এগিয়ে চলেছে ভারতের মুসলিম নারীসমাজ

গার্লস সিনিয়র সেকেন্ডারি সুকলের ক্লাস এইটে পড়ত। তার বড় ভাই খালিদ আসরাফ যিনি তখন কিরোরি মাল কলেজের লেকচারার ছিলেন, সে তার বোনের সুকলে গিয়ে প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ জানায়, তার বোনকে যেন সুকলে পাশ্চাত্য পোশাক স্কার্ট পড়া থেকে অব্যাহতি দিয়ে চিরাচরিত ঐতিহ্যবাহী পোশাক সালওয়ার পরে আসার অনুমতি দেওয়া হয়। আজরা রীতিমতো রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হওয়ায় সুকল কর্তৃপক্ষ এই অনুরোধ স্বীকার করে নেয়।

এবার ফিরে আসি বর্তমান সময়ে। আজরার মেয়ে এখন কলেজে পড়ে, সে নিয়মিত জিন্স আর টি-শার্ট পড়ে এখন কলেজে যায়, এ নিয়ে তার মায়ের কোনও রক্ষণশীলতা নেই। সময় অবশ্যই বদলেছে। এমন কি আজরার দাদা যে এক সময়ে ওই ধরনের অনুরোধ জানিয়েছিল, সে এখন তার ছাত্র-ছাত্রীদের রোজ শোনায় মুসলিম সমাজের এগিয়ে যাওয়ার পথে বিশেষ করে মেয়েদের অবস্হার উন্নতির পথে এই পর্প্রথা অন্যতম বাধা। এমন কি তিনি আরও খানিকটা এগিয়ে এসে বলেন যে, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াত্তু নামাজ পড়া আধুনিক সমাজ ব্যবস্হার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পক্ষে অসুবিধা জনক।

দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তন দ্রুত সামাজিক বিবর্তন  ঘটিয়ে দিচেছ। আরও বেশি সংখ্যক মুসলিম মহিলা এখন পুরনো সংস্কার দূরে সরিয়ে বাইরে আসছেন। সামাজিক ক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি তাদের গুরুত্ব ও মতামত ক্রমশ বৃদ্ধি পাচেছ।

ডঃ ফরিদা খানম, যাঁকে পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত সুকলে যেতেই দেওয়া হয় নি, তিনি এখন জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং ইংরাজিতে বেশ কয়েকটি ভাল ভাল বইয়ের লেখক। তিনি জানান, “আমার জীবনটাই মুলসিম যুবসমাজের কাছে অন্যতম বার্। আমি কখনও ইংরাজি মাধ্যমে পড়াশোনা করিনি, কিন্তু আমি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেছি।’’

তিনি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করেন। এই শিক্ষাবিদ আরও জানান, “মুসলিম মহিলাদের এখন এগিয়ে এসে ধন্যবাদ জানানো উচিত, এরা এমন একটা সময়ে জন্মেছে, যে সময়ে তাদের সামনে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনার সুযোগ।”

এমনকি এখনকার মুসলিম মহিলারা খেলাধূলার জগতেও এগিয়ে এসেছে, তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ স্হান অধিকার করছে। এমন একজন স্পোর্টসওম্যান  অসমের চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু ফারিহা জামাম। তিনি পঞ্চাশ মিটার ব্যাকস্ট্রোক-এ জাতীয় রেকর্ড করেছেন।  তিনি মনে করেন একজন মুসলিম মেয়ে হিসাবে বড় হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাঁকে তেমন কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি। তিনি জানান, ‘‘আমাকে সকলেই খুব পছন্দ করতেন, আর আমার এগিয়ে চলার পথে সকলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি যখন সাঁতারের পোশাক পরে সুইমিং পুলে নেমেছি, তখন কেউ তা নিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকায় নি।”

যদিও টেনিস তারকা সানিয়া মির্র অভিজ্ঞতা এতটা ভাল নয়।  তাঁর টেনিস খেলার পোশাক নিয়ে বারবার তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষরা আপত্তি তুলেছেন। স্বঘোষিত নীতিপুলিশরা তাঁকে বারবার আঘাত করেছে। কিন্তু তিনি একবারের জন্যই এই কদর্য আক্রমণের সামনে নতি স্বীকার করেন নি। তিনি ধৈর্যয সহকারে তার প্রতিরোধ চালিয়ে গেছেন। নিজের লক্ষ্যে স্হির থেকেছেন, এ বিষয়ে তাঁর বাবা সাংবাদিক ইমরান মির্ তাঁর পাশে সবসময় থেকেছেন। সানিয়া মির্ জানান, “আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও দক্ষতাই শেষ কথা বলে। আজকের যুব প্রজন্মকে আমি শুধু একটা কথাই বলব, খেলার মাধ্যমে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে কখনো আত্মবিশ্বাস হারানো চলবে না।”

