গৌরব ও ঐতিহ্যের ১২২তম বিএম কলেজ দিবস পালিত

বিএম কলেজ দিবস পূর্তি উৎসব গতকাল মঙ্গলবার  বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা ও বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যদিয়ে পালিত হয়। বেলা ১১টায় বৃষ্টি বিঘ্নিত আবহাওয়া উপেক্ষা করে শিক্ষকÑকর্মচারী ছাড়াও হাজারও শিক্ষার্থী বাদ্যের তালে তালে র‌্যালিতে অংশ নিয়ে নেচে গেয়ে উল্লাস প্রকাশ করে। কলেজ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে র‌্যালিটি শুরু হয়ে কলেজ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে কলেজ অডিটোরিয়ামে এসে শেষ হয়। র‌্যালি শেষে বেলা সাড়ে ১১টায় ১২২তম বিএম কলেজ দিবস পূর্তি উৎসব উদ্যাপন কমিটির আহবায়ক মার্কেটিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শাহ্ সাজেদার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. ননী গোপাল দাস, বিশেষ অতিথি কলেজ উপাধ্যক্ষ প্রফেসর কাজী নজরুল ইসলাম। আলোচনা সভায় অংশ নেন কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. ননী গোপাল দাস, উপাধ্যক্ষ প্রফেসর কাজী নজরুল ইসলাম, শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক এ.এস কাইয়ুম উদ্দীন আহমেদ, শিক্ষক ক্লাবের সম্পাদক জিয়াউল হক জিয়া, অর্থনীতি বিভাগের বিভাগয় প্রধান ফাতেমা সিদ্দিকি, মৃত্তিকা বিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর নজরুল ইসলাম, সরকারি বরিশাল কলেজের উপাধ্যক্ষ শচীন কুমার রায়, ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স.ম ইমানুল হাকিম, যুগ্ম আহবায়ক মঈন তুষার, সৈয়দা ফাতেমা মমতাজ মলি, ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি শামিল শাহরোখ তমাল, ছাত্রলীগ জাসদ সভাপতি সিদ্ধার্থ মন্ডল। ছাত্র ইউনিয়নের অহিদুজ্জামান অহিদ, বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার সভাপতি নুরুল আম্বিয়া বাবু, একুশে অনির্বাণের সভাপতি ফয়সাল আহমেদ মুন্না। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. ননী নোপাল দাস বলেন, বিএম কলেজ শুধু দক্ষিণাঞ্চলের নয়। উপমহাদেশের শিক্ষা বিস্তারে রেখেছে গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকা শুধু শিক্ষাবিস্তারে নয় ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত এদেশের স্বাধিকার স্বাধীনতা ও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে এ কলেজের শিক্ষক কর্মচারী শিক্ষার্থীদের অবদান ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায়ের অংশ এ ধারা অতীতে ছিল ভবিষ্যতে থাকবে। পরে কলেজ প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের ছবির মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

উল্লেখ্য, সাগরবিধৌত নদীমেখলা তাল-তমালবেষ্ট্রিত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বরিশাল এককালে বাংলার শস্যভাণ্ডার ও প্রাচ্যের ভেনিস নামে পরিচিত হলেও ঢাকা ও কোলকাতা থেকে দূরে অবস্থান এবং নদীনালা দ্বারা বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে অনেক পশ্চাৎপদ ছিল। ১৮৫৪ সনে বরিশাল জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ অঞ্চলে আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যে নবজাগরণ শুরু হয় তারই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় জনগণের দাবি এবং শ্রী ব্রজমোহন দত্তের পৃষ্ঠপোষকতায় আধুনিক বরিশালের স্থপতি, দরিদ্রবান্ধব মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত ১৮৮৪ সনে প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন বি.এম. স্কুল। কিন্তু প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের কোন সুযোগ না থাকায় বরিশালের তৎকালীন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট শ্রী রমেশ চন্দ্র দত্তের অনুরোধে বরিশাল তথা দক্ষিণ বাংলার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৮৮৯ সনের ১৪ জুন তিনি তাঁর বাবা ব্রজমোহন দত্তের নামে সত্য, প্রেম, পবিত্রতার মহান আদর্শে উক্ত স্কুল কম্পাউন্ডে বি.এম. কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজটি শতাধিক বর্ষব্যাপী শিক্ষার আলো ছড়িয়ে এ অঞ্চলের অসংখ্য দরিদ্র, নিঃস্ব ও স্বল্প আয়ের মানুষকে দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত ভারতবর্ষের অনেক খ্যাতিমান শিক্ষকের সমাবেশ ঘটিয়ে এ কলেজের শিক্ষারমান উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যান। কলেজের তৎকালীন অধ্যাপকদের প্রজ্ঞা ও শিক্ষাপদ্ধতির উন্নতমান লক্ষ করে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯২২ সনে ইংরেজি ও দর্শনে ১৯২৫ সনে সংস্কৃত ও গণিতে ১৯২৮ সনে রসায়নে, ১৯২৯ সনে অর্থনীতিতে অনার্স কোর্স চালু করে। ১৯৪৭ সনে দেশ বিভাগের ফলে শিক্ষক সংকটের কারণে অনার্স কোর্সগুলো বিলুপ্ত করা হয়।
১৯৬৪-৬৫ সনে ব্রজমোহন কলেজে পুনরায় অর্থনীতিতে অনার্স কোর্স খোলা হয়। ১৯৬৫ সনের ১ জুলাই কলেজটি প্রাদেশিকীকরণ করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সনে (১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে) সরকারি ব্রজমোহন কলেজে বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা এই সাতটি বিষয়ে অনার্স এবং বাংলা, অর্থনীতি, ইতিহাস ও রসায়ন এই চারটি বিষয়ে মাষ্টার্স কোর্স খোলা হয়। ১৯৭৫ সনে ইতিহাসে অনার্স কোর্স চালু করা হয়। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সনে ইসলামের ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা ও পদার্থবিদ্যা-এর পাঁচটি বিষয়ে প্রথম পর্ব মাষ্টার্স কোর্স খোলা হয়। ১৯৮৯ সনে ইংরেজি ও মৃত্তিকা বিজ্ঞানে মাষ্টার্স ১ম পর্ব এবং ১৯৯০ সনে ইংরেজি, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, গণিত, মৃত্তিকাবিজ্ঞান ও প্রাণিবিজ্ঞান-এই সাতটি বিষয়ে অনার্স এবং গণিতে মাষ্টার্স ১ম পর্ব পাঠক্রম চালু করা হয়। ১৯৯২-৯৩ সনে সমাজকল্যাণে এবং ১৯৯৪-৯৫ সনে ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃত, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানে মাষ্টার্স ১ম পর্ব পাঠক্রম চালু করা হয়। ১৯৯৫-৯৬ সনে সমাজকল্যাণে এবং ২০০৫-০৬ সনে ইসলামি শিক্ষায় অনার্স কোর্স খোলা হয়। ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন, খেলাফত ও অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’১ শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা’র আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধসহ এ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিএম কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রীদের রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। এছাড়াও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অগণিত ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবিদ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজ্ঞ এ কলেজের ছাত্র ছিলেন। বিএম কলেজ শুধু বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠই নয়, কলেজটি এ অঞ্চলের মানুষের অহংকার।