ফলে রক্তে শর্করার পরিমান ২.৫ মি:মোল/লিটার এর কম হয়ে যায় তবে (Hypoglycemia) হয়। এ অবস্থায় রোগীর নিম্নবর্ণিত লণ দেখা যায়:-<br /> ১. খুবই অসুস্থ বোধ করা;
২. বেশী ঘাম হওয়া;
৩. খুবই ক্ষুধা পাওয়া;
৪. শরীর কাঁপতে থাকা;
৫. অচেতন হয়ে যাওয়া;
৬. শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি।
প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ইনসুলিন গ্রহণ করলে এবং ইনসুলিন নেয়ার অনেকণ পর খাবার খেলে বা হঠাৎ বেশী ব্যায়াম করলে এ অবস্থা ঘট্তে পারে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে অনতিবিলম্বে রোগীকে ১ গ্লাস পানিতে ৪ (চার) চামচ চিনি গুলিয়ে খাইয়ে দিতে হবে। রোগী অচেতন হয়ে পড়লে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে; বাড়ীতে ব্যবস্থা থাকলে গ্লুকোজ ইনজেকশন দিতে হবে।
ডায়াবেটিক কোমা:
যাঁরা ইনসুলিন নির্ভর ডায়াবেটিক রোগী, তাঁরা যদি ইনসুলিন নিতে ভূলে যান বা কম ইনসুলিন নেন, পরিমানের অতিরিক্ত খাবার খান এবং দৈহিক কোন পরিশ্রম না করেণ তবে রক্তে সুগারের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিক কোমা হতে পারে। এ অবস্থা অতি গুরতর এবং সাথে সাথে রোগীকে চিকিৎসালয়ে নিতে হবে। ডায়াবেটিক কোমার লণগুলি হলো:
(ক) খুবই ঘনঘন প্রস্রাব করা এবং প্রস্রাবে গ্লুকোজের মাত্রা খুবই বেড়ে যাওয়া;
(খ) খুব বেশী পিপাসা লাগা এবং খুবই ক্ষুধা লাগা;
(গ) বমি বমি ভাব, দূবর্লতা বোধ, শ্বাস কষ্ট হওয়া, নিস্তেজ বোধ করা এবং চোখে কম দেখা।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ:
আগেই বলা হয়েছে যে ডায়াবেটিস রোগের কোন ভাইরাস বা কোন এজেন্ট আছে কিনা তা আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণ করেই রোগীদের ভাল থাকতে হবে। এ জন্য পরিপূর্ণ শৃংখলাবদ্ধ জীবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোগী যদি নিজে চান যে তিনি ভাল থাকবেন, তবে ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রিত থাকবে এবং পরিপূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপণ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে অবশ্য পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সহযোগিতা প্রয়োজন।
খ্যাদ্যাভাস:
১. ডায়াবেটিক রোগীদের খাদ্যাভাস এমনভাবে গড়ে তোলা দরকার যাতে শরীরের ওজন কাম্য সীমার উপরে বা নীচে না যায়।
২. খাদ্য তালিকায় ভাত, রুটি ইত্যাদির পরিমান কমিয়ে পরিবর্তে শাকসব্জী বাড়িয়ে দিতে হবে; আঁশযুক্ত সাক শবজী প্রচুর পরিমানে খাওয়া যাবে।
৩. মিষ্টি জাতীয় খাবার (কেক, পেস্তি, জ্যাম, জেলি, মিষ্টি, ঘনীভূত দুধ, মিষ্টি বিস্কুট, সফট ড্রিক, চায়ে চিনি ইত্যাদি) খাওয়া যাবেনা।
৪. নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খেতে হবে। ঘি, মাখন, চর্বি, মাংস ইত্যাদি কম খেতে হবে।
৫. যথা সময়ে ঘুমাতে হবে এবং সকল ধরণের দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত থাকতে হবে।
৬. ধূমপান, মদ পান এবং হোটেলের খাবার পরিপূর্ণভাবে পরিহার করতে হবে।
ব্যায়াম :
শরীর সুস্থ রাখতে হলে ব্যায়ামের কোন বিকল্প নেই। শরীরের জড়তা দূর, ধমনী-শিরায় রক্ত চলাচল বৃদ্ধি ও ইনসুলিন উৎপাদন ও ব্যবহারের বৃদ্ধি- ইত্যাদি কারণেই ব্যায়াম অতি জরুরী। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, যাঁরা দৈহিক কাজ করেন না এবং অলস জীবন যাপন করেন তাঁরা প্রায় ডায়াবেটিসে ভুগে থাকেন। এ জন্য যাঁরা ডায়াবেটিস আক্রান্ত তাঁদের দৈনিক কমপে ৪৫ মিনিট হাঁটাহাঁটি বা হালকা ব্যয়াম করতে হবে। দৈনিক ৪৫ মি: হাঁটলে খাদ্যাভাস সঠিক থাকলে, এবং দৈহিক ওজন কাম্য সীমার মধ্যে থাকলে টাইপ-২ ভুক্ত ডায়াবেটিক রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যা আমাদের করা দরকার তা হলো মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত পথে চলা এবং নৈতিকতাবোধ উজ্জীবিত হয়ে প্রতিটি কাজ করা। এর ফলে জীবনের প্রতিটি তরে শৃংখলা স্থাপিত হবে। আর শৃংখলাই হলো ডায়াবেটিসসহ সকল মারাত্মক রোগের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিকার।
Source: SomeWhereinBlog