পুণের আনিশা সৈয়দ গত দিল্লির কমনওয়েলথ গেম৲স থেকে শু্যটিং-এ দুটো স্বর্ণপদক জয় করেছে। তবে তিনি ইন্ডিয়ান রেলওয়েতে চাকরি করেন, এখানে তাঁর কোনও কিছু সহজ ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন মুম্বই থেকে দিল্লিতে ট্রান্সফার নিয়ে যেতে। কারণ তাঁর স্বামী এখন দিল্লিতে রয়েছেন। কিন্তু তাঁর উধর্বতন কর্তৃপক্ষ তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি। তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে দিল্লিতে গিয়েছেন।

আনিশা মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের মহিলা। প্রায় এক দশক আগে তিনি ঠিক করেছিলেন যে, তিনি পিস্তল শু্যটিংকে তাঁর স্পোর্টস হিসাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তিনি জানান, “আমি আমার স্বামীর কোম্পানির কাছে কৃতজ্ঞ। তারাই আমার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে স্পনসর হতে এগিয়ে এসেছে।” তিনি আরও জানান, তাঁর জয়ের খবর আসতেই ভারতীয় রেল দ্রুত তাঁর নামে পুরস্কার ঘোষণা করে দেয়।

আনিশা বিশ্বাস করেন, এখন সময় এসেছে মুসলিম মেয়েদের পক্ষে আরও গুরুত্ব সহকারে খেলাধূলোর দিকে নজর দেওয়া। তিনি বলেন, “মুসলিম মেয়েদের মধ্যে স্বাভাবিক প্রবণতাই হল খেলাধূলোর দিক থেকে দূরে সরে থাকা। কিন্তু এখন সময় এসেছে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার। এখন অনেক অনেক নিয়ম-কানুন রয়েছে যা তাদের মানতে বাধ্য করা হয়।”

খেলার জগতের বাইরেও মুসলিম মহিলারা নানা ভাবে তাদের সাহসী পদক্ষেপ রাখছেন। তাঁরা তাঁদের নিজস্ব ইচছা-অনিচছার মর্দা রাখতে এগিয়ে আসছেন। শায়েস্তা অম্বর, অল ইন্ডিয়া মুসলিম ওম্যান পার্সনেল ’ল বোর্ডের চেয়ারপার্সন। তিনি নিজস্ব চিন্তাভাবনার স্বপক্ষে এগিয়ে যেতে কখনো পিছপা হননি। তিনি তাঁর নিজের অলঙ্কার বিক্রি করে সেই অর্থে জমি কিনে, সেখানে একটা মসজিদ ও একটা ধর্মশালা গড়ে তুলে অন্যতম দৃষ্টান্ত স্হাপন করেছেন।

তিনি জানান, “ভূমিপূজার পর ধর্মশালার  ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপন করা হয়, কিন্তু অনেকেই এর বিরোধিতা সেদিন করেছিলেন। তাঁরা ধর্মের দোহাই দিয়ে আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি ইসলামের সঙ্গে  ভূমি পূজার কোনও বিরোধ নেই। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেই সহজ কাজ ছিল না। আমার উপর অনেক আক্রমণ চালানো হয়, কিন্তু তাদের প্রত্যেকটা আঘাত আরও বেশি করে আমার শত্তিু বৃদ্ধি করে দিতে থাকে। আর আমি আমার সিদ্ধান্তে আরও বেশি দৃঢ় হয়ে উঠতে থাকি।”

তবে এটা ঠিকই, জনপ্রিয়তা নেই এমন কোনও বিষয় নিয়ে কাজ করা অনেক বেশি কঠিন। এই ধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে মুম্বইয়ের ক্রিমিনাল ’ল-ইয়ার ফারহানা শাহের। তিনি ৰজ্ঝজ্ঝ্ব সালে ঘটে যাওয়া মুম্বইয়ের ধারাবাহিক বিস্ফোরণের মামলার আইনজীবী। তিনি আইনের জটিলতায় ফেঁসে যাওয়া   নিরীহ মানুষদের জট ছাড়িয়ে মুত্তিু দেবার চেষ্টা করছেন। তিনি যখন এই মানুষদের মুত্তিুর চেষ্টার জন্য এগিয়ে আসেন তখন কেউই এদের পাশে দাঁড়ায়নি।

তাঁর নিজের কেরিয়ারের কথা বলতে গিয়ে ফারহানা বলেন, “আমি আগে অন্য ধরনের কাজ করতাম। তারপর একসময় মনে হল আমার মনে হয় আমি এই কাজের ঠিক উপযুত্তু নই। তখন আমি আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। আমার অনেক আত্মীয়-স্বজনই আমার এই ইচছার প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন, আবার অনেকেই আমায় সাহস জুগিয়ে পাশে এসে দাঁড়ান।”

ফারহানা তাঁর এই উত্থানের পেছনে তাঁর স্বামীর সহযোগিতার কথা জানালেন, “এমনটা বলা হয়ে থাকে যে, প্রত্যেক সফল পুরুষের উত্থানের পেছনে কোনও মহিলার অবদান থাকে। আমার ক্ষেত্রে উল্টোটাই। আমার সাফল্যের পেছনে আমার স্বামীর অবদান সবচেয়ে বেশি।”

সম্পূর্ণ নতুন একটা জগতে মুসলিম মেয়েরা নিজেদের প্রমাণ করেছে। বৈদু্যতিন প্রচারমাধ্যম। টেলিভিশনের স্পোর্টস জার্লিস্ট আফসানা আঞ্জুম প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন মুসলিম মেয়েরা আজকের দিনে জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে সমানভাবে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাঁর মতে মেয়েদের ছাড়া সবকিছু অর্থহীন হয়ে যাবে। তাঁর কথায়, “যখন দেখি আমার আশপাশে কোনও মহিলা সাফল্য লাভ করেছে তখনই আমি অনুপ্রেরণা পাই। বিশ্বাস জাগে, মেয়েদের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়।” তবে তিনিও স্বীকার করেন, মেয়েদের তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বাধার সম্মুখীন হতে হয়।

বরিষ্ঠ কংগ্রেস নেতা মহসিনা কিদয়ানি, যাঁর কোনও ভূমিকার প্রয়োজন নেই। তিনি প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে রাজনীতিতে রয়েছেন। তিনি যে সময়ে রাজনীতিতে আসেন সেই সময়ে ভারতীয় রাজনীতি প্রবলভাবে পুরুষশাসিত ছিল। তিনি জানান, “সেই সময়ে মেয়েদের রাজনীতিতে আসতে হলে সবথেকে বড় যে অসুবিধার মুখোমুখি হতে হত, তা হল বাড়ির লোকেদের সমর্থন পাওয়া। সমর্থন তো জুটতই না উপরন্তু তাঁরা যোগাযোগও রাখতেন না। শ্বশুর-স্বামী সকলেই বাধা দিতেন। তবে আমি ভাগ্যবান, আমাকে এই ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি।”

তবে বিহারে সমাজ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রবীন আমানুল্লার ক্ষেত্রে বিষয়টা এতটা সহজ হয়নি। তিনি সৈয়দ শাহাবুদ্দিনেরও মেয়ে, আইএফএস অফিসার থেকে পরে সাংসদ। রাজনীতিতে তিনি নতুন মুখ ছিলেন না। তিনি তথ্যের অধিকার আইনের মাধ্যমে চান এই ধরনের অসুবিধাগুলোতে দূর করতে। তিনি জানান, “আমার লক্ষ্য সমগ্র ব্যবস্হাকে পরিচছন্ন করে তোলা, তার জন্য আমি আরটিআই-এর পথ গ্রহণ করেছি।” তাঁর কথায়, “ধর্ম থাকবে মানুষের বাড়ির মধ্যে, যখন বাড়ির বাইরে মানুষ তখন মানবতাই একমাত্র ধর্ম।” তিনি বিশ্বাস করেন মুসলিম মেয়েরা চাইলে আজ আকাশ স্পর্শ করতে পারে।

মেহবুবা মুফতি, 2002 সালের জম্মু ও কাশ্মীর নির্চনে পিডিপি দলের সাফল্যের পেছনে যিনি অন্যতম কারিগর। তিনি মনে করেন, সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেই রাজনীতির প্রতি অনীহার মানসিকতা লুকিয়ে রয়েছে। তাই মুসলিম মেয়েদের মধ্যে রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার কোনও রেওয়াজ গড়ে ওঠে নি আজও। তিনি জানান, “আমাদের প্রয়োজন, সমগ্র মুসলিম সমাজের উন্নয়ন। যতক্ষণ না তারা মূলধারার সঙ্গে একাত্ম হতে পারছে, ততক্ষণ মুসলিম মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।”

কাশ্মীরের প্রথম মহিলা আইএএস আয়েশা ইকবাল উপত্যকার গর্ব। তিনি জানান, “আমাদের সমাজে কর্মরত মহিলাদের দ্বিগুণ চাপ সামালাতে হয় – একদিকে কাজের দায়িত্ব, অন্যদিকে পরিবারের। পর্ প্রথা হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজেই আছে। নির্ভর করে তাদের মানসিকতার উপর।

মুমতাজ কাজি কাথওয়ালাও একটি উল্লেখযোগ্য নাম সন্দেহ নেই। তিনিই এশিয়ার মধ্যে প্রথম মহিলা যিনি ডিজেল ও ইলেক্ট্রিক ট্রেন চালান। মুম্বইয়ের লোকাল ট্রেন চালান তিনি। দসাই-কে তিনি জানালেন, “ট্রেনিংয়ে আসা পঞ্চাশ জনের মধ্যে একমাত্র আমিই ছিলাম মহিলা। আমার বাবা প্রথমে ভয় পেয়েছিলেন, পরে সম্মতি জানান।”

নতুন অর্থনীতিতে এদের মতো অসংখ্য মুসলিম মহিলা এগিয়ে আসছেন, যাঁরা পুরনো মুল্যবোধকে স্বীকার করেও এগিয়ে যাওয়ার পথের বাধাকে দূর করে দিচ্ছেন। এখানেই আধুনিক মুসলিম মহিলা সমাজের জয়।


খবরটি তৈরীতে সহায়তা করেছেনঃ অনুরাধা প্রীতম, মোনালিসা গগৈ, নাদিম আহমেদ, দানিশ রেয়াজ, রাজন প্রকাশ, হারুন রেশি এবং সহদেব বাশির।

TheSundayIndian.com